সকালের ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারপাশ, দূরবীন চোখে দিয়েও সেতুর ওপারের ঢাকা শহরকে দেখা যাচ্ছে না। জেনারেল নাগরার মুখে তাই সামান্য বিরক্তির ভাব, সেটা দেখে কেউ ধারণা করতে পারবে না এই মুহূর্তে তার বুকের ভেতর কেমন সব অনুভূতির উথালপাতাল।
জেনারেল নাগরাকে প্রাথমিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো টঙ্গী পর্যন্ত পৌঁছে অবস্থান নিতে। সেই দায়িত্ব পূরণ করার পরে হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ এসেছে ঢাকার পনেরো মাইলের মাঝে চলে যেতে। এরপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। সেনাপতি যদি সব দেখে সামনে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে যেতে পারেন। ঠিক এ জায়গাতে দাঁড়িয়েই নাগরার বুকে আশার সাথে দৌড়াচ্ছে আশঙ্কার ঘোড়া। এখনো পুরো জেনারেল নন, মেজর জেনারেল তিনি। অথচ ঢাকা এখন তার হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এসেছে। ইতিহাসের অংশ হবার ললাটলিপি কি ভাগ্য তার জন্যেই রেখেছে? ঢাকার পতন কি তবে তার হাতেই হতে যাচ্ছে?
দূরবীন থেকে চোখ সরিয়ে হাতঘড়িতে নিলেন নাগরা। গতকাল বিকাল পাঁচটা থেকে আজ সকাল নয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান হামলা বন্ধ রাখা হয়েছে জেনারেল মানেকশ’র নির্দেশে, নিয়াজী নাকি অনুরোধ করেছেন। এর মাঝে নিয়াজী আত্মসমর্পণ না করলে ঢাকা শহরের ওপর অল আউট অ্যাটাক চালাবে ভারতের বিমান আর মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা। বেলা নয়টা হতে আর মাত্র এক ঘণ্টা বাকি।
জেনারেল নাগরা তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে একবার চাইলেন। ব্রিগেডিয়ার সান সিং আর ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং-এর পাশে অবিন্যস্ত চুলের এক বাঙালি যুবক দাঁড়িয়ে। নাগরা শুনেছেন, মার্চে পাকিস্তানি মিলিটারির আক্রমণের কদিন পরেই টাঙ্গাইল এলাকায় বেসামরিক মানুষদের নিয়ে এক দুর্ধর্ষ বাহিনী তৈরী করেছিলো এই যুবক। গত কয় মাসে অগণিতবার সম্মুখযুদ্ধে মিলিটারিদের চমকে দিয়েছে সেই বাহিনী। এই এলাকায় বজ্র নামের ছেলেটির জনপ্রিয়তা রবিন হুডের মতোই।
…নাগরা তার কর্তব্য স্থির করে ফেললেন। প্রতিপক্ষের সাথে দর কষাকষিতে জেতাটা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ট্রেনে ওঠার মতোই, যেখানে অপেক্ষমান ব্যক্তিটি প্রায়ই জানে না ট্রেন কোন স্টেশনে থামবে। নাগরার বিশ্বাস, এই মুহূর্তে তিনি ঠিক স্টেশনেই দাঁড়িয়ে আছেন। পকেট থেকে কাগজ নিয়ে সামনের জীপটার বনেটের ওপরেই নাগরা একটা চিরকুট লিখলেন।
‘প্রিয় আবদুল্লাহ,
খেলা শেষ। তোমার হাতে আর কোনো চাল নেই। আমরা এসে পড়েছি, পালানোর কোনো রাস্তাও অবশিষ্ট নেই তোমার। আমার পরামর্শ হচ্ছে, সারেন্ডার করাটাই তোমার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কথা দিচ্ছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবো। অন্যদের সাথেও জেনেভা চুক্তি মোতাবেক আচরণই করা হবে। আমরা মিরপুর ব্রিজে অপেক্ষা করছি।
