এলোপাথাড়ি ভাবে সহস্র বই পড়বার চাইতে ভালো লেগে যাওয়া কোনো লেখকের হাতে গোণা কয়েকটা বই পড়াও ভালো, এই সত্য আবিষ্কার করতে জীবনের অনেকটা সময় অপচয়িত হয়ে গেছে আমার। ইদানিং তাই ফুলের বনে যার পাশে যাই, চেষ্টা করি তার সমস্ত সুবাস এমনকি পচা গন্ধও ঠিকভাবে আত্মস্থ করতে। সে অভ্যাসেই আমার আতস কাঁচের নিচে সম্প্রতি এসে দাঁড়িয়েছেন তুরস্কের ওরহান পামুক। ছেষট্টি বছরে দাঁড়িয়ে থাকা পামুক, বলাই বাহুল্য, এ মুহুর্তে নিজ দেশের সবচাইতে সবচেয়ে নামজাদা ঔপন্যাসিক। প্রাচ্যের লেখকদের ক্ষেত্রে লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়াটা নানা কারণে কঠিন। পামুকের ক্ষেত্রে সুবিধা ছিলো স্বনামে খ্যাতিমান হয়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত তাকে জীবিকার জন্য লিখতে হয়নি। রেলশিল্পে পয়সা কামানো এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্ম নেয়া ওরহান পামুক পড়াশোনা করেছেন প্রকৌশলবিদ্যা, স্থাপত্য আর সাংবাদিকতায়; কিন্তু ওসবের কোনোটাতেই না গিয়ে তিনি বরং পালটে দিয়েছেন তুরস্কের উপন্যাসের গতিপথ। মাই নেইম ইজ রেড, এই নোবেল জয়ী লেখকের সামর্থ্যের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।

উপন্যাসের প্রথম বাক্যেই কুয়ার ভেতর থেকে কথা বলে উঠলো এক লাশ, আর ওরহান পামুক আমাদের ক্রমশ টেনে নিলেন রক্ত ও রঙে মেশানো এক জগতে। সে জগতে রহস্য আছে, আছে মিষ্টি প্রেম, আছে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীর মতো রহস্যভেদ, অথবা মিষ্টি ভালোবাসার মধুর চুম্বনকে পাশ কাটিয়ে আবিষ্কার করি মাই নেইম ইজ রেড দ্বিতীয়বার পড়ার পর, এই উপন্যাস আসলে উন্মোচন করেছে আরো গভীরতর কিছু। ষোড়শ শতাব্দীর ইস্তানবুলে আমাদের টেনে নিয়ে ওরহান পামুক আসলে বলেছেন সেই গল্পটি, যে গল্প বলবার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়েছেন সারাটি জীবন ধরে।

সে বিষয়ে বলার আগে আসলে গল্পটা নিয়েই কিছু বলা দরকার। মুসলিম চিত্রকলার এক রঙিন অথচ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন জগতে আমাদের টেনে নিতে গিয়ে পামুক তার লেখা সাজিয়েছেন একাধিক বুদবুদে।

প্রথম বুদবুদটি আমাদের সামনে নিয়ে আসে জোড়া খুনের রহস্য। হিজরতের সহস্রাব্দ পূর্তি উপলক্ষে আঁকা হবে একটি বিশেষ বই, তার পাতায় পাতায় সুলতানের প্রশংসার সাথে থাকবে সেরা শিল্পীদের আঁকা ছবির অলংকরণ। এমনটাই খায়েশ অটোমান সুলতান তৃতীয় মুরাদের, এবং এই কাজের দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন এনিশ্তে নামের এক শিল্পীকে; যার অধীনে এই কাজ সম্পন্ন করছে আরো কিছু শিল্পীর একত্র প্রয়াস। কিন্তু এদিকে শহরে ছড়িয়ে পড়েছে গুজব, ইসলামি রীতির অবমাননা করে এ বইতে নাকি অলংকরণগুলো করা হবে ইউরোপিয় চিত্রকলার অনুসরণে, অর্থাৎ মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণির প্রকৃত অবয়ব এঁকে। এমন রটনা থেকেই কি হয়ে গেলো খুন হয়ে গেলেন দুজন শিল্পী? আর সুলতানের সেরা তিন শিল্পী, অটোমান ঐতিহ্য অনুসারে যাদের ডাকা হয় প্রজাপতি, সারস আর জলপাই বলে, তাদের মাঝেই কি লুকিয়ে আছে খুনী?

উপন্যাসের রহস্যঘন এই স্তরের পেছনে পামুক রেখেছেন আরো একটি বুদবুদ, সেটা আবার গড়ে উঠেছে এক প্রেমের গল্প নিয়ে। সে গল্পের নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় আছে যথাক্রমে এক যুগ পরে শহরে ফিরে আসা ব্ল্যাক আর যুদ্ধে স্বামী হারানো শাকুর। মৃত স্বামীর ছোট ভাই হাসান তাকে বিয়ে করতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে বলে দুই ছেলের মা শাকুর বেচারি এমনিতেই ছিলো ঝামেলায়, এর মাঝে খুন হয়ে যায় তার বাবা এনিশ্তে। ঘটনার মারপ্যাঁচে খুনীকে খুঁজে বের করতে গোয়েন্দাগিরির ভার চাপে শাকুরের প্রেমিক ব্ল্যাকের কাঁধেই। সিনেমার ভিলেন হিসেবে হাসানকে সাথে রেখে এগিয়ে চলা এই প্রেমকাহিনীর শেষ পরিণতি কী হবে?

এমন দুই বুদবুদের আড়ালে, ওরহান পামুক তার কাহিনী এগিয়ে নিয়ে গেছেন ক্রমাগত গল্পের কথককে বদলে নিয়ে। কুয়োর অতলে পড়ে থাকা লাশ থেকে শুরু করে শহরের সেরা শিল্পীরা তো আছেই, পামুকের হাতে কথা বলেছে দেয়ালে ঝোলানো ছবির ঘোড়া আর কুকুর, বাদ যায়নি স্বর্ণমুদ্রা বা ইবলিশ শয়তানও। হাতসাফাইয়ের চৈনিক বাক্সের মতো পামুক বলেছেন গল্পের ভেতর গল্প, রেখেছেন হেঁয়ালির মাঝে হেঁয়ালি। জায়গায় জায়গায় তার বয়ান খানিকটা দীর্ঘ মনে হয়েছে, উপমার ব্যবহারকেও যথেষ্টর চাইতেও অধিক বলে মনে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কাহিনীর স্রোতে বেশ অগ্রাহ্য করা গেছে ওইটুকু। আর, না বললে চলে না, পামুকের আশ্চর্য ভাষাটির কথা। শরতের আবহাওয়ার মতো মৃদু সে ভাষায় কোথাও শিকারীর রুঢ়তা নেই। ঝরঝরে মিষ্টি ভালোবাসা বলো, অথবা শ্বাসরুদ্ধকর খুন জখমের মুহুর্ত; ভাষাটি চিরকালের আনন্দদায়িনী, অননুকরণীয়, ঊঁচু দেয়াল না হলেওফুলগাছের বেষ্টনীতে ধরবার বাইরে। সত্যিকারের একজন কথাশিল্পী বলে লোকটাকে বেশ আলাদা করা যায়। অপরাধ হবে অনুবাদককে ভুলে যাওয়াটাও, টার্কিশ ভাষার ব্যাকরণের প্যাঁচে সমস্ত বাক্যের শেষেই থেকে যায় ক্রিয়াপদ, অনুবাদক Erdag Göknar সেই পুনরাবৃত্তি বিন্দুমাত্র বুঝবার সুযোগ দেননি পাঠককে।

কিন্তু এসব গল্পের উত্থান পতনের কথা কেবল, বাক্যের পর বাক্য বুনে, পামুক কি পাঠকদের কেবল এই রহস্য কাহিনী আর প্রেমের গপ্পো জানাতে চেয়েছেন? চারশো বছরের পুরোনো ইস্তানবুলে মোমবাতির আলোয় সুলতানের কোষাগারে একের পর এক বইয়ের চোখ ধাঁধানো অলংকরণ দেখতে দেখতে এই প্রশ্নের চুলকানিতে পাঠকের ক্যানো যেন মনে হয় হয়, নাহ, সমস্ত ধ্রুপদী উপন্যাসের মতোই, আরো কোনো বিপন্ন সত্যকে লেখক আড়াল করেছেন তার বয়ানের ভেতরে। আর তখন, কলমের খোঁচায় যিনি তুরস্কের ইস্তানবুলকে দুনিয়াজোড়া পাঠকের কাছে করে তুলেছেন মনোরম মনোটনাস এক স্মৃতিকাতর নাম, সেই ওরহান পামুককে তার ভালোবাসার শহরের বুকে স্থাপন করে হিসাব মেলালে পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে মাই নেইম ইজ রেড উপন্যাসের আসল টানাপোড়েন।

সেই দ্বন্দ্ব পরিষ্কার করার আগে আমরা একটু ফিরে তাকানো উচিত উপন্যাসে বর্ণিত চিত্রকলার দুটি ধারার প্রতি।

মুসলিম রীতি অনুযায়ী অটোমান ঢঙয়ের যে অলংকরণ, তাতে করে শিল্পীর নিজস্বতা থাকা বলতে গেলে পাপ। শিল্পীর সাক্ষর বা স্বাতন্ত্র্য বহন করা এই রীতিতে অমার্জনীয় ত্রুটি। অন্যদিকে রেনেসাঁর পরে ইউরোপীয়ান রীতির চিত্রকলা কিন্তু উলটো পথে হেঁটেছে, শিল্পমানের প্রধান বিবেচ্যসেখানে এখন শিল্পীর নিজস্বতা। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এসে তাই, ইউরোপিয়ান শিল্পীরা যেখানে মানুষ এবং অন্য সমস্ত কিছুকে আঁকছে বাস্তবের অনুরুপ করে, মুসলিম চিত্রকরেরা তখনো ধর্ম মেনে নির্দিষ্ট অবয়ব সৃষ্টি করছেন না তাদের অলংকরণে। ইউরোপিয়ান রীতি এমন ভাবে অরণ্যকে আঁকছে, যেন প্রতিটি বৃক্ষকে আলাদা করা যায় অপরের থেকে; আর অটোমান রীতির অলংকরণে, গাছেরা এমনকি বৃক্ষ হতেও চায় না, তার চায় বৃক্ষের অর্থ বহন করতে।

ভিন্ন দুই শিল্পরীতির এই যে মুখোমুখি হয়ে পড়া, খেয়াল করে দেখি, পামুক সেটা রেখেছেন এমন এক পটভূমিতে, যখন পরাক্রমশালী অটোমান সভ্যতা মাত্রই ধাক্কা খেয়েছে পশ্চিমাদের হাতে, সুলতান তৃতীয় মুরাদ পরাজিত হয়েছেন লেপান্তো’র যুদ্ধে। মনের গহীনে পাঠক জানে, পশ্চিমের কাছে হার মানবার সেটা কেবল শুরু, পরবর্তী কয়েকশো বছরে রাজনীতি আর সামরিক শক্তির হাত ধরে প্রাচ্য কেবল অসহায় আত্মসমর্পণই করে গেছে প্রতিপক্ষের কাছে। আর প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের প্রতীক যে এশিয়া আর ইউরোপ, এই দুই মহাদেশের ঠিক মাঝখানে অবস্থান করায় যে দেশটির গায়ে সবচেয়ে বেশি লেগেছে এই টানাপোড়েনের আঁচ, সেটা পামুকের তুরস্ক।

ফলে মাই নেইম ইজ রেড আসলে হয়ে উঠেছে রহস্য কাহিনীর আড়ালে দুই সভ্যতার লড়াইয়ের গল্প। পরিহাস এই যে উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে খুনী যখন ধরা পড়ে যায়, আমরা দেখি তার পরিচয়কে আসলে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার অলংকরণের নিজস্বতা। কিন্তু তার কোন অপরাধটা বড়? খুন, নাকি শিল্পের জগতে নিজের একটা স্বাতন্ত্র্য তৈরি করতে চাওয়া? হিচককের সিনেমার মতোই, খুনীর মনে যে উথাল পাতাল চলে, সেটা প্রত্যক্ষ করে তার জন্য মায়া বোধ না করে কোনো রাস্তা থাকে না পাঠকের। তবে সাথে মনে আরো একটা প্রশ্নও জাগে। আত্মগ্লানিতে ভোগা এই লোকটিকে অপরাধী করে ঔপন্যাসিক কি ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইলেন পাঠককে? ক্যানো পামুকের হাতে অপরাধী হয়ে উঠেছে সেই শিল্পী, যে অটোমান ঢঙ পরিত্যাগ করে চেয়েছিলো পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে ছবি আঁকতে?

উত্তর পাবার আগে আমাদের তখন আরো একবার ফিরে তাকাতে হয় তুরস্কের দিকে। সেই তুরস্ক, যা একালে না হয়েছে এশিয়ার, না হয়েছে ইউরোপের; সেই তুরস্ক, যার ঘরে বসত করে কামাল আতাতুর্কের উদারমনা ইসলাম আর একালে ছড়িয়ে পড়া ডানপন্থা; সেই তুরস্ক, যে নিজের অলংকরণের স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করে ফেলেছে অনেক আগেই, কিন্তু আজও অর্জন করতে পারেনি ইউরোপের শিল্পের উত্তরাধিকার, সেই তুরস্কের আধুনিক উপন্যাসের বরপুত্র পামুকের ফিসিফিসিয়ে বলা কথাগুলোর পুরো মানে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় তখন। উপন্যাসের শেষে পাঠক তাই অটোমান সভ্যতার এককালের চিহ্ন বহন করা তুরস্ককে দেখতে পায় আত্ম-অবমাননার নির্মম গ্লানি গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে থাকতে, যার অতীত ছিলো, কিন্তু ভবিষ্যতটা বর্তমানের মতোই দ্বিধান্বিত।

মাই নেইম ইজ রেড তাই, রঙের ও রক্তের দুনিয়ার আড়ালে প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের লড়াইয়ের এক টুকরো ইতিহাস, যেখানে দুই বিপরীত ভাবধারার ডুয়েলে নিয়ত ক্ষতবিক্ষত হওয়া আধুনিক তুরস্কের আত্মাকে ওরহান পামুক বলে গেলেন সাদায় কালোয়। এবং পামুক নিজেও আশ্রয় নিয়েছেন উপন্যাস নামের এমন একটি শিল্পমাধ্যমের, যার উৎপত্তি ইউরোপের বুকে। তুরস্কের মতো আমরাও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ি তখন। ইতিহাসের এই কৌতুক কি পাশ্চাত্যের নির্মম প্রহসন, না প্রাচ্যের অনিঃশেষ সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন?

[ ১ জানুয়ারি, ২০১৯]