লেখালেখি

২০২৩ এর বইঃ যে জীবন আমার ছিল

[২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আশা করি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ চালু থাকবে বছর জুড়েই। ধারাবাহিকের আজকের পর্বে থাকলো ইমদাদুল হক মিলনের আত্মজীবনী ‘যে জীবন আমার ছিল’ নিয়ে আলাপ।]

লেখকের মৃত্যু ঘটে দুই রকমে।

এক রকমের মৃত্যু তার দৈহিক মৃত্যু, লেখক যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য হলে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের এই মৃত্যুদিনটি মুখস্ত করতে হয় অবজেক্টিভে গোল্লা ভরাটের জন্য। আর দ্বিতীয় মৃত্যুটি লেখকের রচনার মৃত্যু, তার রচনা তখন প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে পাঠকের কাছে। বলা বাহুল্য, সত্যিকার লেখকের জন্য এই মৃত্যুটাই করুণতম।

ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে চারপাশে যে সব আলোচনা শুনি, তার অধিকাংশ জুড়ে- আজ নয়, অন্ততঃ গত এক দশক ধরেই- থাকে কেবল অবজ্ঞা, উপহাস। সুদূর প্রাইমারি স্কুলে যার রমাকান্ত কামার আর নিমপাখির ভৌতিক গল্প কিছুটা হলেও আলোড়িত করেছিলো পাঠককে, টিভি নাটকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মনোপলি বিরাজ করা সময়ে যার রচিত সংলাপ ছিলো ঘুরতো আমাদের মুখে মুখে- সেই লেখককে নিয়ে টিটকারিময় এসব মকারি শুনতে শুনতে মনের কোথাও আজকাল বদ্ধমূল হয়ে গেছে একটা ধারণা, যে নতুন করে আর কিছুই দেবার নেই এই লেখকের। অন্যভাবে বলতে গেলে- সাহস করে বলেই ফেলি- পাঠকের মনে হয়ঃ ইমদাদুল হক মিলনের দ্বিতীয় মৃত্যুটি ঘটেই গেছে, তিনি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন।

অথচ পাঠক মাত্রই জানে যে তার ভুল হতে পারে। ফলে, বিজ্ঞাপণে যখন দেখা যায় ‘যে জীবন আমার ছিল’ নামের বইটিকে প্রচার করা হচ্ছে ইমদাদুল হক মিলনের আত্মজীবনী হিসেবে, সেটাকে সংগ্রহ করতে আমি তাই দ্বিধা করি না। লেখকের আত্মজীবনী মানে তো তার লেখার জীবনে কিছুটা হলেও চোখ রাখার সুযোগ- তুমুল পাঠকপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সেই লেখার কারখানার বায়োস্কোপের টিকিট কাটতে আমি সত্যিই ভীষণ আগ্রহী ছিলাম।

আগ্রহ কি মিটলো বইটা পড়ে? এক কথায় বলতে গেলে, না।

অনুমিত ভাবেই শৈশব থেকে শুরু হয় মিলনের আত্মজীবনী, তার সেই মেদিনীমণ্ডল গ্রামের শৈশব থেকে। কিন্তু, খেয়াল করি আক্ষেপ নিয়ে, প্রথম পাতা থেকেই লেখাটাকে মনে হয় নিতান্ত হেলাফেলা এক রচনা। যেন নিজের জীবন নয়- একটা হালকা উপন্যাসের কোনো চরিত্রের জবানে লিখছেন লেখক। তার মাঝে আবার অবিরাম আসতেই থাকে ‘অমুক বাড়িটি/গাছটি/লোকটির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছি আমার তমুক উপন্যাসে’ গোছের বাক্যবন্ধ। প্রথম ৮ পাতায় অন্ততঃ ৩ বার অমন প্রচারণা চলে আসার পর পাঠক বুঝে যায়- চিরস্থায়ী একটা বিরক্তি অগ্রাহ্য করেই তাকে এই তিনশো পাতা শেষ করতে হবে।

মোটাদাগে চলনসই বর্ণনায় এগোতে থাকে মিলনের স্মৃতিচারণ। সেন্টুদার সাথে মাছ ধরা, সাপ মারা- এসব নিয়ে তার অতীতচারণ খুব খারাপও লাগে না। কিন্তু প্রিয় লেখকদের যেসব আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে আমরা মোহিত হয়ে রই, তাদের পাশে রীতিমতো ফেলুদার সঙ্গী হয়ে থাকা লালমোহনবাবুর মতো এলোমেলো লাগে উদ্দিষ্ট রচনাকে। শৈশব থেকে কী এক উদ্ধৃতির সূত্র ধরে তিনি যান শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়তে, সেখান থেকে গঁদারের জাম্পকাট মেরে অ্যানেকডোট মারেন বিভূতিভূষণের খাদ্যভ্যাস নিয়ে।

