
(১)
কুটি কবিরাজ কে?
পোশাকি পরিচয় দিতে গেলে, লোকটার নাম মীর্জা শিপিহর আলি। আয়ূর্বেদিক শাস্ত্রে পন্ডিত বাপের ছিলো কবিরাজি ব্যবসা, মাইনর পর্যন্ত পড়ে শিপিহর সেখানেই ঢুকে গেলো। তারপর কবিরাজি ব্যবসায় সাফল্য। কখনো সিলেটের করিমগঞ্জ, কখনো শিলং, কখনো বীরভূমের সীতাবাড়িতে তার চেম্বার।
কিন্তু বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে মানুষটার জীবন যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, তার কারণ নিশ্চিতভাবেই শিপিহরের পেশাগত জীবন নয়। লোকে বরং তার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে, যখন দীর্ঘ বিরতির পর ‘কুটি’ ডাকনামের ওই কবিরাজ হঠাৎ চিঠি পাঠায় বন্ধু তুলুকে, আর জানায়ঃ দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ছায়ার মতো অনুসরণ করে অবশেষে জামশেদ মুস্তফিকে কব্জায় পেয়েছে সে!
তুলু’র পোশাকি নাম কর্নেল (অবঃ) গোলাম আহমেদ মুনতাসির হায়দার। কুটির বাল্যবন্ধু এই মানুষটি মিলিটারি সার্ভিসে ছিলেন, অবসর নিয়েছেন সময়ের আগে। যৌবনের শুরুতেই কুটি কবিরাজের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর বন্ধুকে তিনি ফিরে পেলেন ওই জামশেদ মুস্তফির ঘটনায়। আর তারপর, কুটি-কবিরাজের এক-একটা ‘অতীব বিচিত্র ঘটনা’ ভরপুর অভিযান পাঠকের কাছে এসে পৌঁছালো ঐ তুলুরই জবান এবং ডায়েরির মাধ্যমে।
ষাটোর্ধ্ব এই দুই বুড়োর অদ্ভূত সব কাণ্ড-কারখানার সাথে আছে ধনফকীর লেনে তুলুর হেল্পিং-হ্যান্ড শিশু মিয়া, আছে কবিরাজের বাংলো ‘নির্জন’এর খানসামা ওয়াসেক। আর আছে পাহাড়। জাফলং-এর খাসিয়া পল্লী অথবা কুমপাহাড়, চেনা মানচিত্রের ডিব্রুগড় কি অচেনা কল্পনার জনপদ অরুণাকোটের রহস্যমাখা নির্জনতা- তারাও চরিত্র হয়ে উপস্থিত থাকে প্রায় প্রত্যেকটি কুটি-কবিরাজ অভিযানে। এসব নিয়েই আবদুল হাই মিনারের ‘কুটি-কবিরাজ ইউনিভার্স’।
(২)
আবদুল হাই মিনারের নাম প্রথম শুনি অনলাইনে, নস্টালজিয়া মাখা স্বরে- অগ্রজ পাঠকদের কাছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘শিশু’ নামের ওই পত্রিকায় নাকি পর পর তিনটি সংখ্যায় বেরিয়েছিলো তিনটি কিশোর উপন্যাস। হুমায়ূন আহমেদ আর হুমায়ূন আজাদের মাঝেও আলাদা করা গিয়েছিলো আবদুল হাই মিনারকে। জেনেছিলাম, তার ‘নীল দরজার রহস্য’ নামের উপন্যাসিকাটি সে যুগে যথেষ্টর চাইতেও বেশি সাড়া ফেলেছিলো আগ্রহী পাঠকদের মাঝে।
আশি ও নব্বইয়ের পাঁড় সেবা প্রকাশনীর ভক্তদের কাছে জানতে পাই মিনারের আরও একটি বইয়ের নাম, ‘জামশেদ মুস্তফির হাড়’। লক্ষ করি, বাজারে না থাকা ওই গল্প-সংকলনের কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো আবেগমথিত হয়ে পড়ছেন পরিচিত কিছু পাঠক। তাদের মুখে আবদুল হাই মিনারের প্রশংসা শুনে ধারণা করতে থাকি, যুগের চাইতে লেখক হিসেবে বেশ এগিয়েই ছিলেন তিনি।
প্রতিচ্ছবি প্রকাশনী নতুন করে সেই আবদুল হাই মিনারের দুটি গল্প সংকলন প্রকাশ করেছে, খবরটা দেখেছিলাম। ইচ্ছেও ছিল, তবু কী করে যেন দেরি হয়ে গেলো ‘কুটি-কবিরাজ সমগ্র ০১’ আর ‘শকুন ও অন্য রোমাঞ্চ’ নামের বই দুটো যোগাড় করতে। হালকা চালের বই দুটো কয়েকদিন ধরে পড়ে শেষ করার পর ভাবি; বাংলাদেশের সাহিত্যে চরিত্রকে কেন্দ্র করে একাধিক অতিপ্রাকৃত গল্পের উদাহরণ যেহেতু কম, কয়েক লাইন তাই লিখেই ফেলি কুটি-কবিরাজকে নিয়ে।
দীর্ঘদিন নাম শুনে আসা কুটি-কবিরাজের সাথে সাক্ষাতের পর পাঠকের মনের দশা কেমন হলো, এলোমেলো এই লেখা তাই চেষ্টা করবে সেটাকেই অনুসন্ধানের।
(৩)
কুটি-কবিরাজের গল্পগুলো ঘুরপাক খায় কলবিজ্ঞান আর ব্যাখ্যাহীন অতিপ্রাকৃত কাহিনির মাঝের এক জগতে।
অভিযানের ধরন ও বিস্তারের তুলনা করলে শীর্ষেন্দুর ‘অদ্ভূতুড়ে’ সিরিজের সাথে কুটির গল্পরা বেশ তুলনীয়। ভূতেরা যেমন মানুষের আশেপাশে রীতিমতো হাসির যোগান দিয়ে ঘুরে বেড়ায় শীর্ষেন্দুর কলমে, আবদুল হাই মিনারের জগতেও তেমন হরদম দেখা মেলে ‘মানুষ নয়, অন্য কিছু!’ ঘরানার কিছুর।
কুটি-কবিরাজের জগতে একটা বড় ভূমিকা রাখে প্রকৃতি, সেটার কথা আগেই বলেছি। চা বাগানে বাতাসের জিফিল সুর, পাহাড়ি জনপদের মানুষ আর উত্তর সিলেটের প্রকৃতিকে এতো তীব্রভাবে বাংলাদেশি আর কোনো লেখকের রচনাতেই উপস্থিত দেখিনি।
খাবারের বর্ণনা এলে অবশ্য কুটি-কবিরাজ আর তুলু স্মরণ করায় রীতিমতো টেনিদাকে। দুই বন্ধু রীতিমতো বুড়ো, কিন্তু নোলা তাদের সাংঘাতিক। অভিযানের মাঝের সময়টায় শিশু মিয়া আর ওয়াসেক মিয়ার হাতে নানা পদের রান্না খেতে তাদের একটুও আপত্তি হয় না।
তবে এসব বাইরের আবরণ সরিয়ে যদি ভেতরের দিকে মন দেই, কুটির গল্পগুলোকে- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই- মনে হয় কিছুটা পুরোনো হয়ে যাওয়া।
নিশ্চিত করা দরকার, গল্পের পুরোনো হয়ে যাওয়া বলতে এখানে মোটেও সেটার প্রাচীনতার দিকে নির্দেশ করা হচ্ছে না। উদাহরণ হিসেবে তারানাথ তান্ত্রিকের গল্পগুলোর কথা বলতে পারি। ঢের আগে লেখা হলেও গল্পগুলো পড়তে এখনো বেশ চমৎকার, গোছালো বোধ হয়। অথচ ঘরানায় বেশ কাছাকাছি হলেও কুটি-কবিরাজের গল্পগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই পড়তে গিয়ে আটকাতে হয় সেটার অগোছালো লেখার ধরনের জন্য। লেখক যেন খুব দ্রুত তার মূল কাহিনিকে শেষ করতে উদগ্রীব। গল্পের মূল মোচড়ের দিকে রীতিমতো টর্চ মেরে তিনি ইশারা করেন কখনো কাহিনির শুরুতে, কখনো বা মাঝে। কিন্তু যে কল্পনা-ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে গল্পগুলো, দেশ-বিদেশের নানা ধরনের কাহিনিতে সেগুলো এতোবার ব্যবহৃত হয়েছে, লেখা একটু অপ্রস্তুত হলেই সেটা পাঠকের কাছে হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর।
দীর্ঘদিন ধরে বিরতি নিয়ে নিয়ে কুটি-কবিরাজের গল্পগুলো লিখেছেন মিনার। ফলে যা হয়েছে, কোথাও কোথাও যেন যুক্তি মিলতে চায় না তার ওই ‘ইউনিভার্সে’। সময় পরিভ্রমণ করে কুটি আর তুলু নিজের জগতে ফিরে এসে আবিষ্কার করে বিশ বছর কেটে গেছে, বুড়ো হয়ে গেছে বাজারের চায়ের দোকানের লোকগুলো। অথচ পরের গল্পগুলোতেও আমরা কবিরাজের পাচক ওয়াসেক মিয়ার বয়েসের কোনো তারতম্য দেখি না। আরও পরের এক গল্পে মুঠোফোনের প্রসঙ্গ আসে, অথচ সেই সময়ের সাথে ঠিক খাপ খায় না কেন্দ্রীয় চরিত্রদের আচরণ।
একটু কঠোর করে বলতে গেলে তাই বলবো, কুটি-কবিরাজের অধিকাংশ কাহিনিকে মনে হয় অসম্পাদিত। আক্ষেপ হয়, খানিক পুনর্লিখন করে কেন যে নিরেট গল্পটা বের করলেন না আবদুল হাই মিনার!
(৪)
নানারকম খামতি আছে ঠিক, কিন্তু ওসব হিসাব বাদ দিয়ে একবার যদি মন বসানো যায় কুটি কবিরাজের জগতে, শুধু গল্পের টানেই সময় কাটে চমৎকার।
ছুটি কাটাতে ট্রেনে করে শহর ছাড়ার সময় নিরুদ্বিগ্ন মনে যেমন পড়তাম রহস্য-পত্রিকা, ঠিক সেই স্বাদটা ফিরিয়ে দিলো গল্পগুলো। ‘জামশেদ মুস্তফির হাড়’ তো রীতিমতো কিংবদন্তী হয়ে গেছে, আলাদা করে বলতে হবে ‘বাদুড়’, ‘বালক-রহস্য’, ‘কে?’, ‘ঘূর্ণি হাওয়ার রহস্য’, ‘পুরোনো বাড়ির রহস্য’ গল্পগুলোর কথাও। বিশেষ করে করে গল্পের আকার যেখানে একটু দীর্ঘ হয়েছে, সেখানে যেন ভালো লাগাটা খানিক বেশিই জমে ।
শুধু ওই অগোছালো ভাবটাই মনে খচখচ করে পড়া শেষ হয়ে গেলে। মনে হতে থাকে, হাই মিনার যদি কিছু সময় নিয়ে আবার হাত বোলাতেন গল্পগুলোয়, কুটির কাহিনিগুলো উনলৌকিক গল্পপ্রেমীদের জন্য অবশ্য-পাঠ্য হয়ে উঠতো তখন।
‘কুটি-কবিরাজ সমগ্র ০১’ আর ‘শকুন ও অন্য রোমাঞ্চ’ নামের বই দুটোর সম্পাদনায় প্রতিচ্ছবি প্রকাশনী আরও যত্নবান হতে পারতো। পৃষ্ঠা বিন্যাস, দামড়া ফন্টের মাঝে অনিয়মিত সব ফাঁকা জায়গা পাঠকের বিরক্তি বাড়িয়েছে।
[নভেম্বর, ২০২৩]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply