(১)
সমসাময়িক কোনো লেখকের মাথায় ঢোকার জন্য এমনকি দুই দশক আগেও পাঠকের রাস্তা ছিলো একমুখী। একজন লেখক কী ভাবছেন কোনো বিষয়ে, কী পর্যবেক্ষণ বা মতামত তার কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে- তা জানতে পাঠকেরা তখন নির্ভর করতেন উদ্দিষ্ট লেখকের লেখা বা বক্তব্যের ওপরেই কেবল। অনলাইনের উত্থান এখন কমিয়ে দিয়েছে পাঠকের সেই বাধা। পাঠকের জন্য পত্রিকা কি বইয়ের মোড়কে পেশ করা লেখা ছাড়াও লেখকরা আছেন ব্লগে, ফেসবুকে; সেখানে তারা জায়েদ খানের রোলেক্স থেকে আবরার হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় অক্লেশে মতামত প্রদান করেন নিয়মিত। আর এই দ্বিতীয় ধারার টেক্সটও পাঠকের মাথায় তৈরি করতে থাকে লেখকের দ্বিতীয় একটা সত্ত্বা। সমকালের লেখক এনামুল রেজাকে পড়তে গেলে ওই দ্বিতীয় সত্ত্বা কি কিছুটা ছায়া ফেলে পাঠকের মনে?
আড্ডার টেবিল কিংবা রিকশাযাত্রার সহচর হিসেবে এনামুল রেজার সাথে যে সম্পর্ক পাঠক সুহানের, সেটাকে চট করে দূরে সরানো গেলেও এনামুল রেজার ওই দ্বিতীয় সত্ত্বাটা তাকে বিব্রত করতেই থাকে। কারণ আর কিছু নয়, নিজের উপন্যাস ‘চায়ের কাপে সাঁতার’ লেখার যাত্রায় দীর্ঘদিন ধরে রেজা অনলাইনে ছিলেন দারুণ সরব। উপন্যাস রচনার বিভিন্ন পর্যায়ে তার অভিজ্ঞতা, উদ্দিষ্ট রচনার নানা টুকরো প্রসঙ্গ তিনি অনলাইনে আলাপ করেছেন মুহুর্মুহু। সেইসব ছায়া সরিয়ে রেখে পাঠকের পক্ষে কি সম্ভব হবে একেবারে দ্বিপ্রহরের মতো পরিষ্কার আলোতে তার দ্বিতীয় উপন্যাসকে আবিষ্কার করা?
দামড়া আয়তনের ব্যাপারটা বাদ দিলেও, প্রথম উপন্যাসের প্রায় অর্ধযুগ পরে প্রকাশিত এনামুল রেজার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চায়ের কাপে সাঁতার’ এভাবেই পরীক্ষার মুখে ফেলে দেয় পাঠককে।
(২)
রেজার উপন্যাসের বর্ণনা অবশ্য শুরু থেকেই দারুণ সড়গড়, পাঠককে তা পরীক্ষায় ফেলে না মোটেও। চোখকে সেটা দ্রুত টেনে নেয় এক বাক্য থেকে আরেক বাক্যে। সরল একটা গদ্যভাষা বেছে নিয়ে রেজা যেন – অনেকটা সযতনে- এড়িয়ে চলেন ভাষার ব্যাপারে উচ্চাভিলাষ।
কিছুক্ষণ এগোতেই ধরা পড়ে, সেই সরল ভাষার ছদ্মবেশে রেজা একটা ক্যালাইডোস্কোপ ধরেছেন পাঠকের সামনে। কাহিনীর নামহীন এক কথকের মুখে পাঠক শুনতে থাকে ভিক্ষুক কানা নেজামের গালিগালাজ কিংবা অসীম সরকারের ছড়া কেটে কথা বলা; দেখতে পায় লীলা মজুমদারের কাম জাগানো পিঠ থেকে ধূলায় ঢেকে থাকা ডাটসান ব্লু-বার্ড গাড়ি।
