আদর্শ পাঠক নিয়ে কয়েক লাইন
কাগজের বুকে শব্দ বসাবার ঠিক আগ মুহুর্তে লেখকই হলো আদর্শ পাঠক। সৃষ্টি মুহুর্তের ঠিক পূর্বক্ষণেই আদর্শ পাঠক বিরাজ করে।
আদর্শ পাঠক কোনো গল্পকে পুনরায় জোড়া লাগায় না, তারা গল্পটাকেই বানায় নতুন করে।
আদর্শ পাঠক গল্পকে অনুসরণ করে না, তারা গল্পের অংশ হয়ে ওঠে।
বিবিসি’তে বাচ্চাদের বই বিষয়ক একটা জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থাপক সবসময় বলে, ‘সবাই আরাম করে বসেছো তো? …বেশ, এখন আমরা শুরু করতে যাচ্ছি!’; আদর্শ পাঠকও তেমন আরাম করে বসতে জানা লোকটা।
ছবির জগতে দেখবেন, সেইন্ট জেরোমকে সবসময় আঁকা হয় এমন ভাবে, যেন তিনি তার অনূদিত বাইবেলের দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন ঈশ্বরের কথা শুনতে। আদর্শ পাঠককে অবশ্যই মন দিয়ে শোনার কায়দা শিখতে হয়।
আদর্শ পাঠক একজন অনুবাদক; বাইরের আবরণটা ভেদ করে, সব শিরা উপশিরার গতিপথ খুঁটিয়ে দেখে অক্ষরদের প্রস্থচ্ছেদ করতে করতে সে চলে যেতে পারে লেখার অস্থিমজ্জায়। গোটা লেখাটা তখন হয়ে ওঠে একটা নতুন, সংবেদনশীল কিছু। আদর্শ পাঠক শুধু লেখার ছাল ছাড়ায় না।
আদর্শ পাঠক পরিচিত লেখার সমস্ত কারিগরির সাথে।
আদর্শ পাঠকের কাছে সব কৌতুকই নতুন।
আদর্শ পাঠকের থাকতে হবে ভুলে যাবার অনিঃশেষ ক্ষমতা; যাতে সে মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারে যে ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইড একই মানুষটা, যাতে সে বিস্মৃত হতে পারে জুলিয়েন সোরেলের মাথা কেটে ফেলা হবে, যাতে তার মনে না থাকে যে রু অ্যাকর্ডের খুনীর নামটা কী।
ব্রেট ইস্টন এলিস নামের সমালোচক অমুক বই নিয়ে কী বলেছেন, আদর্শ পাঠকের তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না।
লেখকের ভেতরের ভাবটাকেও আদর্শ পাঠক বুঝে নিতে পারে।
আদর্শ পাঠক একটা লেখাকে উলটেপালটে দেখে, লেখকের সমস্ত কথাকেই সে বেদবাক্য বলে মানে না।
আদর্শ পাঠকের পড়াটা ক্রমসঞ্চিত, একটা বই প্রতিবার পড়ার পরেই তার বয়ানে যুক্ত হয় নতুন কোনো স্মৃতি।
আদর্শ পাঠকের পড়াটা সঙ্গভিলাষী, সে এমনভাবে পড়ে, যেন সমস্ত বই কোনো অমর, বহুপ্রজ লেখকের রচনা।
আদর্শ পাঠক তার জ্ঞানকে শব্দে রুপান্তরিত করতে অক্ষম।
বই বন্ধ করার পর আদর্শ পাঠকের মনে হয়, বইটা না পড়লে তার পৃথিবী অসম্পূর্ণ থাকতো।
আদর্শ পাঠকের একটা দুষ্ট রসবোধ থাকে।
আদর্শ পাঠক কখনো তাদের বইয়ের সংখ্যা গোণে না।
আদর্শ পাঠক একইসাথে উদার আর লোভী।
আদর্শ পাঠক সব সাহিত্যই এমনভাবে পড়ে, যেন তার কাছে লেখকের নাম অজানা।
আদর্শ পাঠকের অভিধান ব্যবহার করতে ভালো লাগে।
আদর্শ পাঠক প্রচ্ছদ দেখেই বইয়ের বিচার করে ফেলে।
শতাব্দী প্রাচীন কোনো বই পড়তে গিয়ে আদর্শ পাঠকের মনে হয় সে কালকে জয় করেছে।
পাবলো আর ফ্রাঞ্চেসকা আদর্শ পাঠক নয়, কারণ দান্তের কাছে তারা স্বীকার করেছিলো যে প্রথম চুম্বনের পর থেকে তারা আর কিছু পড়েনি। আদর্শ পাঠক ভালোবাসার চুম্বনের পরেও কখনো পড়ার অভ্যাস থামায় না। তাদের একটা প্রেম অন্য প্রেমটার চাইতে বড় হয়ে ওঠে না।
আদর্শ পাঠকেরা বইয়ের শেষ পর্যন্ত যাবার আগে বোঝে না, যে তারা আদর্শ পাঠক।
আদর্শ পাঠকেরা (অন্ততঃ যতক্ষণ গল্পের ভেতরে আছে) নৈতিকতায় ডন কিহোতে, কামনায় মাদাম বোভারি। তারা বাথ শহরের সেই স্ত্রী লোকের মতোই লোভী, তারা ইউলিসিসের মতো অভিযানপ্রেমী, তারা হোল্ডেন কলফিল্ডের মতোই সাহসী।
আদর্শ পাঠক ক্ষতবিক্ষত পথেই আবার চলতে পারে।
আদর্শ পাঠক স্বভাবে বহু ঈশ্বরবাদী।
আদর্শ পাঠক একটা বই পড়ে পুনরুজ্জীবনের প্রত্যাশায়।
রবিনসন ক্রুসো আদর্শ পাঠক নয়, সে বাইবেল পড়তো উত্তর খুঁজে পেতে। আদর্শ পাঠক পড়ে প্রশ্ন খুঁজে পাবার জন্য।
ভালো হোক খারাপ হোক, প্রত্যেকটা বইয়েরই নিজস্ব আদর্শ পাঠক আছে।
আদর্শ পাঠকের জন্য, প্রতিটা বই-ই কোনো না কোনো মাত্রায় আত্মজীবনী।
আদর্শ পাঠকের কোনো নির্দিষ্ট জাতীয়তা নেই।
কখনো কখনো কোনো লেখককে আদর্শ পাঠক খুঁজে পেতে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। নর্থ্রপ ফ্রাইকে খুঁজে পেতে ব্লেকের অপেক্ষা করতে হয়েছে দেড়শো বছর।
স্তাঁদাল বলেছিলেন, ‘লেখা দিয়ে আমি তাদেরকেই খুশি করতে চাই যারা বন্ধুভাবাপন্ন, কমনীয়, অসুখী এবং নৈতিকতা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামায় না। আমি লিখি অমন বড়জোর একশোটা পাঠকের জন্য। আর আমি চিনি মাত্র দু’তিনজনকে।’
আদর্শ পাঠক দুঃখকে জানে।
আদর্শ পাঠক সময়ের সাথে সাথে বদলায়। নেরুদার ‘বিশটি প্রেমের কবিতা’র চৌদ্দো বছর বয়েসী আদর্শ পাঠক তিরিশ বছর বয়েসে গিয়ে আর আদর্শ পাঠক থাকে না। কিছু পাঠের ওপরে অভিজ্ঞতা মরিচা লেপে দেয়।
বইটা মানুষকে আইন অমান্য করতে উসকাবে ভেবে ‘ডন কিহোতে’ উপন্যাসটা নিষিদ্ধ করেছিলো যে পিনোশে, সে একজন আদর্শ পাঠক।
বইয়ের আকার দেখে আদর্শ পাঠক কখনো ক্লান্ত হয় না।
শুধু অবিশ্বাসকে উড়িয়ে দিতেই নয়, আদর্শ পাঠককে প্রস্তুত থাকতে হয় নতুন বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতেও।
‘ইশ, যদি এভাবে না হয়ে ওটা হতো…!’, আদর্শ পাঠক কখনো এভাবে ভাবে না।
বইয়ের মার্জিনে লিখে রাখা একজন আদর্শ পাঠকের বৈশিষ্ট্য।
আদর্শ পাঠক ধর্ম পাল্টায়।
আদর্শ পাঠক কোনো অনুতাপ ছাড়াই ক্ষ্যাপামি করে।
আদর্শ পাঠক কোনো বইয়ের চরিত্রের প্রেমে পড়তে সক্ষম।
আদর্শ পাঠক কখনো কালের বিপর্যয়, বইয়ের পাতার সত্য, নির্ভুল ইতিহাস, ভূগোলের যথার্থতা নিয়ে চিন্তিত হয় না। আদর্শ পাঠক প্রত্নতত্ত্ববিদ নয়।
প্রতিটা বইয়ের ভেতরের জগতে যে আইনকানুন আছে, আদর্শ পাঠক ক্ষমাহীন ভাবে সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
বই পড়ে যারা আত্মহত্যা করে, তারা আদর্শ পাঠক নয়, বড়জোর ভাবপ্রবণ পাঠক।
আদর্শ পাঠক খুব কমই ভাবপ্রবণ।
আদর্শ পাঠক একইসাথে চায় বইটা শেষ হোক এবং বইটা কখনোই শেষ না হোক।
আদর্শ পাঠক কখনো অধৈর্য্য হয় না।
আদর্শ পাঠক জঁরা নিয়ে চিন্তিত নয়।
লেখকের চেয়ে আদর্শ পাঠক বেশি বুদ্ধিমান, অন্ততঃ আপাতদৃষ্টিতে; কিন্তু তাই বলে আদর্শ পাঠক লেখকের সাথে যুদ্ধে নামে না।
কোনো কোনো মুহুর্তে সমস্ত পাঠকই নিজেকে আদর্শ পাঠক বলে ভাবে।
শুধু উদ্দেশ্য সৎ হলেই আদর্শ পাঠক সৃষ্টি হয় না।
মার্কুইস ডি সাড বলেছিলেন, ‘আমি কেবল তাদের জন্যই লিখি, যারা আমার কথা বুঝতে সক্ষম, তারা আমাকে পড়বে কোনো বিপদ ছাড়াই’। মার্কুইস ডি সাড ভুল করেছিলেন, আদর্শ পাঠক চিরকালই বিপদের মাঝে থাকে, সে নিজেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।
আদর্শ পাঠক সেই লোক, যার সাথে পান আর আলাপ করে একটা সন্ধ্যা কাটাতে লেখকের ভালোই লাগবে।
আদর্শ পাঠককে একজন চোখ বুলানো পাঠকের সাথে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
লেখকেরা কখনোই নিজেদের আদর্শ পাঠক নন।
আদর্শ পাঠক নয়, সাহিত্য বেঁচে থাকে কেবল চলনসই ভালো পাঠকদের মাধ্যমেই।
আদর্শ পাঠাগার নিয়ে কয়েক লাইন
কেবল নির্দিষ্ট একজন পাঠকের জন্যেই আদর্শ পাঠাগারের অস্তিত্ব আছে, প্রত্যেকেরই মনে হওয়া উচিৎ যে পাঠকটা সে নিজেই।
আদর্শ পাঠাগারের দরজার ওপরে ঝুলে থাকে ফ্রেঞ্চ লেখক র্যাবিলির বাণীর খানিক পরিবর্তিত রুপ, ‘পড়ো তোমার ইচ্ছা মতো!’
আদর্শ পাঠাগার একইসাথে বাস্তব আর অলীক, অক্ষরের জগতের সব রকমের প্রযুক্তি, ধারক আর মাধ্যম সেখানে থাকে।
আদর্শ পাঠাগারে যাওয়াটা সহজ। সেখানে উঁচু কোনো সিঁড়ি নেই, নেই পিচ্ছিল কোনো রাস্তা, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে অনেকগুলো দরজা সেখানে থাকে না, বিরক্তিকর কোনো পাহারাদার সেখানে পাঠক আর বইয়ের মাঝে অবশ্যই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না।
আদর্শ পাঠাগারে বসার জন্য থাকে হাতলযুক্ত, হেলান দেয়ার জন্য বাঁকানো পিঠের আরামদায়ক আসন; যেমনটা আছে ফ্রান্সের জাতীয় গ্রন্থাগারে। আদর্শ পাঠাগারে থাকে প্রচুর বসবার ডেস্ক, ভালো হয় তাদের ওপরটা চামড়ায় মোড়ানো হলে; আরো থাকে ইলেক্ট্রনিক জিনিসপাতির জন্য সকেট (এই শর্তে যে, সেগুলো নীরব থাকবে)। আদর্শ পাঠাগারে থাকে প্রত্যেকের জন্য হালকা আলোর ব্যবস্থা, যা দেখে মনে পড়ে বুয়েন্স আয়ার্সের সবুজ কাচওয়ালা বাতিগুলোর কথা।
ইট বা কাঠের দেয়ালগুলোর ভেতরে আদর্শ পাঠাগারে থাকে আরামদায়ক উষ্ণতা, সেটার জানালা খুললেই দেখা যায় শীতল উদ্যান বীথিকা।
আদর্শ পাঠাগারে থাকে মূলত বই, কিন্তু শুধু বই নয়। মানচিত্র, ছবি, গানের রেকর্ড, সিনেমা এ জাতীয় জিনিসপত্রও সেখানে রাখা হয়। পড়ার জায়গা বলতে যা যা বোঝানো সম্ভব, আদর্শ পাঠাগার হলো সেটাই।
আদর্শ পাঠাগার তার পাঠকদের ইচ্ছেমতো বই স্তূপ করবার অনুমতি দেয়।
আদর্শ পাঠাগারে এমন কোনো বইয়ের তাক নেই, যেখান থেকে হাত বাড়িয়েই পাঠক বই নিতে পারবে না। আদর্শ পাঠাগারে উঁচু বা নিচু হয়ে শারিরীক কসরত করতে হয় না।
আদর্শ পাঠাগারে বইয়ের গায়ে কোনো রকমের লেবেল আঁটার দরকার পড়ে না।
আদর্শ পাঠাগারের কোনো অংশই চূড়ান্ত নয়।
বইয়ের তালিকাই আদর্শ পাঠাগারের মানচিত্র।
আদর্শ পাঠাগারে থাকে খাবার, চা, কফি আর কপি করার সুলভ ব্যবস্থা।
আদর্শ পাঠাগার একই সাথে নির্জন আর জনবহুল, ঘরোয়া আর সামাজিক, পাণ্ডিত্যপূর্ণ আর প্রশ্নবিদ্ধ; নিয়মের কড়াকড়ি আর উদারতা, চুপচাপ চিন্তা আর কথাবার্তা; সবই চলতে পারে সেখানে। যা পড়া হয়নি, তা নিয়ে অগাধ হতাশা আর আশায় ভরে থাকে জায়গাটা।
সমস্ত সম্ভাব্য বইয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় আদর্শ পাঠাগার।
আদর্শ পাঠাগারে প্রতিটা বই অন্য বইগুলোর ওপর প্রতিধ্বনি তুলে।
চিরায়ত সব রচনাবলীর সমষ্টিই আদর্শ পাঠাগার।
আদর্শ পাঠাগার কখনো বন্ধ হয় না।
আদর্শ পাঠাগারে বইতে দাগাদাগি করবার অনুমতি থাকে।
আদর্শ পাঠাগার একইসাথে জনপ্রিয় আর গোপন। জনপ্রয় সাহিত্য, এবং হাতেগোণা মানুষের কাছে পরিচিত ধ্রুপদী সাহিত্যও সেখানে থাকে।
আদর্শ পাঠাগারে পাঠকের কাজ হলো প্রতিষ্ঠিত ক্রমকে ভেঙে ফেলা। আদর্শ পাঠাগারে মন্টেগনের প্রবন্ধের পাশে থাকে এদোয়ার্দো লরেঞ্জোর ‘মন্টেগনে’, ফ্লবেরের ‘মাদাম বোভারি’র পাশে থাকে এদগার্দো কোজারিনস্কির ‘ব্রাইড অফ ওডেসা’, দস্তয়েভস্কির ‘ব্রাদার্স কারামাজভ’ এর পাশে থাকে লাজিও ফ্লোদেনির ‘সাইবেরিয়ায় হেগেল পড়ে দস্তয়েভস্কি কেঁদেছিলেন’।
আদর্শ পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা পরিবর্তনশীল। বলা হয় আলেক্সান্দ্রিয়ার পাঠাগারে সাত লাখ পার্চমেন্ট ছিলো, হোর্হে লুই বোর্হেসের বইয়ের সংগ্রহ ছিলো মাত্র পাঁচশো রচনাবলীর, আর অশউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বাচ্চাদের গোপন লাইব্রেরিটায় ছিলো আটটা মহামূল্যবান বই, যা তারা প্রতিরাতে লুকিয়ে রাখতো ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
দেয়াল আর বইয়ের তাক সরিয়ে নিলেও পাঠকের মন থেকে আদর্শ পাঠাগার মুছে যায় না, এই পাঠাগার স্মৃতির পাঠাগার।
পাঠকের কাছে আদর্শ পাঠাগার একটাই দীর্ঘ পাঠ, সেটার বোধগম্য কোনো শুরু কিংবা অনুমানযোগ্য কোনো শেষ নেই।
নিষিদ্ধ কিংবা প্রস্তাবিত বই বলে কিছু আদর্শ পাঠাগারে নেই।
আদর্শ পাঠাগার সেইন্ট জেরোমও আছে, নোয়াম চমস্কিও আছে।
আদর্শ পাঠাগারে কোনো পাঠক অনাহুত নয়।
বইয়ের প্রতিটা পাতাই আদর্শ পাঠাগারে প্রথম পাতা।
‘এটা মন আরেকটু ভালো হলে পড়ার মতো’, ‘এটা খতিয়ে দেখা হয়নি’, ‘এটা আজাইরা’, ‘এটা মূল্যবান’, ‘এটা পরে কখনো সময়ে পেলে পড়তে হবে’…; পল ভ্যালেরির মাথার মতোই, আদর্শ পাঠাগারেও এক একটা অংশের নামকরণ করা হয় এভাবে।
আদর্শ পাঠাগারে বাবেলের অভিশাপ কাজ করে না।
কোনো সমাজ কীসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, আদর্শ পাঠাগার সেটার প্রতীক। সমাজ নির্ভর করে পাঠাগারের ওপর, কারণ সেটা তার স্মৃতি।
আরো জায়গার দাবি না তুলেই আদর্শ পাঠাগার বড় হতে পারে, আরো সময়ের দাবি না তুলেই সেটা জ্ঞান ছড়াতে পারে। আদর্শ পাঠাগার একটা অপূর্ব সুন্দর সম্ভাবনা, সেটা বাঁচে বাইরের জগতের সময় কিংবা জায়গা ছাড়াই।
প্রাচীন অস্থি ভস্মাগারগুলোতে লিখে রাখা হতোঃ ‘তুমি যা, আমরা একদিন তাই ছিলাম; আমরা যা, তুমি একদিন তাই হবে।’ আদর্শ পাঠাগারের বই আর পাঠকদের নিয়েও এই কথাটা বলা যায়।
প্রাচীন মিশরের ধর্মগুরুরা কিছু পাঠাগার তৈরি রাখতেন, যেন মৃতদের সাথে সেই বইগুলোকেও কবর দেয়া হতো যাতে করে আত্মারা মৃতদের ভুবনে পথ খঁজে পায়। আদর্শ পাঠাগার আজও সেই পথ দেখানোর রীতি ধরে রেখেছে।
আদর্শ পাঠাগার তরলের মতো প্রবাহমান, সে নিজের সংগ্রহ জমিয়ে রাখে, আবার বৃদ্ধিও করে।
কিছু কিছু বই, যেমন মেলভিলের মবি ডিক, দান্তের কমেডি; এরা নিজেরাই এক একটা আদর্শ পাঠাগার।
আদর্শ পাঠাগারে কোনো কম্পাস লাগে না, সেটার আকার তার বুদ্ধিবৃত্তিক গড়নের মতোই।
অতি অবশ্যই আদর্শ পাঠাগারের স্থপতি একজন আদর্শ পাঠক।
আদর্শ পাঠাগার ধ্বংস করা যে কোনো অত্যাচারী শাসকের জন্যেই অসম্ভব।
আদর্শ পাঠাগার পুনরায় তৈরি করা যে কোনো পাঠকের জন্যেই অসম্ভব।
অন্য সব পাঠাগারের মতোই, আদর্শ পাঠাগারেও এমন অন্ততঃ একটা বাক্য খুঁজে পাওয়া যায়, সেটা কেবল তোমার জন্যেই লেখা।
[পাঠকের কাজ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার জন্য আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েলের বিকল্প খুঁজে পাওয়া কঠিন- যে আর্জেন্টাইনকে ‘পাঠকদের ক্যাসানোভা’ বলে রায় দিয়েছিলেন স্বয়ং হোর্হে লুই বোর্হেস। বোর্হেস অন্ধ হয়ে যাবার পরে এই ম্যাঙ্গুয়েল-ই তাকে বই পড়ে শোনাতেন।
লেখক হিসেবে ম্যাঙ্গুয়েলের খ্যাতি মূলত অকল্পসাহিত্য (non-fiction) লেখার জন্য। কীভাবে পাঠকের স্বাদ নেওয়া উচিৎ একটা বইয়ের, কাল আর ভূগোলের চলক কীভাবে আমাদের পাঠ্যভাসের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে; সে বিষয়ে দারুণ সব আলোচনা আছে ম্যাঙ্গুয়েলের। সেই আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েলের দু’টি প্রবন্ধের অনুবাদ করা হয়েছে এখানে।]
[জুলাই, ২০২৩]
প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।
কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।
আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!
Leave a Reply