─মেজর জেনারেল নাগরা।’
চিরকুটটা পেয়ে নিয়াজীর মুখের অবস্থা কী হতে পারে, নাগরা সেটা ভেবে মনে মনে মৃদু হাসলেন। নিয়াজী তার পূর্ব পরিচিত। বৃটিশ আর্মিতে তিনি আর নিয়াজী একই সাথে কমিশন পেয়েছিলেন, পাকিস্তানি ফৌজে গিয়ে নিয়াজী এখন লেফটেন্যন্ট জেনারেল আর তিনি মেজর জেনারেল হয়েই থেমে আছেন।
সাদা ফ্ল্যাগ উড়িয়ে একটি জিপ নাগরার বার্তা বহন করে নিয়ে গেলো পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে। নিয়াজী যখন চিরকুটটি হাতে পেলেন, ঘড়ির কাঁটা তখন নয় ছুইঁ ছুঁই।
বার্তাটি পেয়েই স্বঘোষিত এই ব্যাঘ্র শাবক চেয়ারে কেমন এলিয়ে পড়লেন। বিহ্বলভাবে তিনি চিঠিটি এগিয়ে দিলেন চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা জেনারেল জামশেদ, রাও ফরমান আলী আর রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফের দিকে। গত নয়টি মাসের রক্তপিপাসা হঠাৎ দ্রবীভূত হয়ে গেলো যেন, নীরবতার বাষ্পের ধোঁয়া ঘরটিকে করে তুললো আচ্ছন্ন।
নিয়াজী হতাশ স্বরে বললেন, ‘কথা ছিলো চীন সৈন্য পাঠাবে। কথা ছিলো আমেরিকা সেভেন্থ ফ্লিট নিয়ে আসবে। রাওয়ালপিন্ডির ঐ কুত্তার বাচ্চারা আমাকে এতদিন এইসব ভুলভাল বুঝিয়ে এসেছে। ঐ বেজন্মারাই আমার আজকের এই অবস্থার জন্যে দায়ী!’
আমেরিকান কনসাল স্পিভাক মারফৎ অবশ্য নিয়াজী আগেই ভারতের সেনাপ্রধাণ মানেকশ’কে একটা অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির আবেদন জানিয়ে। সেই আবেদন মানেকশ’কে পাঠানোর আগে মার্কিনিরা প্রায় একদিন নষ্ট করেছে, খতিয়ে দেখেছে এখনো পাকিস্তানকে বাঁচাবার কোনো উপায় আছে কি না। তারপর স্থির করেছে, উপমহাদেশের এই অবস্থায় আর কিছু করবার নেই তাদের। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর তারা নিয়াজীর বার্তা প্রেরণ করেছে মানেকশ’র কাছে। মানেকশ সেটা যথারীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। হাতের মুঠোয় এরকম একটা জয় অপেক্ষা করছে, এমন সময় কোনো সেনানায়ক যুদ্ধবিরতি মেনে নেবেন কেন?
মানেকশ’র প্রত্যাখ্যান মনে করে নিয়াজী অপমানে আর কোনো কথাই বললেন না। খানিক অপেক্ষার পরে সিদ্ধান্তহীন হেডকোয়ার্টারের নীরবতা অবশেষে ছিন্ন করলেন ফরমান আলী। শীতল রক্তের প্রাণী বলে খ্যাত ফরমান বলে উঠলেন, ‘এখন তো তাহলে আর কিছু করার নাই। যাও, জেনারেল নাগরাকে খাতির করে নিয়ে এসো।’
মিরপুর ব্রিজে অপেক্ষমান জেনারেল নাগরার কাছে প্রত্যুত্তর বয়ে নিয়ে এলো একটি স্টাফ কার, সেখানে উপবিষ্ট জেনারেল জামশেদের মুখ আসন্ন অপমানের আশঙ্কায় কালো হয়ে আছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মাথা নীচু করে জামশেদ তার রিভলভার আর সামরিক টুপি বাড়িয়ে দিলেন নাগরাকে। ব্রিজের ওপারের সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো রাজধানী শহরটিতে তখন কুয়াশা কেটে যাচ্ছে, রোদ উঠছে।
কয়েক মিনিট পরে একটি নীরব, কেউ জানে না তখন অপেক্ষা ঠিক কীসের জন্যে, ঢাকা শহরের রাস্তায় ছুটতে দেখা গেলো একটি মিলিটারি জিপকে, তার সামনে যাচ্ছে একটি স্টাফ কার। জেনারেল জামশেদ পথ দেখিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতরে নিয়ে যাচ্ছেন জেনারেল নাগরা আর তার সাথীদের।
সদর দফতরের অপারেশন রুম ততক্ষণে নিয়েছে অন্য চেহারা। দেয়াল জুড়ে এতদিন যেসব ম্যাপ ছড়ানো ছিলো যুদ্ধের পরিস্থিতি বিচার করতে, আজ সেসব অনুপস্থিত। ঘরের মাঝখানটা দখল করেছে নানা রকম খাদ্যদ্রব্য বোঝাই একটি ডাইনিং টেবিল। পরাজিত সেনাপতি নিয়াজী আপ্যায়নের ত্রুটি রাখেননি ‘মেহমান’দের জন্যে।
আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ঘরে ঢুকেই করমর্দন করলেন তার পূর্বপরিচিত মেজর জেনারেল নাগরার সাথে। নাগরা তখন নিয়াজীকে একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার সহকর্মীদের সাথে। ‘…এ হচ্ছে ব্রিগেডিয়ার সান সিং। …ইনি হলেন হরদেব সিং,ব্রিগেডিয়ার। …আর এই যে ছেলেটা, এর নাম হচ্ছে কাদের সিদ্দিকী।’
এরপরেই ঘটলো একটা ছোটোখাটো নাটক। কূটনীতির পরোয়া না করে টাইগার নিয়াজীর বাড়ানো হাতকে অগ্রাহ্য করলেন টাইগার সিদ্দিকী নামেও ইদানীং অল্পস্বল্প পরিচিত হয়ে ওঠা বজ্র নামের সেই যুবকটি। তার কাঁটাতারে মোড়ানো স্বর বলে উঠলো, ‘মাফ করবেন, আমি নারী ও শিশু হত্যাকারীদের সাথে হাত মেলাই না! আল্লাহর কাছে আমি অপরাধী হতে পারবো না।’
কাদের সিদ্দিকী যখন ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে জন্ম দিচ্ছেন এক অভূতপূর্ব নাটকের, আরো একজন বাঙালি তখন আবেগী শহর ঢাকার রাস্তায় ছোটাছুটি করছেন ইস্পাতের স্নায়ু নিয়ে। ক্র্যাক প্লাটুনের দীক্ষাগুরু মেজর হায়দার ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং’কে সাথে নিয়ে টহল দিচ্ছেন শহরে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাতে না হয় সেটাই তাদের লক্ষ্য।
অবরুদ্ধ ঢাকার রাস্তায় তখন বেরিয়ে এসেছে হাজারো প্রাণ। কে জানতো এ শহর এখনো এত শব্দ লুকিয়ে রেখেছিলো! ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত রাজপথ ক্ষণে ক্ষণে মনে করাচ্ছে দশটি মাস পেছনে ফেলে আসা মার্চের স্মৃতি। মেজর হায়দারের ছেলেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জায়গায়, বাঙালি জনমানুষের আক্রোশ থেকে তারাই রক্ষা করছে পাকিস্তানি পলায়নপর সেনাবাহিনীকে।
ইতোমধ্যে ভারত থেকে এসে আত্মসমর্পণের বিষয়ে নিয়াজীর সাথে আলোচনা করেছেন মেজর জেনারেল জ্যাকব। ঠিক হয়েছে, আজ বিকালে মিত্রবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছেই সারেন্ডার করবেন নিয়াজী। স্থান সেই রেসকোর্স, একটি তর্জনি যেখানে স্বাধীনতা শব্দটি তুলেছিলো বাংলাদেশের খাতায়।
দুপুর পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা যখন বিকালের দিকে যাচ্ছে, ঢাকা এয়ারপোর্টে তখন অবতরণ করলো অনেকগুলো ভারতীয় হেলিকপ্টার। লেঃ জেনারেল অরোরা নামলেন একটি কপ্টার থেকে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আরেক কপ্টার থেকে নামলেন এ কে খন্দকার। ‘ওসমানী কোথায়?’ এরকম একটি গুঞ্জন উঠেই স্তিমিত হয়ে গেলো সাথে সাথে। চূড়ান্ত বিজয় ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় আজ!
বিমানবন্দরে চারপাশে ভিড় করে থাকা অগণিত মানুষের ফাঁক গলে মেজর হায়দার তখন ছুটলেন রেসকোর্সের দিকে, পাকিস্তানি আত্মসমর্পণের জোগাড়যন্ত্র করতে হবে। ‘জালাল, একটা টেবিল যোগাড় করা লাগবে যে! চেয়ারও লাগবে কয়েকটা!’
ক্র্যাক প্লাটুন সদস্য জালাল ছুটলেন ঢাকা ক্লাবে। যোগাড় হলো একটি টেবিল আর একজোড়া চেয়ার। মানুষের হাতে হাতে সেগুলো পৌঁছে গেলো রেসকোর্সে।
মিত্রবাহিনীর তৈরি করা নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে লেঃ জেনারেল আরোরা, এ কে খন্দকারের সাথে নিয়াজীকেও ভেতরে ঢোকানো হলো। রেসকোর্সের ময়দানে ভিড় করা অগণিত মানুষ তখন নিয়াজীকে জ্যান্ত ছিঁড়ে ফেলতে উদগ্রীব, মেজর হায়দারের তাই সতর্ক না হয়ে উপায় তাকে না। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা প্রতিহত করতে তাকে তাই নীচু মাথার নিয়াজীর পাশে হাঁটতে দেখা যায় উদ্ধতভাবে।
নির্ধারিত চেয়ারে বসে আত্মসমর্পণের দলিলটিতে নিয়াজী একবার চোখ বোলালেন। ভোগী প্রকৃতির নিয়াজীর চোখে তখন আশ্চর্য বিষণ্ণতা। তবে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের মুহূর্তটি আরেকটু বিলম্বিত হলো। কারণ প্রথম দফায় দলিলে সই করতে গিয়ে নিয়াজীর হাত কেঁপে গেলো, কলম থেকে বেরুলো না কোনো কালি। মেজর হায়দারের পেছন থেকে কেউ একজন তখন এগিয়ে দিলো আরেকটি কলম। টাইগার উপাধির মিথ্যা গরিমায় অবসান ঘটিয়ে- ‘স্থলযুদ্ধে বিশ্বসেরা’ পাকিস্তানি মিলিটারির যথার্থ প্রতীক- নিয়াজী নতমুখে সাক্ষর করলেন দলিলে।
বিকাল তখন চারটা বেজে একত্রিশ।
বনেটে লেখা চিরকুট দিয়ে শুরু হয়েছিলো যে দিনটি, যে দিনটা প্রত্যক্ষ করলো অজস্র মুক্তিযোদ্ধার সদম্ভ স্পর্ধার প্রতীক বজ্র নামের ক্ষ্যাপাটে যুবকটির চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য, যে দিনের শেষ প্রান্তে রেসকোর্সের দলিলে কয়েকটি সাক্ষর ইতিহাসের পাতায় নিয়ে গেলো দ্বি-জাতি তত্ত্বকে; সেই প্রাথমিক কুয়াশাচ্ছন্ন দিনটি শেষ পর্যন্ত চিরদিনের জন্যে হয়ে গেলো বাংলাদেশের।
কত প্রহেলিকা সর্বত্র। মায়ের অলিন্দে আশা আশঙ্কার দোলাচল, পিতার নিলয় কাতর প্রতিশোধের নেশায়। ভাইয়ের এক হাত মুষ্টিবদ্ধ নতুন করে গড়বে বলে, বোনের অন্য হাত বধ্যভূমিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে স্বজনের লাশ। এক চোখে ভবিষ্যতের অগণিত সব স্বপ্নের কথা ভেবে জল, অন্য চোখে অজস্র সব মৃত্যুক্ষতি প্রত্যক্ষ করে পানি। বুকে অজস্র গল্প নিয়ে ঘুরছে প্রতিটি মানুষ, একটি মাত্র জনপদে ভর করেছে সম্ভাব্য সমস্ত মানবীয় অনুভূতির উপন্যাস।
চারপাশে রুক্ষ সব ধ্বংসপাহাড়, এর মাঝে আশার উর্বর উপত্যকা নিয়ে সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ।
[ ** লেখকের উপন্যাস ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ থেকে]
Leave a Reply