(১) যখনই কোনো উপন্যাস প্রসঙ্গে বলি আমরা, অনুমিতভাবেই আমাদের মাথায় তখন ঘুরতে থাকে উপন্যাসটা পড়বার স্মৃতি। কোন জায়গাটায় সে উপন্যাস স্পর্শ করেছে আমাদের গোপন কোনো বেদনা, কোন অধ্যায়টা আমাদের নতুন কোনো ভাবনা দিলো, কিংবা কোন জায়গাটা মনে হয়েছে একেবারে গাঁজাখুরি- বলতে বা লিখতে গেলে সেইসব ভাবনাকেই আমরা উল্টেপাল্টে দেখি রুমালের মতো। সাথে, যদি লেখকের অন্যান্য লেখার সাথে পূর্বে যাত্রার অভিজ্ঞতা থাকে আমাদের- সেটাও প্রভাব ফেলে কোনো উপন্যাসকে নিয়ে বলবার সময়।

কিন্তু যখন ঔপন্যাসিকের রচনা-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকেন পাঠক?

না, পাঠক যদি হয় লেখকের পূর্বপরিচিত, আর সে যদি টের পায় যে এই লেখা নামানোর সময় ঔপন্যাসিক ভাবনার অমুক সড়কটায় পা দিয়েছেন- তখন কিন্তু উপন্যাসটাকে সে অন্য দশটা বইয়ের সাথে একত্রে মেশাতে পারে না। শিরায় মাদক ঢুকলে যেমন চেনা জগতের মাত্রা সংখ্যা বেড়ে যায় – ঠিক তেমনই নতুন একটা বোধ, একটা দৃষ্টিভঙ্গি তখন তার চোখের সামনে চশমার মতো এসে দাঁড়ায় উদ্দিষ্ট উপন্যাস পড়তে গেলে।

জিল্লুর রহমান সোহাগের উপন্যাস ‘ডি-মাইনর’ পড়তে গিয়ে আমার তেমনটাই হলো।

এমনটা বলছি, কারণ ২০২০-এর ওই অতিমারি কালে যখন দুনিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে, লকডাউন ভারাক্রান্ত ঢাকা শহরে যখন ঘাড় গুঁজে আমি সুহান লিখে যাচ্ছি আমার উপন্যাস ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’, ঠিক একই সময়ে সোহাগও তার এই উপন্যাসের কাজ শুরু করেন। আনাড়ি দুই ঔপন্যাসিক হিসেবে আমরা তখন একে অপরকে অবিরাম প্রশ্ন করেছি; নিজেদের উপন্যাস নিয়ে আমরা কী করতে চাই – আলাপ করেছি সে প্রসঙ্গেও। ‘ডি-মাইনর’ উপন্যাস নির্মাণের সঞ্চারপথ আমার তাই কিছুটা হলেও জানা। সে কারণে, স্বীকার করি-তৃতীয় কারো কাছে পাঠক হিসেবে আমি গণ্য হবো উক্ত উপন্যাসের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবেই।

তবু এই লেখা লিখতে বসা কেবল বন্ধুকৃত্যের দায়ে নয়। আমার ধারণা- অনলাইনে সুলভ হয়ে থাকা ‘নির্মোহ’ পাঠপ্রতিক্রিয়ার ভিড় আর না বাড়িয়ে – আমি বরং এই লেখার মাধ্যমে একরকমের বোঝাপড়াই করতে চাই নিজের সাথে। আমি চাই, ‘ডি-মাইনর’কে একটা রচনা হিসেবে বিচার করতে বসে উপন্যাস-শাস্ত্রের প্রতি নিজের ভাবনাকেই আরেকটু যাচাই করে নিতে।

(২) মূল আলাপে যাবার আগে নিজের উপন্যাস ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ নিয়ে দু’চার কথা বলে নিই। মোটাদাগে বলতে গেলে- ওই উপন্যাসটি ডিস্টোপিয়ান ঘরানার, যেখানে প্রকৃতি আর কর্তৃপক্ষ আরোপিত বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝে- একজন লেখক আবিষ্কার করতে চাইছেন নিজের করণীয়, খুঁজতে চাইছেন নিজের স্বর।

জানি, ভুরু কুঁচকাচ্ছেন অনেকেই। ‘ডি-মাইনর’ নিয়ে বলতে গিয়ে লোকটা নিজেরই উপন্যাস নিয়ে এমন নির্লজ্জ গান শোনাচ্ছে কেন?

শোনাচ্ছে, কারণ- পাঠক হিসেবে সুহান আবিষ্কার করেছে, ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’-এর সাথে একধরনের বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে ‘ডি-মাইনর’ এর।

দূরবর্তী কোনো সময়ে ডিস্টোপিয়ান এক জনপদে কীভাবে দূষিত হয়ে আছে একদল তরুণের মনোজগৎ, ‘ডি-মাইনর’ খুঁড়ে দেখতে চেয়েছে সেই সম্ভাবনা- ঠিক ‘গ্রাফিতি…’ এর মতোই। পার্থক্য বলতে, ‘ডি-মাইনর’ উপন্যাসে লেখক তার পর্যবেক্ষণের কেন্দ্র করে তুলেছেন একজন শিল্পীকে (মিউজিশিয়ান), আর অন্য উপন্যাসটায় কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো একজন লেখক।

কয়েক পৃষ্ঠা এগোতেই তাই, ‘ডি-মাইনর’ উপন্যাসের সাথে নিজের রচনার সাদৃশ্যের এই ঘনঘটা আমাকে চমকে দেয়। আমি পড়ে যেতে থাকি এক ধরনের নিষিদ্ধ কৌতূহল সাথে করে।

(৩)  ‘ডি-মাইনর’ উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে – বলেছি আগেই- একজন মিউজিশিয়ান। ঘটনাচক্রে রনন নামের সেই তরুণের হাতে এসে পড়ে একটি পান্ডুলিপি, আর সে আবিষ্কার করেঃ জার্নাল ঘরানার এই লেখাটি এমন এক শিল্পীর, যার জীবন ও সময়ের সাথে রয়েছে রননের নিজ জীবনের বিস্ময়কর সাদৃশ্য।

পাণ্ডুলিপিটা পড়তে থাকে রনন। পড়তে থাকে এমন এক ভবিষ্যৎ সময়ের কথা- যেখানে মানুষ হারছে কিন্তু চূড়ান্ত পরাজয় স্বীকার করতে চাইলে তাকে লড়তে হচ্ছে তর্কযুদ্ধ। সেখানে নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংবেদনশীলের সম্বল শুধু মুনলাইট সোনাটা। সেখানে, হরিণের মাংস খাওয়ার সেই শহরে প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্ট্রিটল্যাম্প ভাঙছে বখাটেরা, নিরুপায় শিল্পীকে আশা দিতে পারছে না সঞ্জীব চৌধুরী কি মহীন ঘোড়া গৌতম পর্যন্ত।

অস্থির সেই সময়ের ছায়াপাত ঘটে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্কেও। কেন পান্ডুলিপির লেখক রবিনকে ছেড়ে যায় সুপর্ণা, সেটা অজ্ঞাত। অরণী কি চায়- সেটাও আমরা বুঝে উঠি না। শুধু দেখি, অতীত হারিয়ে ফেলছে রবিন, নিজের পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হচ্ছে সে ক্রমশ।

আর এদিকে, পাণ্ডুলিপির বাইরে রননের নিজস্ব জীবনেও যেন ছায়াপাত ঘটতে থাকে ওই ডিস্টোপিয়ান সময়ের। পান্ডুলিপির ভেতর কি বাহির, কোনোটাই তখন স্বস্তি দেয় না পাঠককে।

‘ডি-মাইনর’ উপন্যাস এগিয়ে যায় পাঠকের এই অস্বস্তি সঙ্গী করেই।

(৪) কোনো বড় গল্পের চাইতে উপন্যাসকে আলাদা করে তোলে ‘আত্মা’র মতো একটা ব্যাখ্যাতীত কিছুর উপস্থিতি। প্রথম উপন্যাস হিসেবে, সোহাগ সেই আত্মাকে উপন্যাসে হাজির করতে পেরেছেন দুর্দান্ত ভাবে। উপন্যাসের কাছে স্বকীয় একটা স্বরে একটা ব্যক্তিগত ট্রমা খুঁজে পাওয়ার যে চাহিদা থাকে পাঠকের, সেটা বেশ ভালোমতোই পূরণ হয় ‘ডি-মাইনর’ এ।

বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় অধ্যায়গুলোর শিরোনামের কথা। ‘সালফার বৃষ্টির বিকাল’, ‘আদমশুমারি’, ‘হাওয়া ঝিমঝিম জলপাই সুবাস’ বা ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এর মতো চমৎকার সব শিরোনাম নিয়মিত বিরতিতে মুগ্ধ করেছে পাঠককে। মুগ্ধ করেছে ফোনবুথ বা নির্জন ব্রিজের মতো চমৎকার কিছু ইমেজারির ব্যবহারও।

তবে বিপরীতদিকেও কথা থাকে। শিল্পীর নৈপুণ্যের সাথে যোগ্য যে সঙ্গত দেয় কারিগরের কৌশল, সেইটার খানিক খামতি যেন অনুভব করি উদ্দিষ্ট উপন্যাসে। পরিমার্জন আর পুনর্লিখনে যে অংশগুলো অনায়াসে ছেঁটে ফেলা যেতো- তেমন বেশ কিছু মেদ চোখে পীড়া দেয়।

প্রকাশক হিসেবে চন্দ্রবিন্দুর প্রতিও কিছুটা রাগ ব্যক্ত না করে পারা যায় না। অঙ্গসজ্জা আর অক্ষর বিন্যাস একেবারেই সুবিন্যাস্ত ছিলো না এই স্বাস্থ্যবান বইতে। সেদিকে মনোযোগ দিলে ভালো এই উপন্যাসটা আরো বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারতো বলে বোধ করি।

(৫) কিন্তু ‘ডি-মাইনর’ এর কাহিনি বা রচয়িতার নির্মাণ-কুশলতা সংক্রান্ত আলাপ তো করতে বসিনি আমি। ‘ডি-মাইনর’ তো আমাকে ভাবিয়েছে আরেক পথে। চিন্তিত করে তুলেছে এই খোঁচায়, যে একজন ঔপন্যাসিক – যতই কাকতালীয় বোধ হোক- নিজের ভাবনাকে সে সমকালের আরেক ঔপন্যাসিকের কলমে আবিষ্কার করতে পারে প্রায় একই রকম কাহিনির মোড়কে।

পড়তে গিয়ে দেখেছি, মোটাদাগের সাদৃশ্য ছাড়া সূক্ষ কিছু জন্মদাগও ‘গ্রাফিতি…’ আর ‘ডি-মাইনর’ এ দাঁড়িয়ে আছে যমজের মতো। পরিচয়পত্র সংক্রান্ত জটিলতা আর আড়িপাতা বিষয়ক বয়ান যেমন উভয় উপন্যাসে প্রায় এক। পড়তে পড়তে ভাবিঃ কী করে- একে অন্যের সাথে কিছুমাত্র আলোচনা না করেও – সমকালকে আমরা আবিষ্কার করেছি একইভাবে?

বিস্ময় বোধ না করে পারি না, কী করে, ‘ডি-মাইনর’ হয়ে উঠেছে এমন এক উপন্যাস, যা আদতে আমারই লেখা কিন্তু অন্য কারো শব্দে?

… তখন মনে পড়ে মারিও ভার্গাস ইয়োসার ওই কথাটা। উদ্ধৃতির কষ্ট না করে বলি, মোটাদাগে কথাটা ছিলো এমনঃ লেখক কখনো নির্বাচন করে না সে কোন উপন্যাস লিখবে, বরং প্রতিটি উপন্যাসই তার জন্য লেখক খুঁজে নেয়।

অন্যভাবে বলতে গেলে, উপন্যাসের নির্মাতাকে প্ররোচিত করে সময়। সময়ই লেখকের ওপর এই বোধ চাপায় যে এই অভিজ্ঞতাকে এখন উপন্যাসে রুপান্তর করতে হবে।

ব্যাপারটা তাই বোধহয় কাকতালীয় নয়, যে সুহান রিজওয়ান বা জিল্লুর রহমান সোহাগ ছাড়াও বহু লেখকের হাতেই ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস রচনার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি। জঁরা সাহিত্যের লেখকেরা বহু ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপণী অতিরঞ্জন করলেও, একাধিক লেখক সচেতনভাবেই তাদের লেখায় তুলে আনছেন ডিস্টোপিয়া প্রসঙ্গ। প্রবীণ লেখক হাসনাত আবদুল হাই পর্যন্ত ‘অন্যদিন’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস।

সমকালের এই কৌতুকটা মেনে নিয়েই তাই ‘ডি-মাইনর’ উপন্যাসকে আলাদা করে রাখি শেলফে। নিজের উপন্যাসেরই পাশে। অন্য কারো শব্দেও যে উপন্যাসকে আমারই লেখা বলে বোধ হয়, সেই উপন্যাসকে দূরে ঠেলা আমার জন্য সম্ভব হয় না।

[আগস্ট, ২০২৩]

প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।

কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।

আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!