আত্মজীবনী ঘরানার রচনা In Sensorium : Notes for my people এর জন্য সম্প্রতি কারকাস রিভিউ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তন্বী নন্দিনী ইসলাম, যিনি লেখেন তানাইস (TaNaIs) নামে। অনলাইনে খবরটা চোখে পড়তে ভালো লাগে দুই কারণে। (১) বইটা সদ্য পড়া হয়েছে আমার। নিজের পড়া আর ভালো লাগা কোনো বই যদি সাহিত্য পুরস্কার পায়, কোন পাঠকের তা ভালো না লাগে! (২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা তানাইস মূলত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।

সত্যি বলতে, দ্বিতীয় কারণটাই মুখ্য। তানাইসকে চিনতে, তার লেখার জগতের খোঁজ পেতে হয়তো আরেকটু দেরি হতো আমার; যদি না তিনি আমাদের এক সুহৃদের আত্মজা হতেন। ফলে তানাইসের উল্লিখিত বইটা এক পরিচিতজনের কাছে দেখতেই হস্তগত করতে আমি দেরি করি না। স্বীকার করি, বয়েসে তিনি পাঠকের প্রায় সমসাময়িক বলেও তার গল্প শোনার জন্য বাড়তি একটা আগ্রহ কাজ করে। দেখতে চাই, দুনিয়ার আরেক প্রান্তে বসে ঠিক কোন চোখে তিনি দেখছেন পৃথিবীকে।

ওভাবেই শুরু হয় In Sensorium : Notes for my people – এর সাথে আমার ভ্রমণ।

আবিষ্কার করি, নানুর পান খাবার যে স্মৃতি আমার শৈশবেরও অবিচ্ছিন্ন এক অংশ, সেই স্মৃতিকে অপূর্বভাবে তুলে এনে শুরু হয়েছে বইটা। বইয়ের সূচনা কোভিড প্যানডেমিকের কাল, যখন ভাইরাস আক্রান্ত মানুষ কোনো গন্ধ পাচ্ছে না। কিন্তু গন্ধ বা ঘ্রাণ যেহেতু লেখকের কাছে পৃথিবীর সাথে সংযোগ স্থাপনের একটা ভাষা, তিনি তাই নিজেকে বোধ করেন বিচ্ছিন্ন, অচ্ছুত; ঠিক যেমন অরুন্ধতী রায়দের বইতে মানচিত্রে অচ্ছুত হয়ে থাকে বাংলাদেশ, ভারতবর্ষের মাঝে যার জায়গা হয় না। ওভাবেই শুরু, তারপর তানাইস- নিজেও যিনি স্বশিক্ষিত পারফিউমার- শুরু করেন সুগন্ধীর ইতিহাসের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে, নিজের বর্তমান অবস্থানকে তুলে আনা।

বইটার একটা বড় অংশ আত্মপরিচয়ের রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে এ যুগের বর্ণবৈষম্য, চাকরি পাবার হ্যাপা- এসব ব্যাপার উঠে এসেছে বইয়ের প্রথমাংশে। বাদামি চামড়া দেখে লোকে তাকে ভারতীয় বলে ডাকে, কিন্তু ভারতীয়রা ঠিকই দূরে ঠেলে রাখে বাংলাদেশি মুসলিমদের- এ সব ব্যাপারে তানাইস লিখেছেন রাখঢাক না রেখেই। গায়ের রঙ নিয়ে বাংলাদেশে কথা শোনা, ভারতের জাতের প্রথা, উন্নত বিশ্বের বর্ণ আর লৈঙ্গিক বৈষম্য- তানাইসের বয়ানে এরা যেতে থাকে মিলে মিশে।

দারুণ, সত্যিকার অর্থেই দারুণ গদ্য লেখেন তন্বী। কিন্তু সেই উৎকর্ষতা ছাপিয়ে তার বই নিয়ে এক শব্দে বলতে গেলে ব্যবহার করতে হয় আরেকটা বিশেষণঃ সাহসী। তন্বীর এই আত্মজীবনী অকপট এবং সাহসী।

নিজ ইতিহাস, আচার বা সংস্কৃতির ব্যাপারে যে কোনো দেশের নাগরিকের চোখেই একটা আরোপিত বুদবুদ থাকে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সেই বুদবুদের ক্ষুদ্রত্ব অনুধাবন সবাইকে দিয়ে হয় না। তানাইস কিন্তু – খেলার মাঠের বাইরে বসে থাকা দর্শকের মতোই – বাংলাদেশকে দেখেন কোনো রকম চশমা ছাড়া। ফলে তার লেখা থাকে গদগদে ভাব থেকে মুক্ত, পাঠক বেশ একটা ঝাঁঝালো অনুভূতি পায় সেখানে। সেই সাথে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, বিহারী নির্যাতন, পাহাড়িদের প্রতি অবিচার, ওয়াসফিয়া নাজরীন, এমনকি হলি আর্টিজান- বাংলাদেশের টুকরো ইতিহাসের অনেকটাই উঠে আসে তানাইসের নোট, বা চিরকুটে। নানা ভাবে নানা জায়গায় উচ্চারিত হয়েছে বলে অবশ্য বইয়ের এই অংশটা বাংলাদেশি পাঠকের কিছুটা অতি ব্যবহৃত ঠেকে। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে তানাইসের রচনা কেবল বাংলাদেশি পাