একটা গল্প বলি, শোনেন।
এক উপত্যকার দুই বিপরীত ঢালে দুটো কাঠের বাড়ি। দুজন লেখক থাকে ওই বাড়িগুলোয়, আর তারা পালা করে একে অন্যের ওপর চোখ রাখে। একজনের অভ্যাস হচ্ছে সকালে লেখা, অন্যজন লিখতে বসে বিকালবেলায়। কাজেই সকাল আর বিকালে, যে লেখক লিখছে না, সে’ই নিজের স্পাইগ্লাস দিয়ে নজর রাখে অন্য লেখকের ওপর- যে লিখছে।
দুই লেখকের মাঝে একজন হলো বহুপ্রজ লেখক। মানে, যে কি না লিখতে পারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে; ফলে লিখতে পারে প্রচুর। অন্যজন হলো যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক। মানে, যে কি না লিখতে গিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা করে; ফলে তার লেখা হয় বড্ড অল্প।
যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক দ্যাখেঃ বহুপ্রজ লেখকটি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরিয়ে তুলছে সারিবদ্ধ অক্ষর দিয়ে, ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে লেখার টেবিলের পাশে রাখা পান্ডুলিপির আকার। ‘কিছুদিনের মাঝেই বইটা শেষ হয়ে যাবে, সেটা নিশ্চয়ই বেস্টসেলারও হবে!’ – যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক ভাবে একরকম অবজ্ঞা নিয়ে, কিন্তু সেই অবজ্ঞার কোথাও কিছু ঈর্ষাও মিশে থাকে। তার কাছে বহুপ্রজ লেখকটি একজন বুদ্ধিমান শ্রমিকের চাইতে বেশি কিছু নয়, যে শ্রমিক একের পর এক কলে-বানানো-উপন্যাস তৈরি করে যায় মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য।
কিন্তু তবু, তবু যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকটি নিজের ভেতরে ক্রমশ তীব্র একটা ঈর্ষা অনুভব করে ওই মানুষটির প্রতি, যে অক্ষরের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে যাচ্ছে অমন যান্ত্রিক আত্মবিশ্বাস নিয়ে। নাহ, শুধু ঈর্ষা বললে খাটো করা হবে, এটা একরকম শ্রদ্ধাও। ওই বহুপ্রজ লেখক যেভাবে নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে লিখে যাচ্ছে, সেখানে নিশ্চিতভাবে একরকম মহত্ত্ব আছে। আছে একরকম আত্মবিশ্বাস। তার কাছে যা প্রত্যাশিত- সেটা সে অন্যদের দিয়ে যাচ্ছে নিজের জন্য কোনো অন্তর্মুখী সমস্যা তৈরি ছাড়াই। হ্যাঁ, যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক আন্তরিক শ্রদ্ধা করে ওই বহুপ্রজ লেখককে, ওইরকম হবার জন্য সে যে কোনো কিছু দিতে প্রস্তুত। সে এখন চায় ওই বহুপ্রজ লেখককে আদর্শ হিসেবে নিতে। এখন যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের সর্বোচ্চ অভিলাষ ওই বহুপ্রজ লেখকের মতো হওয়া।
অন্যদিকে, বহুপ্রজ লেখক দ্যাখেঃ যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকটি বসেই থাকে নিজের লেখার টেবিলে। সেখানে বসে সে নখ কামড়ায়, মাথার চুল খামচে ধরে, পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে কুটিকুটি করে। নিজেকে সুস্থির করতে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক তারপর রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানায়। তারপর বানায় চা, তারপর বানায় হট চকলেট। তারপর সে পড়তে বসে হোল্ডারিনের কবিতা (যদিও এটা স্পষ্ট যে সে যা লিখছে, তার সাথে হোল্ডারিনের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই)। কবিতা পড়া শেষে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক পাণ্ডুলিপির ইতোমধ্যে লিখে রাখা একটা পৃষ্ঠাকে আবার টাইপ করে, কিন্তু সেটারও লাইনের পর লাইন কাটতে কাটতে সে বাতিল করে দেয়। এবার লোকটা ফোন করে লন্ড্রিতে (যদিও লন্ড্রি আগেই বলে রেখেছে যে বিষ্যুদবারের আগে নীল জামাটা পাওয়া যাবে না), আর তারপর সে কিছু নোট নেয়- যা তার এখন কাজে লাগবে না, কিন্তু ভবিষ্যতে লাগলেও লাগতে পারে। তারপরে ওই লেখক বিশ্বকোষ খুলে তাসমানিয়া সম্পর্কে কিছু পড়াশোনা করে (যদিও সে যা লিখছে, তার সাথে তাসমানিয়া নিশ্চিত কোনোভাবে সম্পর্কিত নয়), আরও দুটো পৃষ্টা ছিঁড়ে ফেলে এবং র্যাভেলের একটা গ্রামোফোন চালিয়ে দেয়।
সত্যি বলতে, যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের লেখা কখনোই ভালো লাগেনি বহুপ্রজ লেখকের। সেগুলো পড়তে গিয়ে বহুপ্রজ লেখকের সবসময় মনে হয়েছে, এই বুঝি সে লেখাটার আসল ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে- কিন্তু তারপরই দেখা গেছে লেখাটা যেন কীভাবে তাকে ফাঁকি দিয়ে দেয়, থাকে শুধু একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। কিন্তু এখন যখন সে দেখছে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক কীভাবে লেখে, বহুপ্রজ লেখকের মনে হতে থাকে- ওই লোকটা লড়ছে বিমূর্ত একটা কিছুর জন্য, এমন একটা পথ সে খুঁজছে যা কোথায় যাবে তা কেউই জানে না। মাঝে মাঝে বহুপ্রজ লেখকের মনে হয়, ওই যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক যেন হাঁটছে খাদের ওপর বেঁধে রাখা একটা টানটান দড়িতে পা রেখে। বহুপ্রজ লেখকের ভেতরটা তখন শ্রদ্ধায় ভরে যায়। শুধু শ্রদ্ধা নয়, ঈর্ষাও খেলা করে তার ভেতরে। কারণ বহুপ্রজ লেখকের মনে হয়, ওই লোকের সামনে তার কাজ কত তুচ্ছ! যযন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক যা খুঁজে মরছে, সেটার তুলনায় তার নিজের লেখা কত না অগভীর!
ওদিকে উপত্যকার নিচে, আরেকটা কাঠের বাড়ির বারান্দায় বসে রোদ পোহায় এক তরুণী, হাতে তার ধরা থাকে একটা বই। স্পাইগ্লাস দিয়ে দুই লেখক চোখ রাখে এই তরুণীর ওপরেও।
“মেয়েটা যে কী মুগ্ধভাবে বইটা পড়ছে! একটার পর একটা পাতা কীভাবে উল্টাচ্ছে দ্যাখো! এটাকেই বোধ হয় ‘এক নিঃশ্বাসে পড়া’ বলে!” যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক ভাবে। “উপন্যাসটা নিশ্চিত মেয়েটার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, এটা বোধহয় ওই বহুপ্রজ লেখকের মতো কারও লেখা!”
“মেয়েটা যে কী মুগ্ধভাবে বইটা পড়ছে! এমনভাবে পড়ছে যেন সে ধ্যানে চলে গেছে! যেন সে এখনই রহস্যময় কোনো প্রজ্ঞা খুঁজে পাবে!” বহুপ্রজ লেখক ভাবে। “উপন্যাসটা নিশ্চিত জগতের কোনো গভীর সত্য উন্মোচন করছে, এটা বোধহয় ওই যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের মতো কারও লেখা!”
যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের জীবনে এখন চাওয়া বলতে একটাইঃ পাঠক তাকে এমনভাবে পড়ুক, যেভাবে ওই তরুণী পাঠক বই পড়ে। সে তাই একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করলো এমনভাবে, যেভাবে বহুপ্রজ লেখক তার উপনাসগুলো লেখে।
ওদিকে বহুপ্রজ লেখকের জীবনেও এখন চাওয়া বলতে একটাইঃ পাঠক তাকে এমনভাবে পড়ুক, যেভাবে ওই তরুণী পাঠক বই পড়ে। সে তাই একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করলো এমনভাবে, যেভাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখক তার উপনাসগুলো লেখে।
লেখা শেষ হবার পর দুই লেখকই একে-একে গেলো ওই তরুণীর কাছে। দুজনেই বললোঃ তার ইচ্ছা, তরুণী যেন তার সদ্যসমাপ্ত উপন্যাসটা একটু পড়ে দেখে!
তরুণী দুটো পান্ডুলিপিই গ্রহণ করলো। আর কিছুদিন পর সে দুই লেখককেই নিমন্ত্রণ করলো তার বাড়িতে, একত্রে। সেখানে দুজনকেই অবাক করে মেয়েটি বললো, “এটা কী ধরনের রসিকতা বলুন তো? আপনারা দু’জন তো আমাকে একই উপন্যাসের দুটো কপি দিয়েছেন!”’
… তবে গল্পটা অবশ্য অন্যরকমও হতে পারে।
হতে পারে যে তরুণী গুলিয়ে ফেলবে দুই লেখকের পাণ্ডুলিপি।
তারপর তরুণী বহুপ্রজ লেখকের পাণ্ডুলিপিটা দেবে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখককে, আর পাঠিকা হিসেবে তাকে জানাবে বহুপ্রজ লেখকের ব্যাপারে মতামতগুলো। অন্যদিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের পাণ্ডুলিপিটা তরুণী দেবে বহুপ্রজ লেখককে, আর পাঠিকা হিসেবে তাকে জানাবে যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের ব্যাপারে মতামতগুলো। দুই লেখকই তখন প্রতারিত বোধ করবে, রেগে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেকেই আবিষ্কার করবে নতুন করে।
গল্পটাকে অবশ্য, আরেক ভাবেও সাজানো যেতে পারে।
ধরা যাক, সেই তরুণী আজীবন পছন্দ করে এসেছে বহুপ্রজ লেখকের লেখা। যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের রচনা সে রীতিমতো ঘৃণাই করেছে। কিন্তু বহুপ্রজ লেখকের নতুন উপন্যাসটা পড়ে তার মনে হয়ঃ এই লেখা তো আরোপিত, ফেনিয়ে তোলা! তরুণী তখন উপলদ্ধি করে, বহুপ্রজ লেখকের যা কিছু লেখা সে পড়েছে এতোদিনে, সেগুলো সবই ছিলো প্রকৃতপক্ষে আরোপিত, ফেনিয়ে তোলা।
অন্যদিকে, তরুণীর এখন মনে হতে থাকে, যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের যা কিছু লেখা সে পড়েছে এতোদিনে, সেগুলো বেশ চমৎকারই ছিলো। কিন্তু নতুন পাণ্ডুলিপিটা পড়তে গিয়ে তরুণী আবিষ্কার করে, সে যা ভেবেছে- যন্ত্রণাবিদ্ধ লেখকের রচনা মোটেই তা নয়! ফলে তরুণী এই পাণ্ডুলিপিটাও ছুঁড়ে ফেলে।
চেষ্টা করলে, গল্পটা অবশ্য আরও একভাবে সাজানো যায়।
হয়তো তীব্র হাওয়া এলোমেলো করে দেবে দুই পাণ্ডুলিপি।
সেই তরুণী তখন চেষ্টা করবে সেগুলোকে সাজিয়ে নেবার। দুই পাণ্ডুলিপি মিলে জন্ম হবে একটা অসাধারণ উপন্যাসের, সমালোচকেরাও যাকে ফেলতে পারবে না। এটাই সে উপন্যাস- জীবনভর উভয় লেখকই যেটা লেখার স্বপ্ন দেখেছে।
তবে ওপরের গল্পটাকে আরেকভাবেও লেখা যায়।
শুধু ‘যন্ত্রণাবিদ্ধ’ শব্দটার বদলে ‘বহুপ্রজ’, আর ‘বহুপ্রজ’ শব্দটার বদলে ‘যন্ত্রণাবিদ্ধ’ লিখলেই হবে।
***
[ইতালো কালভিনোর উপন্যাস ‘ইফ অন আ উইন্টারস নাইট আ ট্রাভেলার’ এর অংশবিশেষের ঈষৎ পরিবর্তিত অনুবাদ।]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply