যখনই তার কথা ভাবি, আমার মনে আসে শৈশবের কোনো এক বইমেলায় দেখা মানুষটার একটা চমৎকার পোস্টার।

বিশাল, দীর্ঘদেহী মানুষটাকে সিনেমা পরিচালকদের চিরচেনা ভঙ্গীতে দুই হাতের মাঝ দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে দেখেছিলাম আমি দেড় বাই এক হাতের সেই ছোট্ট পোস্টারে। সেই পোস্টার কেনা হয়ে ওঠেনি আমার কখনো। ঘরের দেয়ালে দেশ-বিদেশের অজস্র সিনেমার পোস্টারের পাশে লাগানোও হয়নি কোনোদিন। নানা ভঙ্গীমায় সেই মানুষটার আরো সব দারুণ সব পোস্টার আমি খুঁজে পেয়েছি পরে, নানা জায়গায়। কিন্তু কোনটাই মনে ধরেনি শৈশবের সেই এক পলকের জন্য  দেখা পোস্টারটার মতো।

ছেলেবেলা এক অদ্ভুত যাদুঘর। কেউ বলতে পারেনি, পারবে না; ছেলেবালার এক-একটা মুহুর্ত কী করে সারাজীবনের জন্য আমাদের তাড়া করে ফেরে। শৈশবের নায়কেরাও হয় ঠিক তেমনই। শৈশবের নায়ক, পোস্টারে বর্ণিত সেই মানুষটা, আমাকে তাই আজও তাড়া করে যাচ্ছেন তার দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওঠা ছায়া নিয়ে।

মানুষটা লিখতে জানতেন। নিরিবিলি গরমের ছুটির দুপুরে হঠাৎ করেই এক রেলস্টেশনে রতনবাবুর মাঝ দিয়ে নিজের দ্বিতীয় সত্ত্বার মুখে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিহারের উত্তরে সেই নাম ভুলে যাওয়া জায়গার ডাকবাংলোয় মিঃ শাসমলের শেষ রাতটা আমি আজও ভুলিনি, ভয়ে। অসমঞ্জবাবুর কুকুরটা ওই সাহেবের সামনে অমন করে হঠাৎ হেসে উঠেছিলো ক্যানো- সেটা বুঝে উঠতে গিয়েই যে আরো বড় একটা বিস্ময়ের ধাক্কা পেয়েছিলাম; জ্ঞানের কথার কচকচানি এড়িয়ে তিনি ছাড়া এমন সহজ করে সেটা আর কেউ দিতে পারতো বলে বোধহয় না।

মানুষটা আবার- তাঁরই ভাষায় বলতে গেলে- রহস্যের খাসমহলও বানাতেন অনায়াসে। ‘বিকাশবাবুর রেডিও, শশীবাবুর সিং, এক থেকে সাত, মগনলালের বজরা আর আফ্রিকার রাজা।’ এইসব বলে কয়ে মাথার ভেতর গোলমেলে প্রচুর প্যাঁচ লাগাতেন তিনি। ‘দ্যা সার্কাস হুইচ এস্কেপড ফ্রম দি গ্রেট ম্যাজেস্টিক টাইগার …’ জাতীয় বর্ণনার গুণে টানটান রহস্যের মাঝেই যেমন হেসে নিতাম খুব করে, যেমন গুণগুণ করতাম ‘যব ছোড় চালে লখনৌ নগ্‌রী’ বলে- ঠিক তেমনি দিনেদুপুরে খাস কলকাতার বুকে বসে গোরস্থানে তপেশের দাদার সঙ্গে হারিয়ে যেতাম পেরিগাল রিপিটার রহস্যে।

মানুষটার কল্পনার দৌড় ছিলো। পোষা বেড়ালের হাতের থাবায় সৌরজগৎ এর ক্ষুদ্রতম গ্রহ ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা অবাক করে। পৃথিবী দখলের স্বপ্নে বিভোর মৃত্যুঞ্জয়ী আলেকজান্ডার অ্যালয়সিয়াস ক্রাগ যখন নিজ দূর্গে হেরে যায় এথেন্সের এক সাধারণ পকেটমারের কাছে, উত্তেজনার উন্মাদনায় শীতের রাতে আমার কম্বল ছিটকে পড়ে তখন। মানস সরোবরের ওপারে এক আশ্চর্য কল্পনার জগৎ দেখতে গিয়ে বিস্ময়ে আমার স্কুল বিকেলে ফুটবলে লাথি মারা পর্যন্ত হয় না।

মানুষটা ছবিও আঁকতে পারতেন দারুণ। স্কেচের আশ্চর্য আলোছায়ায় ফুটিয়ে তুলতেন টিপুর বন্ধু গোলাপীবাবু কি জটাধারী নকল সন্যাসীদের। তারিণীখুড়োর ক্রিকেট ম্যাচ আর ভোজরাজের কঙ্কালের ঘাড়ে চেপে বসার দৃশ্যও ভুলবার নয়। কপালের বামদিকে সিঁথি নিয়ে চারমিনারে টান দিচ্ছেন প্রদোষ মিত্তির আর মক্কেলের পাশে বসে উত্তেজিত লালমোহন গাঙ্গুলী, সেই ছবি তো বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রহস্যোপন্যসের ট্রেডমার্কই হয়ে গেছে !

শেষ হয়েও যা শেষ কথা নয়, মানুষটা সেলুলয়েডের ফিতার টানে স্বপ্ন দেখাতে পারতেন। ‘জলসাঘর’ এর বিশ্বম্ভর রায়ের রুপে ছবি বিশ্বাস ছড়ি হাতে গান শুনবার দৃশ্যটা কল্পনা করুন। কিংবা ‘নায়ক’ সিনেমায় শর্মিলার সাথে বাতচিতের পর উত্তম কুমারের চোখে ঢেকে ফেলা সানগ্লাস। অথবা, সেই দৃশ্যটা, সরলতম বিস্ময়ে অপুর ছেলে চোখ বড় বড় করে জানতে চাইছে  ‘বাবা কাকে বলে?‘ এক-একটা দৃশ্য, তারা কথা বলে দিয়েছে এক হাজার একশো অনুভূতির। 

” He touched something & that turned into gold. “ চমৎকার এই কথাটা লেখা ছিলো আমার সেই ছেলেবেলায় না-কেনা পোস্টারে। বড় সত্য কথা। ছেলে ভোলানো মিডাসের রুপকথাকে বাস্তবে নামিয়ে এনেছিলেন মানুষটা, হাত দিয়েছেন যেখানে, আক্ষরিক অর্থেই হীরক রাজার খনির চেয়েও সুফলা করে তুলেছেন সেই ক্ষেত্রটি।

ফরেস্ট গাম্পের স্মৃতিতে থাকে না প্রথম কেনা জুতোর কথা, আমার মতোই। আমার মনে ঝাপসা হতে থাকে ফুটবলে প্রথম দেয়া গোল কিংবা অপরিচিত ক্লাস নাইনের নতুন স্কুল, প্রথম ঘন্টার ক্লাস। তবু সমস্ত কিছুর মাঝেও কয়েকটা স্মৃতি পুরনো হয় না। পুরনো হয়নি অসমঞ্জবাবুর ব্রাউনীর হাসি, পুরনো হয়নি শঙ্কুর হাতের অ্যানাইহিলিন গান, পুরনো হয়নি বাদশাহী আংটির লখনৌ অভিযান।

কখনো পুরনো না হওয়া শৈশবের এই অগণিত স্মৃতির পেছনের যে মানুষটা, গড়পারের রায় বাড়ির মানিক, সেই এক-অদ্বিতীয়- অতুলনীয় সত্যজিৎ রায়; তাঁর আজ জন্মদিন।

শুভ জন্মদিন ওস্তাদ। আমাদের সৌভাগ্য, আপনি পৃথিবীর মধুরতম ভাষায় লিখতেন।

[মে, ২০২০]