১০ ডিসেম্বর, ২০১৯
ইসমাইল কাদারে বলে গেলেন কোথাও, প্রতিটি বৃহৎ ইমারত বহন করে কোনো বৃহৎ অপরাধের সাক্ষ্য।
চারশো বছরের রাজধানী শহরে অন্ধকার নেমে এলে দানবীয় সব ইমারতের দিকে আমরা ফিরে তাকাই ক্যানো, সেই সব অপরাধের কোনো ফসিলের সন্ধান পাবো বলে? স্টাডি ইন স্কারলেটের মতো ঘোরগ্রস্ত কোনো অপরাধী কি এইসব দালানের গায়ে ভিনদেশি ভাষায় লিখে যাবে ‘প্রতিশোধ’ শব্দটা? ভাবতে ভাবতে বাসের সামনে ঝাঁপ দেয়ার সুযোগটা ফসকে যায়।
সুযোগ পেয়ে আরও ভার চাপায় সালমা এন্ড সায়েমা স্টোরের সাইনবোর্ড, আর আমার সন্তান মাদকাসক্ত নাকি- দেয়াল লিখনের সেই প্রশ্ন। শীতকাল আমাদের শহরে কখনো প্রশ্ন করেনি অবনী বাড়ি আছে কি না। ভাবনার উপরিতল থেকেই মুরাকামির মতো আমাদের স্পর্শ করে ফিরে গেছে ন ডরাই, মণীন্দ্র গুপ্তের হলদে জামার রোদ হয়ে ধর্ষিতা মেয়েটি গেছে দূরে সরে কোথাও, বিপিএলের উদ্বোধন দেখতে দেখতে স্বৈরাচারের জন্য শোক প্রকাশ করে গণতন্ত্র। ‘এই বিজয়ের মাসে আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি ভাইসব!’, বলতে গিয়ে ‘রক্ত’ শব্দটার ওপর মাইকের বক্তা একটু ওজন চাপায়।
প্রতিটি দীর্ঘ উপন্যাস পড়া শেষ হয়ে গেলে পাঠকের ঠিক ততটাই রিক্ত লাগে, যতটা রিক্ত মেগাবাইটের ভিস্যুয়াল যুগে বোধ হয় টিভি সিরিজের দর্শকের। আইরিশম্যান ফুরিয়ে গেলো তো একটু করে জিম জারমুশেও উঁকি মারা যায়, প্যাটারসন লোকটাকে তখন মনে হয় জীবনানন্দ কিংবা ফার্নান্দো পেসোয়ার মতোই। বিশ্রি হর্নের যানজট নয়, অফিসের ইঁদুর দৌড় নয়, আরো কোনো বিপন্ন বিস্ময় আমাদের রক্তের ভেতরে তখন খেলা করে।
ইসমাইল কাদারে কখনো বলে যায়নি, কিন্তু আমরা জানি, প্রতিটি বৃহৎ আদর্শের পেছনে লুকিয়ে থাকেন একজন সামান্য মানুষ। আমরা জানি, সামান্য হতে পারে ঠিক, কিন্তু মৃত্যুতেও- নিজের বা সন্তানের- কিছু কিছু মানুষ অজয়।
২১ নভেম্বর, ২০১৯
দূরে বুলবুলের মেঘলা আকাশ, অন্ধকার হয়ে আসা শীতের দিন। অগ্রীম ডিউটি দিতে বেরিয়ে সোনারগাঁয়ের সুদৃশ্য কিন্তু অন্ধকার জানালাগুলোয় টর্চ মেরে যায় দারোয়ান চাঁদ মামা।
এই দোকানে ছোলাবুট মিলবে নাকি, বান্ধবীর কাঁধ টিপতে টিপতে এক যুবক সে কথা জানতে চায় বন্ধু জুয়েলের কাছে।
মিশেল ফুকো যেন ভাইভার এক্সটার্নাল, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন, হোয়াট ইজ অ্যান অথর?
‘ভাইসব, আমরা জানি যে নূর হোসেন ছিলেন একজন ইয়াবাখোর…’ বলতে গিয়ে বক্তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে।
খাচ্ছেদাচ্ছে গান বাজাচ্ছে রোদ্দুর রয় আর মিথিলা আর তাহসান।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে অফিস ফেরতা তারাপদ রায় বড্ড হতাশ। ‘এই কী জীবন, কালীদা?’
মাঠের সবুজে গড়াগড়ি খায় সাকিব গতিদানব রোহিত শর্মা, আর ফেসবুকে রাজত্ব জব্বার কাগুর।
কোথাও মানুষের চরিত্র নেই বলে দস্তয়েভস্কি হতাশ এবং শহরে আসেন না অনেকদিন।
নবনীতা দেবসেন পালালেন, তিনি আসেননি বলে লিট ফেস্ট নিয়েও লোকে অনুরক্ত, বিরক্ত, ত্যাক্ত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া গেছে উস্কানি, জাস্টিস লীগ চলে আসবে যে কোনো সময়, আপাতত কোথায় যেন ছাত্র পিটিয়ে সুখ করে নিচ্ছে ঠোলারা।
চিৎকার করতে করতে হুমায়ূন আজাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরে, ‘বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে আগুন নেভানো হয়েছিলো বলে ইস্কুল, পৌরসভা, রাষ্ট্র ও সভ্যতার কোনো ক্ষতি হয় নাই।’
দূরে বুলবুলের মেঘলা আকাশ, অন্ধকার হয়ে আসা শীতের দিন। সোনারগাঁয়ের সুদৃশ্য কিন্তু অন্ধকার জানালায় চাঁদের আলো, সুহান সেই ম্যাজিক একলা দ্যাখে।
১১ জুলাই, ২০১৯
নির্মীয়মাণ রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটু সামনে দাশুরিয়ার মোড়ে তিনশো মিটার এবং দেড়ঘণ্টা ব্যাপী যানজটটির ধকল সামলাতে বাকিটা রাস্তা লিওনার্দ কোহেনকে সহযাত্রী করতেই হয়। সকলেই জানে, যুদ্ধ এখন শেষ; সকলেরই জানা, ভালো মানুষেরা হেরে গেছে।
এরপর জাফরুল্লাহ শরাফতদের গলার স্বরে সবই চাপা পড়ে কিছুক্ষণ। নিউজিল্যান্ডের জয়ে রেডিও বক্তারা এমন খুশি; যে হারুপাট্টিকে কখনো ভারত, কখনো ইন্ডিয়া, কখনো আবার গলাভারি করে টিম ইন্ডিয়া বলে ডাকতেও এদের আটকায় না। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়াই কি এখন বিশ্বের দখল নেবে?
কোহেনের অবশ্য এদিকে নজর নেই, সে চায় বার্লিন কব্জা করে নিতে। হাম্বানটোটার বন্দর কব্জা করে চীন এখন হাত বাড়াচ্ছে আফ্রিকায়, ঋণের দায়ে জর্জরিত পাকিস্তান, মায়ানমার কখন ফিরিয়ে নেবে ওয়াল্ডিংস রোহিঙ্গাদের? অজস্র প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। সকলেই জানে, জাহাজে পানি উঠছে; সকলেরই জানা, ক্যাপ্টেন মিথ্যা বলেছিলো।
সিরাজগঞ্জ এলো তো বৃষ্টির টুপটাপ। ঝুঁকি নিয়ে রোডরাশ খেলায় ব্যস্ত ড্রাইভার পেরোয় একের পর এক মালামালবাহী ট্রাক, তবু বর্ষার পানিতে চারপাশ ভরে ওঠা চরে আমাদের মনের সাথে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয় বিদ্যুৎ খুঁটি। তাকালেও কোহেনের বিখ্যাত নীল রেইনকোট চোখে আসে না কিছুতেই। বরং দেখি কাঁদছে সুজান, আমার দায়িত্ব তাকে ভালোবাসাহীনতার কথা জানানো, অথচ চোখ বন্ধ করে আমি তার সাথে আজও বেড়িয়ে পড়তে পারি।
আমার বেড়ানোর ইচ্ছা অনুমোদন না করে টাঙাইলের আকাশে নীলের সাথে ছাইয়ের সমস্ত সম্ভব শেড, ঝড় আসছে। নাকি পিচ্চি শিশুদের নিপীড়নের বিচার চেয়ে মায়াকান্না গাওয়া হোমপেজে ঝড় ইতোমধ্যেই এসে পড়েছে? সকলেই জানে, প্লেগ এসে পড়ছে; সকলেরই জানা, মহামারি ছড়িয়ে গেছে ।
২১ মে, ২০১৯
কারাগারের বন্দী দশায় সময়টা অপচয় না করে ইয়ূভাল নোয়াহ হারারি পড়ে নেয়া টিরিয়ন ল্যানিস্টার ‘মানুষকে এক করে গল্পের শক্তি!’ বাণী ঝেড়ে আলোড়নের সৃষ্টি করেন যখন, চেষ্টা করলে মানুষ তখন বুঝতে পারে, গত আট মৌসুমে তাদেরও একত্র করেছে গল্পের শক্তি।
শিল্পের কাজ কী? দ্বিতীয় কারো গল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা। ফলে বুড়ো মার্টিনের মোটকা সব উপন্যাসের হাত ধরে হাইস্প্যারোর সাথে মিত্রচুক্তির পরিণাম সংবেদনশীলদের অজানা থাকে না, আবার একদলীয় এবং চাপিয়ে দেয়া শাসনের পরিণামটাও মাদার অফ ড্রাগন ডেনেরিসের সাথে অনেকের জানা হয়ে যায়। তবে ‘থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং!’ আউড়ে গদোগদো হয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝে দলদাসপার্টিকে পর্যন্ত দেখে কৌতূহল হয়। ইতিহাস না হোক, টিভি সিরিজ থেকেও কি এরা শিক্ষাটা নেবে না?
কিন্তু দ্বিতীয় কারো গল্পকে মানুষের কাছে নিয়ে আসা শিল্পের মাত্র একটা দিক কেবল, শিল্পের অন্য দিকটা হলো, নিজের গল্পকেই অন্যের করে তোলা। আর আমরা জানি, সুবিধার দাসখতের বিনিময়ে আধিপত্যবাদীরা চিরকালই নিজের গল্পকে বসিয়ে দিয়েছে ভাষাহীনের মুখে। সরকারি প্রচারমাধ্যম যুগে যুগে গেয়ে গেছে শান্তির সুবাতাস, দিনের পর দিন অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানদের প্রচার করা হয়েছে যুদ্ধপ্রিয় হিসেবে, রাশান কি সার্বিয়ানদের দুনিয়াজোড়া দাঁড়িয়ে যাওয়া মাথা গরম ভাবমূর্তিও একইভাবে দীর্ঘদিনের প্রোপাগান্ডার ঠুকঠাক আর হলিউডি সিনেমার এক ঘা’র ফলাফল।
মানুষকে একত্র করে কাহিনির শক্তি, দিনে দিনে তাই ধর্ম বা জাতীয়তাবাদের ট্যাবলেট খাইয়ে তাদের বিস্মৃত করে দেয়া যায় অন্য কারো গল্প। ফলে পাহাড়ঘেরা জনপদে থাকে শুধু অন্ধকার, আর আধিপত্যবাদীর গল্পকে চাপিয়ে দেয়া আবেগে থরথর উপন্যাস আর বিজ্ঞাপণ। শিল্প মালটা বিজ্ঞানের মতোই, গড়ার পাশাপাশি ভাঙতেও সে ওস্তাদ।
পুড়ে যাওয়া কিংস ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে, নিজের গল্পকেই অন্যের করে তোলার আগে তাই, একবিংশ শতাব্দীর শিল্পীর রিভাইজ দিয়ে নিতে পারে স্পাইডারম্যান সিনেমাটাও। উইথ গ্রেইট নাম্বার অফ ফলোয়ারস, কামস গ্রেইট রেস্পন্সিবিলিটি। ড্রাগনের পিঠে চেপে ওই আপ্তবাক্য ভুলে বসলে মুশকিল, ব্রেকার অফ চেইন আর স্বৈরশাসকে তখন পার্থক্য আর থাকে না।
২৮ মার্চ, ২০১৯
জিনেদিন জিদানের মতো সর্বজয়ী ও চা’প্রেমী ম্যানেজারটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের ডাগআউটে শান্তি ফিরিয়ে আনলেন মৃদু হট্টগোল হলেও। মানবতার ডেস্টিনিওয়ালার পাশে নতুন মিডফিল্ডারটিকেও বুকে ঠাঁই পেতে দেখে ঝামেলায় পড়ে সুবিনয় মুস্তফীরা, একই সাথে বেঙ্গল টাইগার আর টাইগারের মুখে ধরা ছাগলকে হাসানোর ভুয়োদর্শী ক্ষমতা নিয়েও এরা বেশ চুপচাপ।
এসবের বাইরে বেস্টসেলার থাকে, চকবাজারের আগুন থাকে, বিমান ছিনতাই থাকে, ফাগুন হাওয়া থাকে। কিছুটা দূরত্ব রেখে পথ চলেন সেলিনা হোসেন, ‘আজি ভুসুকু বঙ্গালি ভইলী!’ দারুণ আক্ষেপমুখর ইতিহাস যাত্রায় যিনি প্রায়ই হাত ছেড়ে দিয়েছেন সহযাত্রীর। থাকে রামি মালেক, আত্মহত্যার অপরাধে লোকটা এমন ভেঙে পড়েছে যে তার অঙ্গ সঞ্চালনে বহুদিনের জন্য মনে রাখার মতো কিছু দেখা যায়। সুযোগ বুঝে ভিগো মর্টেনসেন উপদেশ ছাড়ে মাহেরশালা আলিকে, দুনিয়া প্রচুর ভীতু এবং একাকী লোকে ভরপুর। হারুকি মুরাকামি আবার পুরোটা সময় এই একলা সব মানুষের গল্পই বলে যান, যারা একাকী সব ক্যাফেতে বসে থাকে, যাদের হৃদয় আজ ঘাস।
শুধু একটি লোককে এই মাসে বড় গম্ভীর দেখায়। অগ্নিকান্ডের লাইভ ভিডিও, ম্রো পাড়ার জড়াজড়ি, শার্লকের শহরে বসে দরদাম করে তিরিশকে তিনে নামাতে চাওয়ার ফেরিওয়ালা, পরিবহন নিয়ে আবারো অজস্র পুনরাবৃত্তির কিলোবাইট প্রসব- এরা সকলেও মিলেও তার এরিনমোর তামাকের ধোঁয়াকে আজও ম্লান করতে পারেনি ঠিকই, তবু ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না!’ বলে হুমকি দেয়া তার স্বর ক্রমশ ঢেকে যায় লুটেরা দলদাস আর গ্রেগর সামসাদের গলির মোড়ের মাইকবাজিতে।