২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আশা রাখি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ বেশ কিছুদিন চালিয়ে নিতে পারবো। আজ থাকলো প্রথম পর্ব।
(১) শূন্যের মাঝামাঝি শূন্যে / জিল্লুর রহমান সোহাগ
জিল্লুর রহমান সোহাগের গল্পগ্রন্থ ‘জুড়িগাড়ি’ পড়বার পর একটি পর্যবেক্ষণ আমি উপস্থাপন করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, গল্পকার হিসেবে সোহাগের ভাষা কিছু বেশিই অলঙ্কারপূর্ণ। গদ্য নয়, দীর্ঘ কোনো কবিতা– বলা ভালো আবৃত্তি করবার মতো কোনো কবিতা লিখছেন যেন সোহাগ। শব্দেরা সেখানে ভারি, গতি সেখানে সম্ভ্রম জাগানো শ্লথ।
২০২৪ সালে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘শূন্যের মাঝামাঝি শূন্যে’ পড়ে টের পাই, গল্পকার সোহাগ তার গদ্যভাষার সেই খামতি বলো বা বৈশিষ্ট্য, পুরোদমেই ধরে রেখেছেন এবারও।
এগারোটা গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সংকলন ‘শূন্যের মাঝামাঝি শূন্যে’। মোটাদাগে বলতে গেলে গল্পগুলো ক্রোধের, রাগী গলায় একধরনের নিস্ফল প্রতিবাদের বর্ণনা দিচ্ছে তারা। একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে যে সব বাস্তবতা ওই রাগের জন্ম দেয়, তাদেরও কখনো কখনো সনাক্ত করা যায় গল্পগুলোর ভেতর থেকে। কিন্তু তবু সোহাগের গল্পের জগৎ ঠিক আমাদের চেনা জগৎ নয়, তারা বরং অনুভূতি দেয় এক ধরনের সানগ্লাস চোখে চাপিয়ে আমাদের বাস্তবতাকে দেখার।
সংকলনের সমস্ত গল্প বর্ণনাত্বক, সংলাপ খুব কম। মনোজগতের বর্ণনাই সেখানে প্রাধান্য পায় আগাগোড়া। ফলে ঘটনার ঘনঘটা যখন থাকে, তখনই আলাদা মনে হয় তার গল্পদের। ‘পাঁচটি উড়ন্ত মাছ’ আর ‘একটা গান’ গল্প দুটো এই ঘরানার উদাহরণ।
আবার ‘বায়েজিদ’ বা ‘অরিগ্যামি’ গল্পগুলোর কথা বলতে পারি, উৎকর্ষতা সত্ত্বেও গল্পগুলোর শেষে খানিকটা ভুরু কুঁচকে যায় পাঠকের। মনে হয়, মোচড়-প্রচেষ্টাটা আওপ না করা গেলেই যেন ভালো ছিলো।
আরেকটা লক্ষণীয় ব্যাপার, উদ্দিষ্ট সংকলনের অধিকাংশ গল্পে কোথাও যেন আশা নেই। ‘ডলফিন’ বা ‘অনুসন্ধান’ গল্পগুলো এর উজ্জ্বল উদাহরন। গল্পগুলোর এই আশাহীনতা, এই ক্লেদাক্ত ভাব পাঠককে ক্রমাগতই পোড়াতে থাকে। আর কোথাও যদি এক টুকরো আশা মিলে যায়, ‘রেড অ্যালার্ট’ গল্পে ইউনিকর্নকে দেখে খুশি হয়ে ওঠা পথশিশুটির মতোই পাঠকের মাঝেও তখন জন্ম হয় এক ধরনের ভালোবাসার। একই কথা বলতে হবে ‘বিচ্ছেদবিষয়ক’ আর ‘একজন ব্যাংকার’ গল্পদের ক্ষেত্রেও, গল্পকারের অবিরাম নৈরাশ্যবাদের পরেও এখানে অল্প কিছু দৃশ্যকল্পেই জিতে গেছে আশাবাদ।
পাঠক হিসেবে গল্পকার জিল্লুর রহমান সোহাগের পরবর্তী গল্প সংকলনে আরও বেশি করে আবিষ্কার করতে চাই জীবনের ওসব টুকরো ইতিবাচকতাকেই।
(২) স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার / হাসনাত শোয়েব
‘স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার’ কি কবিতা হিসেবে পড়বো, না মুক্তগদ্য? চট করে উত্তরটা খুঁজে না পেয়ে লেখককে জিজ্ঞসা করলাম অনলাইনে। উত্তর এলো—যা আশা করেছিলাম, তাই—কবিতা।
জানি না সকলে একমত হবেন কি না আমার সাথে, কিন্তু এ জাতীয় কোনো টেক্সটকে যখন পড়ি আমরা—মন তাদের স্বপ্রণোদিত হয়ে ঠেলে দেয় কবিতার বাক্সে। কেন না একমাত্র কবিতাই বায়বীয় পদার্থের মতো, তার আকার বা আয়তন অনির্দিষ্ট। আর ‘স্যাডনেস উইল…’ এর পাঠক মাত্রেই জানেন, এ সংকলনের লেখাগুলোর আকার বা আয়তন—এমনকি চরিত্রও—সত্যিই অনির্দিষ্ট।
মনে পড়ছে, প্রকাশের আগেই হাসনাতের ফেসবুকে সংকলনের প্রথম লেখা ‘প্রফেট প্রফেট’ বেশ পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম, অপেক্ষা করছিলাম বইটির জন্য। এবারও সেই কবিতাটা চমৎকার লাগলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বইয়ের অধিকাংশ কবিতা ততটা সাড়া তৈরি করলো না পাঠকের ভেতরে। কারণটা কী এই, যে উদ্দিষ্ট সংকলনের বহু লেখা—বিশেষ করে ভালো লাগার অংশগুলো– ইতোমধ্যে অনলাইনে টুকরো-টুকরো হিসেবে পড়ে ফেলেছি? অনলাইনে কবিতা পোস্ট করার স্বভাব কি তবে কবির জন্য ক্ষতিকর? … বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে এই প্রশ্নটা ক্রমেই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠছে।
কিন্তু নাহ, খানিক পর মনে হয়, কেবল ইন্টারনেটের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না আমার ভালো না লাগা। বরং বোধ হতে থাকে, বইয়ের অধিকাংশ লেখা আমাদের ধরে রাখে নাঃ কারণ ‘স্যাডনেস উইল…’ এর টেক্সটে আসলে খুঁজে পাওয়া যায় না কবিতার রহস্যময়তা। পাঠকের বরং চোখ আটকে যায় কেবল রেফারেন্সে।
‘রেফারেন্স’ কথাটা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার এখানে। অন্ততঃ এই লেখায় বোঝাতে চাচ্ছি, রেফারেন্স হলো বহুল-শ্রুত/পঠিত/চর্চিত যে শব্দের ব্যবহার কবিতায় এক ধরনের ছবি তৈরি করে; অনেকটা বহু ব্যবহৃত ‘চাঁদমুখ’ উপমাটার মতো।
সেই অর্থে বললেঃ সাহিত্য, ধর্ম, চিত্রকলা আর কঞ্জ্যুমারিজমের রেফারেন্স দিয়ে ভরে আছে হাসনাতের উদ্দিষ্ট সংকলন। হাসনাতের আরেক আলোচিত গ্রন্থ ‘শেফালি কি জানে’-তেও ছিলো তেমনটাই। তবে পার্থক্য যেটা ধরা পড়ে, ‘শেফালি…’-এর ক্ষেত্রে ওসব রেফারেন্সের ব্যবহার মনে হয়েছিলো খুব সহজাত। বিপুলা বিশ্বের সমস্ত পপ-কালচারের ডোপামিন আমাদের ঢাকাইয়া বাঙাল মনে প্রতিনিয়ত যে সব ইমেজারি তৈরি করে; তার সাথে দারুণ লাগসই ছিলো হাসনাতের ওই পপ-কালচারময় রেফারেন্সদের ব্যবহার।
কিন্তু এবার মনে হলো হাসনাত নিজের ওই কাজটাকেই একরকম অনুকরণ করতে চেয়েছেন। ফলে স্বতঃস্ফূর্ততার বদলে এসেছে পুনরাবৃত্তি। যেমনঃ সে/তারা এসেছিলো অমুক স্থান থেকে, নানা জায়গায় সে/তাদের যাত্রার বিবরণ দেওয়ার পর শেষপর্যন্ত সে/তারা পৌঁছে গেছিলো তমুক স্থানে—এরকম একটা চক্র সংকলনের বিভিন্ন লেখায় এসেছে।
তবে কিছু কিছু জায়গায় এই রেফারেন্স ব্যবহার হয়েছে চমৎকার। ‘প্রফেট প্রফেট’ এর কথা আগেই বললাম, ‘স্যাডনেস উইল লাস্ট ফরএভার’, ‘পাঠকের নীরবতা’, ‘রাষ্ট্র বলতে আমরা যা বুঝি’, ‘গম-বীজের জীবনী’—এই কবিতাগুলো মনে হয়েছে দারুণ স্বতঃস্ফুর্ত। শিশুরা যখন এলোমেলো করে বড়দের কাছ থেকে শোনা রুপকথার গল্প আরেকজনকে বলে, সেই আপাত খাপছাড়া রুপকথার মতো একধরনের এলোমেলো সৌন্দর্য্য আছে ওই কবিতাগুলোয়। হাসনাতের কবিতা পড়তে বসলে আমি মূলত ওই ধরনের সৌন্দর্য্যই আবিষ্কার করতে চাই।
আশা রাখি, স্বতঃস্ফূর্ততার ওই সৌন্দর্য্য আরও প্রকটভাবে পাওয়া যাবে হাসনাতের পরের সংকলনে।
[সেপ্টেম্বর, ২০২৪]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply