[২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আশা করি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ চালু থাকবে বছর জুড়েই। ধারাবাহিকের আজকের পর্বে থাকলো বর্ণালী সাহার গল্প-সংকলন ‘জবরখাকি’ নিয়ে আলাপ।]

(১)
যুগটা এখন পলিটিকাল কারেক্টনেসের, বাংলা সিনেমার মতো ড্রেসিং-গাউন গায়ের পাইপ টানা চৌধুরী সাহেবদের হাতে অনলাইনে লেখকদের নিল-ডাউন হবার দৃশ্য আজকাল অতি পরিচিত। ইদানিং নাকি ‘লোলিতা’ লেখার জন্য নবোকভকেও ডাকা হচ্ছে শিশুকামী বলে।

কিন্তু সাহিত্যের কাজ কি এসব পলিটিকাল কারেক্টনেসের  গুষ্টি মেরে ব্যক্তিগত অনুভূতির অস্বাভাবিকতাকেই আবিষ্কার করা নয়? অন্য দশজন যা এড়িয়ে যাচ্ছে স্বভাব বশে, লেখকের কাজ কি চিরকাল সেখানেই নজর রাখা না? উদাহরণ হিসেবে যদি প্রেম বিষয়টাকেই বেছে নেই; হাত ধরে রমনা পার্কে বসে বাদাম খাওয়া আর প্যারিসের রাস্তায় কাব্যিক ও কোটেবল বাক্য উচ্চারণের বাইরেও কি সেই প্রেমের একটা কালো রুপ নেই? এমনও তো প্রেম আছে, যা ভেঙে গেলে ছোঁড়া হয় এসিড আর অনলাইনে ছেড়ে দেওয়া হয় ভিডিও? সেই সব অস্বাভাবিকতার গল্প বলাটাও কি লেখকের কাজ নয়?

উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ বলেই বিশ্বাস করি। আর বর্ণালী সাহার উদ্দিষ্ট সংকলনটা এজন্যেই আলাপের দাবি রাখে। পলিটিকাল কারেক্টনেসের টাইটেনিয়াম বর্মের নিচে যে বোধগুলোর টানাপোড়েন আমাদের অবিরাম তটস্থ রাখে; একটা হ্যাশট্যাগ হয়ে যাবার ভয়ে নিন্দনীয় যে সব অভিজ্ঞতা, লোভ আর অনুভূতি আমরা ঢেকে রাখি চৌধুরী সাহেবদের সমাজে- ‘জবরখাকি’ বইয়ের গল্পরা মোটা দাগে তাদেরকেই কেন্দ্র করে ঘুরে গেছে।

(২)
সংকলনের প্রথম গল্পের নাম ‘লিম্বো’। বইয়ের দীর্ঘতম গল্পও সেটাই।

আমেরিকান পাসপোর্টধারী এক বাঙালি পরিবার ছুটি কাটাতে এসেছে কোনো দ্বীপে, সেখান থেকে পালিয়ে তাদের ধার্মিক পুত্রটি যাত্রা করেছে সিরিয়া বরাবর। গল্পের পটভূমি এটাই। লেখক বর্ণালী এর মাঝেই মুন্সিয়ানা দেখালেন। পুত্রের বিপ্লব-স্পৃহা অথবা মায়ের পুত্রশোক- এই মোটা দাগের অনুভূতির স্কেলের বাইরে গিয়ে তিনি নিয়ে এলেন সেই অসুখী দম্পতির ভেতরের রসায়ন। পরিবারের বাইরের মানুষেরা, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়- কীভাবে তারা ছায়া বিস্তার করতে লাগলো ওই আসমা-মনসুর দম্পতির মিথস্ক্রিয়ায়, সেটাও গল্পকারের বয়ানে হয়ে উঠলো এই গল্পের অন্যতম আকর্ষণ, কখনো কখনো বর্ণনা একটু দীর্ঘ বলে লাগা সত্ত্বেও।

এই দিয়েই শুরু বইটা। আরেকটু এগোলে পাঠক খেয়াল করতে পারেঃ পটভূমি, চরিত্র, ভাষায় আলোচ্য গল্পটা হয়ে ওঠে বইয়ের বাদবাকি গল্পের একরকমের বিজ্ঞাপণ।

বর্ণালীর সব গল্পেই চরিত্ররা ব্যক্তিগত সমস্যায় ভুগেছে। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত ঝামেলারা নিজের কালের, ভূগোলের বেশ স্পষ্ট একটা বুদবুদের ভেতরে বসে ঝিমায়। হঠাৎ কোনো ঘটনায় সেই বুদবুদে বিস্ফোরণ ঘটে, আর চরিত্ররা ছিটকে বেরোয় সংকট মোকাবেলায়। খেয়াল করা দরকার, অধিকাংশ গল্পেই কালটা যেহেতু পাঠকের সমকাল, ফলে- সীতাকুন্ডের দুর্ঘটনার মতোই – ওই বিস্ফোরণটাও তার কাছে হয়ে যায় সমসাময়িক। সেটার সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পাঠকের তখন সময় লাগে না।

ইয়াবা পাচার থেকে চৈনিক রকেট হামলা, দুনিয়ার নানা প্রান্তের বুড়ি ছুঁয়ে এলেও- বর্ণালীর গল্পেরা আমাদের কাছে টিকটক রিলের মতোই অতিপরিচিত হতে পারে মুহুর্তে।

(৩)
বইয়ের সেরা গল্প বলে মনে হলো নামগল্পটাকে- ‘জবরখাকি’। সমকামী এক মেয়ে, শৈশবের দুই বান্ধবীর সাথে তার সম্পর্কের ত্রিভুজটা এখানে উঠে এলো মধ্যবয়েসের জীবন পর্যন্ত। যৌন সম্পর্ক কি যৌন ঈর্ষার মতো খাঁটি ব্যক্তিগত অনুভূতিকে কেন্দ্রে রেখেও এই গল্পে আবছাভাবে ধরা দিলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেশ পুরোনো এক রাজনৈতিক আলাপ, প্রায় রসিকতার ভঙ্গীতে। ভাষা, আয়তন কি কৌতুকী রসবোধ- শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই গল্প টানটান; আধুনিক বৈশ্বিক গল্পের রীতিমতো টেক্সটবুক উদাহরণ।

আলাদা করে বলতে হয় ‘মনোভূমি’ গল্পটার কথাও। থ্রিলার ঘরানার লেখকেরা আজকাল প্রায়ই পুরাণ-আশ্রিত গল্প ফাঁদেন, তবে ধারে ও ভারে সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুতোষ রচনার গন্ডীর বাইরে যেতে গেলেই পড়ে যায় অফসাইডের ফাঁদে। অথচ রামায়ণকে আশ্রয় করা বর্ণালির উদ্দিষ্ট গল্পটি এক্ষেত্রে এমবাপ্পের মতোই দুর্দান্ত। সীমান্তের কোনো শহরকে কেন্দ্র করে এগোনো কালো-অন্ধকারাচ্ছন্ন এই গল্পটার শেষে থাকলো থ্রিলারের মতোই দুর্দান্ত এক মোচড়।

(৪)
খুব বেশি মন টানেনি ‘শেষ অঙ্ক’ গল্পটা। মাঝামাঝি পর্যন্ত যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলো, শেষটায় যেন সেটা ঠিক পূরণ হলো না।

এমন গল্প আরেকটা আছে, ‘চশমে ক্বাতিল’। শেষ পর্যন্ত মূল গল্পটা এখানে পাঠকের কাছে দূরের কেউ থেকে যায়। কিন্তু, উল্লেখ করার মতো ব্যাপার, এই গল্পে আগাগোড়া পর্দার পেছনে ওঁত পেতে ছিলো যে সময়কাল- সেই ১৯৭১ সালটাই পাঠকের মাথায় ঘুরঘুর করতে থাকে। মনে হতে থাকে, বর্ণালী বোধহয় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে কিছু একটা লিখলে বেশ ভালোই করবেন।

বইয়ের মাঝামাঝি অংশে থাকা ‘জাঙ্গলিক’ গল্পটি, পাঠকের সেই প্রত্যাশা পূরণ করে বেশ ভালোভাবেই। শুরুতে যে গল্পকে মনে হচ্ছিলো কোনো শুটিং ইউনিটের কাহিনি, বেশ দক্ষতার সাথে বর্ণালী সেটাকে করে তোলেন আমাদের অতিচেনা গড়পারের মানিক সংশ্লিষ্ট একটি কাহিনি। নামের ভিন্নতা থাকলেও ঐতিহাসিক চরিত্রদের চিনতে পাঠকের কিছুমাত্র কষ্ট হয় না তখন। চেনা-জানা মানুষদের নিয়ে গল্প পড়ার সেই স্বাদ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাবার মাঝেই গল্পকার নিয়ে আসেন একটি চরিত্রের লুকিয়ে রাখা ঈর্ষা, আরেকটি চরিত্রের আড়াল করা ক্ষোভ। মানুষের ‘অস্বাভাবিকতা’ খুঁজে দেখার আরেকটা সফল অভিযান সম্পন্ন হয় তখন সেই শ্য্যুটিং বাড়ির দিনরাত্রিতে।

(৫)
পর্যবেক্ষণ বলেঃ কোনো লেখকের রচনা একবার মনে আসন করতে পারলে, দারুণভাবে- এবং একাধিকবার- হতাশ না করা পর্যন্ত পাঠকেরা ঠিকই ফিরে ফিরে যায় সেই লেখকের কাছে।

‘দা নর্থ এন্ড’ উপন্যাসে আবিষ্কার করা গিয়েছিলো যে বর্ণালী সাহাকে, ‘জবরখাকি’ পড়া শেষে অনুভব করি, তার প্রতি মুগ্ধতায় এতটুকু খাদ পড়ে না। বরং মনে হয়, ঔপন্যাসিক বর্ণালীর সীমানাকে গল্পকার বর্ণালী যেন আরেকটু বিস্তৃত করে নিয়েছে। একশো চল্লিশ ক্যারেকটারের সমান মনোযোগ নিয়ে ঘোরা পাঠক তাই উপলদ্ধি করে, ভবিষ্যতেও এই লেখকের বই কিনতে সে কনুই মেরে ঢুকতে পারে ভিড়ের মাঝে।

আশা করা যায়, এমনকি ড্রেসিং গাউন পড়া চৌধুরী সাহেবরাও ড্রইংরুমের দোতলা থেকেই স্বাগত জানাবেন এই লেখককে। ‘ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত প্রবেশে অতিনিরাপদ বোমা বানানো’ দেখার জন্য ‘সুশীলভাবে টিকেট কেটে এই তামাশা দেখার’ এমন সুযোগ চট করে আর পাওয়া নাও যেতে পারে।

[মার্চ, ২০২৩]