বন্ধ দরজা খুলে শেখ মুজিবুর রহমান বেরিয়ে এলেন। দেরি হয়ে গেছে। বেলা আড়াইটায় রেসকোর্সের সভা আরম্ভ হবে কথা ছিলো। রুদ্ধদ্বার বৈঠকের নানা আলোচনায় এই ৩২ নম্বরেই আড়াইটা বেজে গেলো।

বাইরে বেরিয়ে শেখ মুজিব গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। হাত ইশারা করে তার সাথে পেছনে ডেকে নিলেন তাজউদ্দীনকে। তাজউদ্দীন উঠতে উঠতে চালকের পাশের আসনে গিয়ে বসলেন গাজী গোলাম মোস্তফা। সাদা রঙের মাজদা গাড়িটি যাত্রা করলো রেসকোর্সের দিকে।

রাস্তায় চোখে পড়ছে অগণিত মানুষ। দল বেঁধে, ছোটছোট মিছিলে ভাগ হয়ে তারা সবাই চলছে রেসকোর্সের দিকে। তারা মুজিবরের মুখের কথা শুনতে চায়, তারা জানতে চায় বঙ্গবন্ধুর চূড়ান্ত নির্দেশ। প্রতিটি মানুষের মুখ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে শেখ মুজিবের বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে। এত এত মানুষ তার মুখের দিকে চেয়ে কী শুনতে চায় আজ?

অস্বস্তি কাটাতে শেখ মুজিব পাশে বসা তাজউদ্দীনের দিকে তাকান। দেখেন, তাজউদ্দীন দুই হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে তার তর্জনি স্পর্শ করছেন বারবার। পুরোনো অভ্যাস এটা, গভীরভাবে কিছু চিন্তা করবার সময় তাজউদ্দীন প্রায়ই করেন। মুজিব বোঝেন, এই অদ্ভুত অনিশ্চিত অনুভূতি ভর করেছে তার পুরোনো সাথীকেও। ‘খসড়াটা ভালো হইছে তাজউদ্দীন।’ – জলদ্গম্ভীর স্বরে তাজউদ্দীনকে বলেন শেখ মুজিব।

তাজউদ্দীন ভাবনা থামিয়ে শেখ মুজিবের দিকে তাকান। মুজিব ভাই কী বলছেন বুঝতেই তার কিছুটা সময় চলে যায়। এরপর তিনি মাথা ঝাঁকান, কোনো কথা বলেন না। গত দুইদিন ধরে তিনি, আবদুস সামাদ আজাদ আর আবদুল মমিন ধানমণ্ডির ৩১ নম্বরে সিএসপি অফিসার ফজলুর রহমানের বাসায় একটা খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন মুজিব ভাইয়ের আজকের ভাষণের জন্যে। মুজিব ভাই সেটার কথাই বলেছেন। তাজউদ্দীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কোনো খসড়াই আজকে সম্ভবত মুজিব ভাই অনুসরণ করতে পারবেন না।

তাজউদ্দীনের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে চলমান গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন শেখ মুজিব। পরিস্থিতি পালটাচ্ছে খুব দ্রুত। গতকাল রাতে ইয়াহিয়া ফোনে সতর্ক করে দিয়েছে তাকে, পাঠিয়েছে একটি টেলিপ্রিন্টার বার্তাও। হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত যেন মুজিব আজ ঘোষণা না করেন, এটাই বক্তব্য ইয়াহিয়ার।

সকালে এসেছিলো ছাত্রনেতারাও। রব, রাজ্জাক, মণি, সিরাজুল আলম─ওরা সবাই। তাদের দাবি স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলার মানুষ স্বাধীনতার ডাক আজ শুনতে চায় শেখ মুজিবের কণ্ঠে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্বাধীনতার সরাসরি ঘোষণা কি করে দেয়া যায়? বিশ্বজনমত হারাবেন না তিনি এতে? আর এই মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিস্থিতি এলে সেটায় নামার জন্যে প্রস্তুত কি বাঙালিরা?…শেখ মুজিব ভাবেন, শেখ মুজিব ভাবতে থাকেন। আজ এতগুলো মানুষকে রক্ষা করা যাবে তো ঠিকঠাক? সামরিক জান্তা যে ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রস্তুত, সে খবর তো এই মানুষগুলো জানে না, জানেন কেবল শেখ মুজিব।

প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে রেসকোর্সে পৌঁছবার আগে গাড়ি বদলে খোলা ট্রাকের উপর উঠতে হলো মুজিবকে। সাথে থাকলেন তরুণ ছাত্রনেতারাও। ময়দানের উত্তর পাশে বসানো হয়েছে বিশাল মঞ্চ। নিশ্চয়ই চাঁন মিয়া মঞ্চ বানিয়েছেন প্রতিবারের মতো, ভাবলেন শেখ মুজিব। সেই মঞ্চে স্লোগান দিতে লাগলেন নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল কুদ্দুস মাখনেরা। স্লোগান ফিরে আসতে লাগলো লক্ষ লক্ষ স্বরে প্রতিধ্বনিত হয়ে। ‘জয় বাংলা!’, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ , ‘হুলিয়ার ঘোষণা─মানি না, মানবো না !

গাজী গোলাম মোস্তফার পেছনে মঞ্চে উঠে শেখ মুজিব সামনে চাইলেন। যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। এই জীবনে  ভাষণ কম দেননি মুজিব, কিন্তু এখন বুঝলেন‘জনসমুদ্র’ শব্দটা এতদিন কেবল বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছেন। শেখ মুজিব আজ প্রথম অনুধাবন করলেন মানুষের সমুদ্র কতটা বিশাল হতে পারে আর অবাক বিস্ময়ে শুনলেন সেই সমুদ্রের গর্জন। কত মানুষ এসেছে আজ ময়দানে─সাত লাখ? আট লাখ? দশ কিংবা বারো লাখ? বঙ্গবন্ধু মুজিবরের ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায় যান্ত্রিক শব্দে। তিনি আকাশের দিকে চাইলেন। সেখানে চক্কর দিচ্ছে সামরিক হেলিকপ্টার। কী চায় ঐ কপ্টারে বসা সৈন্যেরা? সবদিক আজকে রক্ষা করা যাবে তো?…

মাইকের সামনে প্রথম গিয়ে দাঁড়ালেন তাজউদ্দীনই। ছোট্ট এক ভাষণের শেষে তিনি বললেন, ‘এবার আপনাদের সামনে ও জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

সেই মুহূর্তে পুরো জনসমুদ্র নীরব হয়ে গেলো বড় অলৌকিকভাবে। শ্বাস ফেলতে পর্যন্ত ভুলে গেছে যেন লাখো মানুষ। অধীর, ব্যাকুল এখন সকলে। কী হবে এখন, কী বলবেন নেতা।

শেখ মুজিব একটা লম্বা শ্বাস চেপে রেখে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অজস্র ভাবনাকে গুছিয়ে নিতে তিনি চোখ বুজলেন এক পলকের জন্যে। কী আশ্চর্য! গতরাতে ৩২ নম্বরের বারান্দায় নীরব পদচারণায় তিনি গুছিয়ে রেখেছিলেন এক একটি লাইন, অথচ এই মুহূর্তে সেগুলোর কিছুই মনে পড়লো না তার। শুধু মনে পড়লো তার স্ত্রীর মুখ। ফজিলাতুন্নেসা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘কারো পরামর্শ শুনার দরকার নাই। তোমার যা মনে আসে, তুমি তাই বলবা।’

চোখ খুললেন শেখ মুজিব। বর্ষা ঝরানো মেঘের স্বরে তিনি শুরু করলেন ভাষণ। ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে এসে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন।

সেই মুহূর্তে ঢাকা শহরের অপরপ্রান্তে রানওয়ে স্পর্শ করবার চেষ্টায় ব্যস্ত একটি বিমান। বিমানের যাত্রী রাও ফরমান আলী এবং পূর্ব পাকিস্তানের নয়ানিযুক্ত সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান। রেসকোর্সের অগণিত মানুষের মাথা দেখে টিক্কা খানের কপালে ঘামের ফোঁটা দেখা দিলো। ফরমানের চোখের আড়ালে সেই ঘাম মুছে টিক্কা গম্ভীর স্বরে কেবল বললো, ‘সো দিস ইজ হোয়াট হ্যাপেনিং ইন ঢাকা। ব্লাডি হেল!

টিক্কা খান যখন বিমানের জানালায় চোখ রেখে ঘাম মুছে যাচ্ছে প্রাণপণে, তখন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক আশফাকুজ্জামান খান ফোনের রিসিভার তুলছেন। শেখ মুজিবের ভাষণ রেডিওতে প্রচারের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ফোন করেছেন মেজর সিদ্দিক সালিক। ‘বানধ্‌ কারো ইয়ে সাব। নাথিং অফ শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন এয়ার আনটিল ফার্দার অরডার।

আশফাকুজ্জামান খান আহত বোধ করলেন। কিন্তু পরক্ষণেই দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের কণ্ঠ যদি প্রচার করা না হয়, তাহলে অন্য কিছুও আর এই কেন্দ্র থেকে আর প্রচার করা হবে না।’ আশফাকুজ্জামানের নেতৃত্বে ঢাকা কেন্দ্রের বাঙালিরা বেরিয়ে এলেন অফিস থেকে-রেডিও হয়ে পড়লো অচল।

এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ির বারো ব্যান্ডের রেডিওটি তাই চুপ হয়ে গেলো ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাজিয়েই। রুমীর মা জাহানারা ইমাম আর চেষ্টা করেও শুনতে পেলেন না মুজিবের ভাষণ।

তবে শুনলো আর সবাই। ময়দানের কোণের একটা দোতলা বাড়ির বারান্দা হতে ছোট্ট রিমি দুরবিন দিয়ে দেখছে মানুষের মুখ আর শুনছে শেখ মুজিবের ভাষণ। ‘…আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’

ভাষণ শুনছে এসএম হলের তারেকুল আলম, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো বহু বহু ছাত্র। শেখ মুজিব বলে চলেছেন, …২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, রক্তের দাগ শুকায় নাই।

পিয়ন আবদুল বাতেন ভাষণ শুনছে। সে রাজনীতি বোঝে না, সে বোঝে না অর্থনৈতিক বৈষম্য। সে কেবল জানে মঞ্চের মানুষটি কথা বলছেন তার মতো আরো সাড়ে সাত কোটির হয়ে। …সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না!

ভাষণ শুনছেন সাংবাদিক সারির আবদুল গাফফার চৌধুরী, কামাল লোহানী, আনোয়ার জাহিদ। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ভাষণ শুনতে এসেছেন রাশেদ খান মেননরাও। চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ হেঁটে এসেছে ঘোড়াশালের মানুষ, তাদের গামছায় বাঁধা চিড়ে আর গুড়─তারা ভাষণ শুনছে। মহিলা সমিতির মেয়েরা আর নেত্রীরা শুনছেন ভাষণ। সাদা লাঠিতে ঠুকঠুক করে পথে আঘাত করে যারা চলে, সেই অন্ধ ছেলেরাও এসেছে দল বেঁধে মিছিল করে।

মঞ্চে বসে তাজউদ্দীন অবাক হয়ে শুনছেন মুজিব ভাইয়ের ভাষণ আর ভাবছেন, কী অদ্ভুত─কী অবিশ্বাস্য এই কণ্ঠটি! মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।...’

তাজউদ্দীনের হঠাৎ মনে হয় শেখ মুজিব যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা টলোমলো কোনো জাহাজের ক্যাপ্টেন, যিনি ঝড়ের আঘাত, নষ্ট বেতার আর বুলেটবিদ্ধ যাত্রীদের নিয়েও সমস্তদিক রক্ষা করে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন জাহাজের মাস্তুলের পাশে দাঁড়িয়ে। ক্যাপ্টেন বলছেন তাদের কালে কালে সঞ্চিত ক্ষোভের কথা, ক্যাপ্টেন বলছেন তাদের অধিকারের শব্দ। সহসা আঙ্গুল তুলে রূপকথার সেই ক্যাপ্টেন বললেন, এবারের সংগ্রাম─আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রাম─স্বাধীনতার সংগ্রাম!’ 

সেই মুহূর্তেই ঝড় উঠলো সমুদ্রে─আকাশ বাতাস তুচ্ছ হয়ে গেলো─উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে উঠলো সুস্থিরতম মানুষটিও। তাজউদ্দীন গর্জনরত সামনের সমুদ্রের দিকে চেয়ে অনুধাবন করলেন, এই মাত্রই শেখ মুজিবের তর্জনিতে পদ্মার পলিদ্বীপের অভিধানে যোগ হয়ে গেছে একটি অবিশ্বাস্য শব্দ।

স্বাধীনতা।

জনসমক্ষে মনোভাব প্রকাশে তীব্র আপত্তি তাজউদ্দীনের, তবুও তার চশমার কাঁচ ঘোলাটে হয়ে যায়। ঘোলা চোখে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় খালি, সমুদ্র দেখা যায় না।

[মার্চ, ২০১৩]