লেখকের আত্মজীবনীতে পাঠক অবধারিত ভাবে জানতে চায় কীভাবে তার মাঝে গড়ে উঠলো সাহিত্য পড়ার অভ্যাস, তার পড়া প্রিয় বইগুলো কী কী, কে কে তাকে প্রভাবিত করলো লেখক হয়ে উঠতে- এইসব। মিলনের এই লেখায় সেগুলো উপস্থিত আছে ঠিকই, তবে অনুপস্থিত বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। উদাহরণ হিসেবে আসতে পারে ‘নূরজাহান’ -এর কথা, ইমদাদুল হক মিলন সম্ভবত নিজের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি বলে গণ্য করেন ওই উপন্যাসটিকে। কীভাবে এই উপন্যাসের চিন্তাবীজ তার মনে আসে, কী উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তিনি লেখা শুরু করেন এই উপন্যাস; খানিক এলোমেলো হলেও বেশ বিস্তারিত ভাবে সেটা এসেছে এই আত্মজীবনীতে। কিন্তু, যখনই সেই বিবরণ পাঠকের ভালো লাগতে থাকে, যখনই তার মনে হয় যে এবার বাহ্যিক আবরণ সরিয়ে লেখকের অন্তর্যাত্রার দেখা পাওয়া যাবে, ঠিক তখনই সমস্ত আশা গুঁড়িয়ে মিলন ব্যক্ত করতে থাকেন ‘নূরজাহান’ উপন্যাসের পৃষ্ঠা সংখ্যা, কতদিনে বইটার প্রথম মুদ্রণ শেষ হলো, কত কপি বিক্রি হলো সেই বইয়ের – তেমন সব কেজো আলাপ।

লেখার টেবিলে মিলনের ভঙ্গুর সৃষ্টিশীল সত্তাটার সাথে তাই উদ্দিষ্ট বইতে পাঠকের মোলাকাতই হয় না। হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠা পাবার আগে অভাবের সাথে লেখকের সংগ্রাম করার সেই পুরোনো গল্পটা অবশ্য ছক মেনে থাকে, কিন্তু গলির মোড়ের ভিখারির মতোই সেটা কি বহুদিন আগেই আমাদের চোখে সয়ে যায় নি? মনেও তাই ওটা দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়। তখন চেষ্টা করি অন্যভাবে এই বই থেকে কিছু পেতে।

সেটা কেমন?

নিশ্চিত জানি, ‘রাজার চিঠি’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ বা ‘কিরমান ডাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় জীবন’ নামের চমৎকার গল্পগুলোর রচয়িতা ইমদাদুল হক মিলনের আত্মজীবনী পড়তে বসার সময় যে কোনো পাঠকের মনের ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকবে আরেকটা উদ্দেশ্যঃ তার সমকালকে জানা। অন্যভাবে বললে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত লেখকের সাথে উঠবোস করেছেন মিলন, টিভি নাটকের আঙিনাতেও তার পদচারণা ছিলো আওয়াজময়। দীর্ঘ জীবনে নানা রকম মানুষের সংস্পর্শে আসা হয়েছে তার। পাঠক হিসেবে প্রত্যাশা ছিলো সেখান থেকে বর্ণময় কিংবা আলোকিত কিছু মানুষের স্মৃতিচারণ মিলন তুলে আনবেন তার এই জীবনীতে।

অথচ সেদিক থেকেও এই রচনাটি মনে দাগ কাটলো না। অজস্র নামী মানুষের উল্লেখ আছে বইতে, কিন্তু তাদের নিয়ে বলতে মিলন যথেষ্টই কৃপণ ছিলেন। তার মাঝেও টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ক্যামিও দিয়ে গেছেন শ্যামল গাঙ্গুলী, আবুল হাসনাত, রফিক আজাদ, কিংবা হুমায়ুন ফরিদী; ধ্রুপদী কোনো টেস্ট ইনিংস হয়ে ওঠেনি কাউকে নিয়ে আলোচনাই। কিন্তু, স্বীকার করতে হবে, বইয়ের শেষ এক-তৃতীয়াংশে ওসব এলেমেলো স্মৃতিচারণ সংখ্যা বেশি বলে ওই অংশটা খানিকটা বেশি আগ্রহ নিয়ে পড়া হয়।

শ’তিনেক পাতার বইটা শেষ করে যখন পাঠক হিসেবে একরাশ বিরক্তি আর হতাশা বোধ করি, তখনও অনুভব করি- ‘যে জীবন আমার ছিল’ নিয়ে কিছু একটা বলার ইচ্ছে প্রকট হয়ে উঠেছে ভেতরে। নাহ, ইমদাদুল হক মিলনের প্রতি একপেশে বিষোদ্গার সেটা নয়, সেটা বরং আরও ব্যক্তিগত এক বেদনাবোধ।

একটা পুরোনো গ্রামোফোনের মতোই বেদনাদায়ক একজন ফুরিয়ে যাওয়া লেখককে প্রত্যক্ষ করা। সময়ের সামনে অন্য সকলের মতোই একজন লেখক, সে যে-ই হোক, কতটা অসহায়, তা জেনে তীব্র বিষাদ বোধ করি তাই। তখন শোক করি- ফেলে আসা সময়ের কারণেই, লেখক বিশেষের দ্বিতীয় মৃত্যুর কথা জেনে নয়।

[এপ্রিল, ২০২৩]

Previous

২০২৩ এর বইঃ জবরখাকি

Next

‘আপনি কীভাবে উপন্যাস লেখেন?’

1 Comment

  1. আতিয়া সুলতানা (নীলা)

    ইমদাদুল হক মিলন কেন হঠাৎ বলতে গেলে হারিয়েই গেলেন এটা জানার আগ্রহ ছিলো খুব। এই বইটার কথা একবার কারো মুখে শুনেছিলাম কিন্তু পরে ভুলে গিয়েছিলাম। কেনা হয়নি, তবে আপনার লেখা পড়ে বুঝলাম না কিনে খুব একটা ক্ষতিও হয়নি। লেখা চালিয়ে যান। পড়ি কিন্তু কমেন্ট করা হয়না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress & Theme by Anders Norén

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: