এটা, নিঃসন্দেহে, ঔপন্যাসিকদের প্রতি মানুষের সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত প্রশ্নগুলোর একটা। কে জিজ্ঞেস করছে, তার ওপর ভিত্তি করে আপনাকে সর্বদাই একটা সন্তোষজনক উত্তর দিতে হয়। এখানেই শেষ নয়, উত্তর দেয়ার সময় প্রতিবার সেখানে আনতে হয় কিছু বৈচিত্র্যও। শুধু আনন্দের জন্যে না, বরং- যেমনটা লোকে বলে- সত্য খুঁজে পাবার সম্ভাবনাটাকে বাঁচিয়ে রাখতেও। কারণ একটা ব্যাপার আমি নিশ্চিত জানি, যে কীভাবে উপন্যাস লেখা হয় প্রশ্নটা যারা করে, তারা নিজেরাও ঔপন্যাসিক। এবং আমরা প্রতিবারই নিজেকে একটা ভিন্ন উত্তর দেই।

অবশ্যই, আমি এখানে বলছি সেই লেখকদের কথা, যারা বিশ্বাস করে যে সাহিত্য হচ্ছে পৃথিবীকে আরেকটু সুন্দর করে তোলার একটা শিল্প-মাধ্যম। অন্যরা, যারা বিশ্বাস করে যে সাহিত্য এমন এক শিল্প-মাধ্যম যার কাজ তাদের ব্যাঙ্ক হিসাবকে বাড়িয়ে তোলা; তারা এমন সব সূত্র জানেন যা নির্ভুল, যাদের গাণিতিক সমীকরণের মতোই নিখুঁতভাবে ভেঙে দেখানো যায়।

সম্পাদকেরাও সেটা জানেন। কীভাবে তার প্রকাশনা সংস্থা জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার জিতেছে, তা বলতে গিয়ে এক সম্পাদক সম্প্রতি আমার কাছে হাসিতে ভেঙে পড়েছিলেন। প্রথমেই, তাদের নাকি দেখতে হয়েছে জুরি সদস্য হিসেবে কারা কারা আছে; বিশ্লেষণ করতে হয়েছে প্রত্যেক বিচারকের ইতিহাস, কাজের ধরন, এবং সাহিত্যরুচি। সম্পাদকের মনে হয়েছিলো এই ব্যাপারগুলো খতিয়ে দেখলেই জুরিদের পছন্দের একটা গড়মান পাওয়া যাবে; ‘এজন্যেই তো কম্পিউটার জিনিসটা আছে!’, তিনি বলেছিলেন। আর একবার যখন তারা পেয়ে গেলেন যে কোন ধরনের বইয়ের পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা সবচেয়ে ভালো, তখন তারা এগোলেন এমন এক পন্থায়, বাস্তবে আমরা যার উল্টোটাই করি সাধারণতঃ। বইয়ের আত্মাটা কোথায় আছে, তা না খুঁজে তারা বরং সন্ধান করলেন এমন কোনো লেখক (ভালো হোক আর খারাপ হোক), যে সেটাকে অনুকরণ করতে পারবে। বাকি কাজটুকু ছিলো সহজ। চুক্তি করে লেখককে লিখতে বসিয়ে দেওয়া এবং মাপ মতো এমন একটা বই তৈরি করা, যা পরের বছর জাতীয় পুরস্কার জিতবে। চিন্তার ব্যাপারটা হচ্ছে, সম্পাদক নাকি গোটা ব্যাপারটা কম্পিউটার দিয়ে যাচাইও করে নিয়েছিলেন, এবং সেখানে তার যথার্থতা এসেছিলো শতকরা ছিয়াশি ভাগ!

কাজেই সমস্যাটা আসলে কীভাবে উপন্যাস- কিংবা ছোটগল্প- লেখা হয়, সেটা না; বরং প্রশ্নটা হলো কীভাবে সেটাকে গুরুত্বের সাথে লিখতে হয়, এমনকি যদি তা কোনো পুরস্কার না জেতে বা বিক্রি না হয়, তবুও। এখানে উত্তরটার কোনো অস্তিত্ব নেই, অন্ততঃ যে লোকটা উত্তর খুঁজে পাবার গোপন একটা আশা নিয়ে পত্রিকার এই কলামটা লিখছে, তার কাছে এই ধাঁধার কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না।

গত বছর মেক্সিকোতে পড়তে গিয়ে আমি কিছু অসমাপ্ত ছোট গল্প আর একটা উপন্যাসের সূচনার অংশটুকু লিখেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিলো যে রচনাগুলোর ভেতরের জটটা আমি ছাড়াতে পারছি না। গল্পগুলো নিয়ে কী করবো, সেটা ঠিক করতে আমার বেগ পেতে হয়নি, সেগুলো আমি সোজা ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম। দীর্ঘ এক বছর ব্যবধানে সেগুলোকে পড়ে দেখি, কসম খোদার- এবং ব্যাপারটা হয়তো সত্যি- যে আমি ওগুলো লিখিনি! সেগুলো ছিলো ইউরোপে বাস করা লাতিন আমেরিকানদের নিয়ে ষাটটা বা তারও বেশি ছোটগল্প রচনার একটা পুরোনো প্রকল্পের অংশ; এবং তাদের মৌলিক সমস্যাটা ছিলো- যার কারণে তাদের আমি ছিঁড়ে ফেলেছিলাম- যে আমি নিজেই তাদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

পুনরায় যাতে জোড়া লাগানো না যায়, অমন করে কাগজগুলো টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে আমার হাত কাঁপেনি, তেমনটা বলার ঔদ্ধত্য আমি দেখাবো না। আমি কেঁপেছি, এবং শুধু আমার হাতই কাঁপেনি, কারণ কাগজ ছেঁড়া নিয়ে আমার এমন একটা স্মৃতি আছে— যা শুনতে উৎসাহব্যঞ্জক হলেও আমার জন্য হতাশার।

স্মৃতিটা সেই ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে এল এস্পেক্তাদোর পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে ইউরোপ যাত্রার পূর্ব মুহুর্তের, যখন আমার ঘরে এসে কবি হোর্হে গাইতান দুরান আমায় অনুরোধ করলো তার মিতো ম্যাগাজিন এর জন্য কোনো লেখা রেখে যেতে। আমি তখন মাত্র আমার কাগজপত্র গুছিয়েছি, রেখে দিয়েছি সেই লেখাগুলো, যেগুলো পরে কাজে লাগতে পারে আমার মনে হয়েছে; আর ছিঁড়ে ফেলেছি সেই লেখাগুলোকে, যাদের মাঝে আমি কোনো আশা দেখিনি। গাইতান দুরান, সাহিত্যের প্রতি অনিঃশেষ তৃষ্ণা নিয়ে, এবং তারচেয়েও বেশি— ছাই উড়িয়ে মূল্যবান কিছু আবিষ্কারের লোভে আমার ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ি ঘাটতে শুরু করলো, এবং হঠাৎ এমন কিছু পেয়েও গেলো, যা তার মনোযোগ আকর্ষণ করছে।

‘কিন্তু এই লেখাটা তো ছাপানোর মতো!’ সে বললো।

আমি ব্যাখ্যা করলাম যে কেন আমি ওটাকে ছুঁড়ে ফেলেছি, এটা আসলে আমার প্রথম উপন্যাস- পাতার ঝড়, যা ততদিনে প্রকাশ হয়ে গেছে- থেকে ফেলে দেয়া একটা গোটা অধ্যায়, এবং আবর্জনা ছাড়া এটার কোনো সদগতি করা সম্ভব না। গাইতান দুরান একমত হলো না। তার ভাবনা ছিলো, এই লেখাটা হয়তো উপন্যাসটার জন্য অনাবশ্যক, কিন্তু বাস্তবে এর স্বতন্ত্র একটা মূল্য আছে। সে আমাকে প্রভাবিত করার চাইতেও বেশি, মূলতঃ তাকে খুশি করতে চাওয়ার চেষ্টা থেকেই আমি তাকে অনুমতি দিলাম ছেঁড়া কাগজগুলো জোড়া লাগানোর এবং অধ্যায়টা গল্পের মতো করে ছাপানোর।

‘আমরা এটার শিরোনামটা কী দিবো?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে সে ব্যবহার করলো বহুবচন, অন্ততঃ এই ক্ষেত্রে যার ব্যবহার খুব যথার্থ ছিলো না।

‘জানি না।’ আমি বললাম। ‘কারণ এটা কিছুই হয় নাই, এটা ছিলো মাকেন্দোর ওপর বৃষ্টিপাত দেখার সময় ইসাবেলের স্বগতোক্তি।

আমি বলতে বলতেই গাইতান দুরান প্রথম পৃষ্ঠার ওপর লিখে ফেললোঃমাকেন্দোর ওপর বৃষ্টিপাত দেখার সময় ইসাবেলের স্বগতোক্তি’। আর এভাবেই প্রকাশিত হলো আমার এমন একটা গল্প, যা সমালোচক, এবং বিশেষভাবে, পাঠকদের কাছ থেকে পেয়েছিলো ভূয়সী প্রশংসা। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাও আমার-মতে-প্রকাশের-অযোগ্য-পাণ্ডুলিপিগুলো ছেঁড়া থেকে আমায় বিরত রাখতে পারেনি, সেটা বরং আমায় শিখিয়েছে সেগুলোকে এমনভাবে ছিঁড়তে, যাতে কোনোভাবেই তাদের আর জোড়া লাগানো না যায়।

গল্প ছিঁড়ে ফেলাটা অনিবার্য, কারণ গল্প লেখার কাজটা অনেকটা কংক্রিট ঢালাইয়ের মতো নিরেট, যেখানে উপন্যাস লেখাটা হলো ইট বিছানো। মানে হচ্ছে, গল্প যদি প্রথম চেষ্টাতেই লিখে ফেলা যা যায়, তবে আর জোরাজুরি না করাই সবচেয়ে ভালো। উপন্যাসের কাজটা সোজা, তোমাকে আবার শুরু করতে হবে। আমার সাথে এখন এই ব্যাপারটাই ঘটছে। যে উপন্যাসটা আমি অর্ধসমাপ্ত করে ফেলে রেখেছি, সেটার স্বর, ভঙ্গী বা চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্ব যেন উপন্যাসটার সাথে খাপ খাচ্ছে না। এবং এখানেও কারণ একটাইঃ চরিত্রগুলোকে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। সমাধান খুঁজে পাবার চেষ্টায়, কাজে লাগবে ভেবে আমি তাই আবার দুটো বই পড়লাম। ফ্লবেরের ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন’, আমার নির্ঘুম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরে যেটা আমি আর পড়িনি, সেটা এখন কাজে এলো কেবল এমন কিছু উপমা বাদ দিতে, যারা ছিলো খুব সন্দেহ-জাগানিয়া। কিন্তু আমার সমস্যার তাতে সমাধান হলো না। অন্য যে বইটা আমি পুনঃপাঠ করলাম, সেটা ছিলো ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার ‘দা হাউজ অফ দা স্লিপিং বিউটিজ’, যেটা বছর তিনেক আগে আমার ভেতরটা নড়িয়ে দিয়েছিলো এবং এখনো সেই সৌন্দর্য্যের রেশ রয়ে গেছে। কিন্তু এবারে এটাও কোনো কাজে এলো না, কারণ আমি খুঁজছিলাম প্রবীণদের যৌন আচরণের হদিশ, কিন্তু বইটায় যা পেলাম তা হলো প্রবীণ জাপানীদের যৌনতার বর্ণনা- যা ছিলো জাপানের অন্য সমস্ত কিছুর মতোই অদ্ভুত- যার সাথে বুড়ো ক্যারিবিয়ানদের যৌনতার কোনো সম্পর্কই নাই।

যখন খাবার টেবিলে নিজের দুশ্চিন্তার কথাটা জানালাম, আমার এক ছেলে- যার বাস্তব বুদ্ধি বেশি- বললো, ‘আর কয়েক বছর অপেক্ষা করলে তুমি নিজেই ব্যাপারটা টের পাবা!’ কিন্তু অন্যজন, যে শিল্পী, তার কথা ছিলো আরো নিরেট, গলায় কোনো রসিকতার স্পর্শ ছাড়াই সে বললো, ‘দা সরোজ অফ ইয়ং ওয়েরদার- বইটা আবার পড়ে ফেলো’। আমি সে চেষ্টাও করলাম। শুধু এই কারণে নয় যে পিতা হিসেবে আমি দারুণ বাধ্য, কারণ আমি সত্যিই ভেবেছিলাম যে গ্যোটের বিখ্যাত উপন্যাসটা আমার কাজে আসতে পারে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, নায়কের দুঃখজনক শেষকৃত্যের সময় এবার আর আমি কাঁদলাম না, যেমনটা হয়েছিলো প্রথম পাঠের সময়, বরং আমি এবার অষ্টম চিঠিটার বেশি এগোতেই পারলাম না, যেখানে দুঃখ পাওয়া সেই তরুণটি তার বন্ধু উইলহেলমকে বলছে যে একাকী কেবিনে কীভাবে সে নিজেকে সুখী ভাবতে শুরু করেছে।

আমার নিজেরই দশা আসলে এমনই। কাজেই এমন ঘটনা মোটেই বিরল নয়, যখন কারো সাথে পরিচিত হওয়া মাত্রই আমি জিভ কামড়ে নিজেকে প্রশ্ন করা থেকে বিরত রাখিঃ ‘বলেন তো ভাই, মানে, উপন্যাস জিনিসটা আপনি কীভাবে লেখেন?’

সাহায্য সূত্র
আমি কোনো বইতে পড়েছিলাম, কিংবা সিনেমায়ও দেখে থাকতে পারি, অথবা কেউ হয়তো আমাকে বাস্তবে বলেছিলো এরকম একটা ঘটনাঃ নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তা সমস্ত আইন ভেঙে তার প্রেমিকাকে লুকিয়ে ঢোকায় এক যুদ্ধ জাহাজের কেবিনে, তারপর চারপাশের সমস্ত বাঁধা উপেক্ষা করে তারা সেখানে প্রেম করে যায়, কয়েক বছরের আগে ব্যাপারটা কারো কাছে ধরাও পড়েনি। আমি পরিচিত সকলের কাছে অনুনয় করলাম, যে এই গল্পের লেখককে চিনলে যেন তারা আমাকে সেটা দ্রুত জানায়। কিন্তু অনেক মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করার পরেও যখন কোনো উত্তর পেলাম না, আমার সন্দেহ হওয়া শুরু হলো, যে গল্পটা আসলে আমিই বানিয়েছি এবং তারপর ভুলে গেছি।

ধন্যবাদ।

জানুয়ারি ২৫, ১৯৮৪, মাদ্রিদ।

[কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাংবাদিকতা জীবন প্রায় তিন দশকের। দীর্ঘ এই সময়কালে তার রচিত প্রতিবেদনধর্মী রচনাগুলোর মাঝ থেকে বাছাই করা ৫০টা নিয়ে কিছুদিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ‘দা স্ক্যান্ডাল অফ দা সেঞ্চুরি’ নামের এক সংকলন। ওপরের লেখাটি  সেই সংকলন থেকে অনুদিত। ]

প্রিয় পাঠক,
কয়েক বছর ধরে একক শ্রমে গড়ে তোলা এই ওয়েবসাইটকে আমি চেষ্টা করেছি অগণিত বাংলাভাষী ওয়েবপোর্টালের মাঝে স্বতন্ত্র করে তুলতে। নানা স্বাদের এসব লেখা নির্মাণে আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। এছাড়াও, পাঠক, আপনি এসব লেখা পড়তে পারছেন কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই।

কাজেই প্রিয় পাঠক, স্বেচ্ছাশ্রমের এই ওয়েবসাইট চালু রাখতে প্রয়োজন হচ্ছে আপনার প্রণোদনার। আমরা চাইঃ এই সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় আপনাকে, কিংবা আপনার উপকারে আসে- সেক্ষেত্রে ০১৭১৭ ৯৫৩০৮৭ (Personal) নাম্বারে বিকাশ (bKash) করে আপনি প্রণোদনা দিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন।

আপনার সামান্য উৎসাহ বাংলাভাষী অন্তর্জালকে করে তুলতে পারে আরও আকর্ষণীয় লেখায় সমৃদ্ধ!