আরব্য রজনীর শেহেরজাদের মতোই ‘ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা’য়, কাহিনীর নামহীন কথক বুনে যায় একের পর এক গল্প। সেইসব গল্পের ভেতরে হাজিরা দিয়ে যায় ফরেস্ট অফিসার থেকে পিয়াল বণিকের মতো এমন অজস্র আরও চরিত্র, যাদের আপাত কোনো প্রয়োজন ছিলো না। খানিকক্ষণ সতর্ক ভঙ্গীতে সেই সব গল্পকে অনুসরণ করার এক পর্যায়ে পাঠক বুঝতে পারে, এই উপন্যাস পড়তে হলে সদাসতর্ক স্নায়ূর বদলে তার দরকার শিথিল সংবেদন; দরকার- রেজার বয়ানের সাথে গা ভাসিয়ে দেওয়া। ঠিক যেমনটা করতে হয় হারুকি মুরাকামিকে পড়ার সময়।
সত্যি বলতে, মুরাকামিকে এমন মনে করানো কেবল একবারই ঘটে না ‘চায়ের কাপে সাঁতার’ পড়তে গেলে। এনামুল রেজার উপন্যাসের চরিত্র যখন নেসার গাজীর অন্ধকারাচ্ছন্ন হোটেলের বেজমেন্ট থেকে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে কোনো অলৌকিক সিঁড়ির ওপরের জগতে, পাঠকের তখন আবারও মনে পড়ে ব্যাখ্যা ছাড়াই মুরাকামির চরিত্রের কুয়োর ভেতর থেকে কোনো হোটেল রুমে চলে যাওয়ার কথা।
কিন্তু এসব উদাহরণ বড্ড পলকা। পাঠক যখন অনুভব করে যে রেজা মুরাকামিকে অনুসরণ করছেন আরও বৃহদার্থে; জগতকে তিনি বর্ণনা করছেন বাস্তব এবং অলৌকিকতা একত্রে ধারণক্ষম এক পাত্র হিসেবে, আর গন্তব্যের বদলে তিনি বরং একটা যাত্রার অনুভূতিই দিতে চাচ্ছেন পাঠককে- কেবল তখনই সত্যিকার অর্থে রেজা স্পর্শ করেন পাঠকের মন।
বলতেই হবে, অনুভব করানোর এই দারুণ জটিল কাজটা রেজা সম্পাদনা করেছেন দুর্দান্ত দক্ষতায়।
(৩)
‘চায়ের কাপে সাঁতার’ উপন্যাসের জগত মুরাকামি ঘরানার অস্বচ্ছ, কিন্তু সেই জগতের মানচিত্র আমাদের ইলিয়াস বা শহীদুল জহিরের মতোই স্পষ্ট। শহরের নাম যতই মায়ানগর আর পশোহর হোক, পাঠক বুঝে যায়- এই জনপদ তার অতিপরিচিত।
সেই চিরচেনা জনপদেই দক্ষ ক্যালাইডোস্কোপিক বর্ণনায় উদ্দিষ্ট উপন্যাসে কাহিনি এগোয় একাধিক সময়রেখায়। কোনো সময়রেখায় থাকে কথক আর তার বর্তমান, কোনো সময়রেখায় থাকে মফস্বল ছেড়ে মায়ানগর শহরে কথকের জায়গা করে নেবার দিনগুলো, আবার কোনো সময়রেখায় থাকে রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধের দিনগুলোর আগে-পরে বিনয় মজুমদারের দিনকাল। কখনো ফোরশ্যাডোয়িং, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতীতচারণের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে উপন্যাসের মূল গল্প।
আর এগিয়ে চলে চক্রপূরণ। লাইব্রেরি থেকে বিনয় মজমুদারের মেরে দেওয়া গ্যুন্টার গ্রাস ফিরে ফিরে আসেন গল্পের নামহীন কথকের মেরে দেওয়া জুলভার্নের বইটার হাত ধরে। লাশ চোরদের আটকে ফেলার গল্প আরেক প্রজন্মের কাছে রিলেটেবল হয়ে ওঠে ষাঁড় চুরি আটকে দেওয়ার স্মৃতির ঘটনায়। গতকাল যা ঘটেছে- মায়ানগর এবং পৃথিবীতে- আজ তা ঘটে চলে আবার।
(৪)
বহু কথা বলা হলো, তবু কি কিছু বলা গেলো ‘চায়ের কাপে সাঁতার’ নিয়ে? ঠিক কী নিয়ে লেখা এই উপন্যাস?
উত্তর খুঁজে নিতে, পাঠককে তাই উদাহরণের জন্য হাত বাড়াতে হয় পপ-কালচার জগতের অন্য আরেক ঘরে।
খেয়াল থাকতে পারে অনেকের, বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নামের এক দীর্ঘ ধারাবাহিক বেশ আলোচিত হয়ে উঠেছিলো কয়েক বছর আগে। সেই নাটক থেকে প্রাপ্ত তুমুল তারকাখ্যাতি নিয়ে কোনো কোনো অভিনেতা পরে জায়গা করে নিয়েছেন অন্যান্য টিভি/ইউটিউব নাটকেও। মোটা চশমার সমালোচকেরা এই নাটক নিয়ে কথা বলেছেন, তেমনটি দেখিনি কোথাও। তবু যে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ এমন তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, বোধ করি- তার অনেকগুলো কারণের একটা মুখ্য কারণ ছিলোঃ এমন একদল মানুষের- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের-গল্প বলা হয়েছে সেখানে, যাদের বাস্তবতা আগে কোনো শিল্পমাধ্যমে আমাদের সামনে আসেনি।
হ্যাঁ, নামজাদা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়দের বাদ রেখেই রাজধানী ঢাকা শহরে মাথা তুলে আছে বহু মাঝারি বা নিম্নমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল ধনীর সন্তানেরাই পড়তে যায় ওসব বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই ধারণা ভুল করে বহুদিন ধরেই শহর, মফস্বল- এমনকি গ্রামেরও- মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও পড়ছে ওখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে রাজধানীতে আসা মফস্বল বা গ্রামের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত এই বিশাল সংখ্যাক তরুণের যে নানাবিধ সংকট, আমার পর্যবেক্ষণ বলে ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ই সেটা প্রথমবার সার্থকভাবে – কিছুটা স্থূল হাস্যরস দিয়ে হলেও- তুলে এনেছে টিভির পর্দায়। টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে নাটকের দুর্দান্ত জনপ্রিয়তার কারণ সেটাই।
এনামুল রেজার ‘চায়ের কাপে সাঁতার‘কে মোটা দাগে বলতে পারি সেই গোত্রের মানুষদের জীবনের একটা পর্যায়কে অক্ষরে ধরে ফেলা- অবশ্যই ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘স্থূল রসিকতা’র মতো চলকগুলোকে সরিয়ে নিয়ে।
যাদুর শহর ঢাকায় অবিরাম উপস্থিত হচ্ছে মফস্বলের হাজারো যুবক। বাস, ট্রেন বা লঞ্চে চেপে ঘোরলাগা কোনো এক ভোর বা সন্ধ্যায় তারা ছেড়ে আসছে চিন্তাগ্রস্ত বাবা ও সর্বংসহা মা’কে। তারা পেছনে ফেলে যাচ্ছে সন্ধ্যা নামলেই অলৌকিকের ছায়া পড়া সেইসব খেলার মাঠ, ফেলে যাচ্ছে নিজ গ্রামের একান্ত সব লোককথা। আর ফেলে যাচ্ছে ১৯৭১ এর লোকজ স্মৃতি।
এবং তারপর বুকপকেটের রুমালে বেধে রাখা যুবকের সেইসব স্মৃতি জারিত হচ্ছে রাজধানীর জটিল মিথস্ক্রিয়ায়। বয়েসী অথচ লোভনীয় ঢাকার শয্যাসঙ্গী হতে চাইছে সে লীলা মজুমদারের মতোই। অথচ মেসবাড়ির গণরুমে কাটানো তার রাতগুলোকে বিব্রত করছে বৃহত্তর পৃথিবীর আরও কত হাতছানি। গলে যাচ্ছে আর্কটিকের বরফ, ইউটিউব ছাড়লেই পাওয়া যাচ্ছে ন্যান্সি সিনাত্রা আর রাস্তায় নামলেই ঘটে যাচ্ছে বিডিআর বিদ্রোহ। জাদুবাস্তব এই শহরে যুবক কোথায় খুঁজে পাবে নিজেকে?
‘অপরাজিত’ সিন্ড্রোম-ভারাক্রান্ত এসব প্রশ্ন আজকের নয়। বিভূতিভূষণ থেকে এনামুল রেজা পর্যন্ত অজস্র মানুষের এইসব বেদনা বুড়ো পৃথিবী দেখে আসছে চক্রাকারে। সময়ের সেই চক্রাকার বেদনাই ‘চায়ের কাপে সাঁতার’-এর ভরকেন্দ্র।
(৫)
কোনো অপ্রাপ্তি কি নেই উদ্দিষ্ট উপন্যাসে? অবশ্যই আছে। ভাষার উচ্চাভিলাষের অভাবের কথা তো শুরুতেই বললাম, পার্শ্ব-গল্পগুলোর কাহিনিও একটা পর্যায়ে আর সুলিখিত বলে মনে হয়নি ‘চায়ের কাপে সাঁতার’-এ। খুঁজলে আরও অপ্রাপ্তি পাওয়া যাবে, হাতেগোণা কিছু উপন্যাস ছাড়া সব উপন্যাসেই যেমন তা পাওয়া যায়।
কিন্তু পাঠকের প্রাপ্তিটাই অনেক বেশি। পাঠক হিসেবে নতুন ঘরানার যে বাংলা উপন্যাস প্রত্যাশা করি একবিংশ শতাব্দীর প্রায় সিকিপথ পেরিয়ে প্রায়, উদ্দিষ্ট উপন্যাস সেটার চাহিদা বেশ ভালোমতো মেটায়।
ঔপন্যাসিকের নিজস্ব স্বর খুঁজে পাওয়াটা সময়ের ব্যাপার, জানি। ‘চায়ের কাপে সাঁতার’-এ যে চমৎকার আর নতুন স্বরের আভাস, অনলাইনের অস্থিরতাকে পাশ কাটিয়ে এনামুল রেজা সেই স্বরকে নিজের ট্রেডমার্ক করে ফেলতে পারলেন কি না, তা দেখার জন্য পাঠকের তাই অধীর আগ্রহ থাকলো।
[ডিসেম্বর, ২০২৩]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply