কিছু কিছু প্রসঙ্গের এমন গুণ, সংবেদনশীল মানুষের মনে তারা দ্যোতনা তুলবেই।
মায়ের কথা ধরা যাক। কিংবা ধরা যাক শৈশবের স্মৃতির কথা। এসব নিয়ে যদি বলতে বলা হয়—দেখা যাবে, ঘোরতর কর্কশ মানুষেরও মনের একটা কোমল অংশ বেরিয়ে আসছে। মা, কিংবা শৈশব, কিংবা প্রথম প্রেম—চাইলেও মানুষ এদের ব্যাপারে কঠোর হতে পারে না।
একই ব্যাপার খাটে চিঠির ক্ষেত্রেও। একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ কেটে যাওয়ার পর, ই-বার্তার মাধ্যমে মানুষ আজকাল প্রতিটি ক্ষণ সংযুক্ত অন্য কারো সাথে। তবু, যখনই কাগজে লেখা চিঠি পড়তে বসি আমরা, না চাইলেও হৃদয় খানিক দ্রবীভূত হয়ে যায় পাঠকের।
আজকের আলাপে থাকলো চিঠি-কে কেন্দ্র করে লেখা দুটো বই।
৮৪, চ্যারিং ক্রস রোড
বইপ্রেমী মাত্রই জানেন—ঠিক চিঠির মতোই– বই নিয়ে আলাপ করাটাও তাদের মনের কোনো একটা কোমল অংশ বের করে আনে। কোনো বই নিয়ে মনের ভেতরে যে অনুভূতি, বাইরের বিজ্ঞাপণ ভারাক্রান্ত দুনিয়ায় সেটাকে আজও কোনো ভাবে বাজারজাত করা যায়নি যেহেতু—বইয়ের আলাপ মানেই তাই বইপ্রেমীর কাছে বিশেষ কিছু।
ফলে, যে বইয়ের কেন্দ্রে রয়েছে বই আর চিঠির মতো অমন দুটো কোমল বিষয়, সেটাকে পড়তে বসার আগেই পাঠক মুখিয়ে থাকে পছন্দ করবার জন্য। ‘৮৪, চ্যারিং ক্রস রোড’ বইটাকও অনায়াসে জায়গা পায় এই গোত্রে।
বইয়ের ভেতরের ‘কাহিনি’তে আসি এবার।
নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা হেলেন হ্যানফ, ১৯৪৯ সালে পুরাতন কিছু বইয়ের সন্ধানে তিনি চিঠি লিখলেন লন্ডনের চ্যারিং ক্রস রোডের বইয়ের দোকান ‘মার্কস অ্যান্ড কোম্পানি’তে। দোকানের হয়ে হেলেনকে বই নিয়ে প্রত্যুত্তর দিলেন ফ্র্যাঙ্ক ডোয়েল। তারপর শুরু হলো পত্র-বিনিময়। কিছুদিনের মাঝেই বইয়ের সীমানা ছাড়িয়ে দু’জনের চিঠিগুলো হয়ে উঠলো আরও ব্যক্তিগত। চিঠির মাধ্যমেই ফ্র্যাঙ্কের স্ত্রী নোরা, তাদের প্রতিবেশী মিসেস বোল্টন, বইয়ের দোকানের সেসিল ফার—এরাও বন্ধু হয়ে উঠলেন হেলেনের। ফ্র্যাঙ্কের সাথে সাথে তাদেরকেও লিখলেন হেলেন, উপহার পাঠালেন ক্রিসমাস কি ইস্টার উপলক্ষে। কুড়ি বছর ধরে দুই পক্ষের বন্ধুত্ব এভাবেই স্রোত তুলে গেলো আটলান্টিকের দুই কূলে।
চিঠিগুলো পড়তে গেলে আবিষ্কার করা যায়, দ্বিমুখী এই পত্র-মিতালির গড়ে ওঠায় প্রধান ভূমিকা নিঃসন্দেহে হেলেনের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইংল্যান্ডের মানুষ তখন নির্ভর করছে সরকারি বরাদ্দ রেশনের ওপর। অমন একটা পরিস্থিতিতে সীমিত আয়ের মানুষ হয়েও হেলেন হ্যানফ স্ব-উদ্যোগে খাবার কি শীতের মোজা পাঠিয়ে গেছেন ‘মার্কস অ্যান্ড কোম্পানি’র কর্মচারীদের জন্য, তাদেরকে এমনকি চোখে না দেখেই! হেলেনের এমন অপার ভালোবাসাই ধীরে ধীরে উষ্ণ করে তোলে অপর পক্ষকে। ঘোরতর নিরস ইংরেজ ফ্র্যাঙ্ক পর্যন্ত একসময় পোশাকি সম্বোধন ছেড়ে বন্ধুকে ডাকতে শুরু করে ‘প্রিয় হেলেন’ বলে।
তবে ইংরেজ ফ্র্যাঙ্ক, তার পরিবার (স্ত্রী নোরা, দুই মেয়ে) এবং সহকর্মীদের পরিপার্শ্ব যতটা দ্রুত জানতে পারে সংকলনের পাঠক—হেলেনের চারপাশটা সম্পর্কে যেন ততটা জানা যায় না। খাঁটি আমেরিকানের মতোই হেলেন যেন নিজেই সামলাচ্ছেন জীবনের সব, পরিবার বা বন্ধুরা বিশেষ উঠে আসেন না তার চিঠিগুলোয়। তবে হ্যাঁ, টিভির জন্য চিত্রনাট্য লেখা হেলেনের জীবনের প্রধান আকর্ষণ যে বই কেনা আর পড়া—সেটা বুঝতে পাঠকের দেরি হয় না। আর তার পছন্দের বইগুলোও বেশ ভারিক্কী, অধিকাংশই মধ্যযুগের ধর্মগুরু বা দার্শনিকদের রচনা, উপন্যাস পড়তে হেলেন মোটেই ভালোবাসেন না (আর পড়লেও, সেটা হয় ন্যান্সি মায়ার্সের সিনেমার মেয়েদের মতোই—প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস!)।
ইংল্যান্ডের উদ্দিষ্ট বইবিপণিতে বহুবার আসার সংকল্প করেছেন হেলেন, ফ্র্যাঙ্ক-নোরা দম্পতিও চিঠিতে বহুবার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কখনো এমনও হয়েছে, হেলেনের কোনো বন্ধু যখন লন্ডন ঘুরতে এসে পা রেখেছেন ওই দোকানে আর নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘হেলেনের বন্ধু’ বলে, ‘মার্কস অ্যান্ড কোম্পানি’র মানুষগুলোর কাছ থেকে তুমুল খাতির পেয়েছেন তারা। কিন্তু হেলেনের নিজের তবু আসা হয়ে ওঠে না চ্যারিং ক্রসে। কখনো ডেন্টিস্ট, কখনো বাসা বদল—এইসব চক্করে পড়ে টাকার টানাটানিতে থাকা হেলেন কখন ইংল্যান্ড সফরের পুরো খরচটা জমাতে পারেন নি। শেষ পর্যন্ত যখন পাঠকের মনে হতে থাকে যে অপেক্ষাটা নাটকের মতোই দীর্ঘ হচ্ছে, তখনই বাস্তব হয়ে ওঠে সিনেমার চাইতে নাটকীয়। ফটোগ্রাফের বাইরে বাস্তবে আর দেখা হয়ে ওঠে না দুই বন্ধুর, মৃত্যু ঘটে ফ্র্যাঙ্ক ডোয়েলের।
ফ্র্যাঙ্কের মৃত্যুর পরেও তার পরিবার (স্ত্রী শীলা বা কন্যা নোরা)-এর সাথে কিছু চিঠি বিনিময় হয়েছিলো হেলেনের। সেই পত্রালাপ পরেও চালু ছিলো কি না, উদ্দিষ্ট সংকলনে তার বিস্তারিত নেই। তবে ফ্র্যাঙ্কের মৃত্যুর পর ১৯৭০ সালে দুই পক্ষের লেখা মোট ৮৪টি চিঠি সংকলিত করে হেলেন প্রকাশ করেন ‘৮৪, চ্যারিং ক্রস রোড’, যা তাকে এনে দেয় জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বইপড়ুয়াদের মাঝে হেলেনকে নিয়ে ওঠে তুমুল আলোড়ন। উদ্দিষ্ট বইয়ের কাহিনি অবলম্বনে মঞ্চনাটক অভিনীত হয় লন্ডন আর নিউইয়র্কে, সিনেমা তৈরি হয় হলিউডেও।
ফ্র্যাঙ্ক ডোয়েলের মতোই হেলেন হ্যানফও এখন আর নেই দুনিয়ায়। কিন্তু বইকে কেন্দ্র করে দুজনের যে বন্ধুত্ব, সে গল্প বইপড়ুয়া মাত্রই নিশ্চিত আরও অনেকদিন লালন করবেন হৃদয়ের কোনো কোমল কুঠুরিতে।
বন্ধুর চিঠি বন্ধুকে
দীপেশ চক্রবর্তী আর রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাঝে চিঠিপত্রের সংকলনটির নাম ‘বন্ধুর চিঠি বন্ধুকে’।
খেয়াল রাখা দরকার, পূর্বে উল্লেখিত সংকলনে ফ্র্যাঙ্ক আর হেলেনের মাঝে যে বন্ধুত্ব, সেদিক থেকে যথেষ্ট ভিন্ন দীপেশ আর রাঘবের বন্ধুত্বের ধরন। হেলেনদের বন্ধুত্বের সূত্রপাতই হয়েছিলো চিঠি লেখা থেকে, কিন্তু দীপেশ আর রাঘবের বন্ধুত্বের সূচনা যৌবনে—সেটাকে তারা টেনে নিয়েছেন দশকের পর দশক। একই সাথে, এই দুজনের মাঝে বিনিময় করা চিঠিগুলোও বৈদ্যুতিন, সাদা ভাষায় আমরা যাকে ‘ই-মেইল’ বলি। চিঠির চাইতে যে বৈদ্যুতিন চিঠির ভাষা কি ভাবনা যে অনেকাংশেই তাৎক্ষণিক হয়, দুটো বই মিলিয়ে দেখলে তা বুঝতে পাঠকের তেমন সময় লাগে না।
রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে দীপেশ চক্রবর্তীর পরিচয় সত্তরের দশকে। দীপেশ তখন নিযুক্ত গবেষণায়, আর রাঘব লিখছেন গল্প-উপন্যাস। দুই জগতের মানুষ হয়েও যে বন্ধুত্ব জমে গেলো তাদের মাঝে, তার কারণ —দীপেশ বলছেন—‘দুজনেরই স্বভাবে কিছুটা ফিচলেমি ছিল’! জমে যাওয়া এই বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে (২০০৩ সালে হৃদরোগে দীপেশের সার্জারির দরকার ধরা পড়লে) শুরু হয় দুজনের মেইল চালাচালি। প্রায় দেড় দশক (ক্যান্সারে রাঘবের মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত) সেই মেইল বিনিময় বজায় ছিলো। দুজনের মাঝে বিনিময় করা প্রায় ৫০০ মেইলের মাঝে বেশ কিছুকে বেছে নিয়েই তৈরি করা হয়েছে ‘বন্ধুর চিঠি বন্ধুকে’।
সত্যি বলতে, প্রাজ্ঞ এই দুই বন্ধুর মাঝের চিঠিগুলো ঠিক অবিরাম পড়ে যাবার নয়। চিঠিতে কথা বলছেন এমন দুই মানুষ, যারা জানেন এই প্রাচীন পৃথিবীতে তারা নিজের স্বর খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তারা এটাও জানেন যে প্রাচীন এই পৃথিবী এমন নির্দয়, মানুষকে নানা স্বরের হরবোলা বানিয়ে তোলা থেকে সে রেহাই দেয় না। ফলে এক ধরনের অনিবার্য অপেক্ষার মধ্যে দিয়ে তারা যেন নিজ নিজ ভুবনের সিসিফাসের পাথর ঠেলে যাচ্ছেন। তার মাঝেই তাদের টুকরো টুকরো সব পর্যবেক্ষণে পাঠকের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে দুই বন্ধুর বিশ্ববীক্ষা, তাদের অন্তর্গত সংশয়, এমনকি হীনমন্যতাও।
চিঠিগুলোয় দুই বন্ধু আলাপ করছেন নানা চলতি বিষয়ে। সুনীল গাঙ্গুলীকে নিয়ে আলাপ আছে, আলাপ আছে তারেক মাসুদের সিনেমা নিয়ে, আলাপ আছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি বিষয়ে। কিছু চিঠিতে নাম গোপন করে কারও সমালোচনা করে হয়েছে—তেমন নমুনাও পাওয়া যায়। তবে দুজনের সাধারণ বন্ধুদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা হয়েছে একেবারে নাম ধরেই। ঠাট্টার ছলে দীপেশের লেখা ছড়াটা পড়তে গিয়ে তো ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি না এসে পারেই না।
কমলকুমার মজুমদারকে নিয়ে এক ধরনের ঘোর ছিলো রাঘবের। ২০০৩ সালে যখন দীপেশের সাথে মেইল বিনিময় শুরু হয়, তখন তিনি কাজ করছিলেন কমলকুমারকে নিয়ে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরির জন্য। সেই নির্মীয়মান পাণ্ডুলিপির প্রসঙ্গ প্রায়ই উঠে এসেছে দুজনের আলাপে। অমন সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকল্পের কথা উল্লেখ না থাকলেও দীপেশের কাজ সংক্রান্ত বিবিধ ব্যস্ততার কথাও আলোচনায় উঠে এসেছে কয়েকবার।
আরেকটা ব্যাপার হলো, পরবর্তী প্রজন্মের সাথে যোগাযোগ নিয়ে যে চিরন্তন আক্ষেপ থাকে প্রবীণদের—সে প্রসঙ্গটাও বেশ কয়েকবার এসেছে দুজনের চিঠিতে। ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ সুরটা সেই সব জায়গায় বেশ স্পষ্ট। কিন্তু তবু তার মাঝেই বাঙালি, বাঙালির সমাজ নিয়ে হঠাৎ এমন দু একটা পর্যবেক্ষণ এসেছে, যারা প্রায় দাগিয়ে রাখার মতো সুন্দর।
সংকলনে জায়গা পাওয়া প্রায় সমস্ত মেইল ২০০৩ থেকে ২০০৭ এর মাঝে লেখা। ২০০৮ এর পর যেন হঠাৎ-ই ফুরিয়ে গেলো দুজনের যোগাযোগ। সংকলনের শেষ দিকটা তাই পাঠককে খুব আলোড়িত করে না। তবে বইয়ের শেষে একটা রাঘবের সাক্ষাৎকার যুক্ত করা হয়েছে; দীপেশ কর্তৃক গৃহীত সেই সাক্ষাৎকার রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাপত্রের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়ায়।
[ডিসেম্বর, ২০২৪]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply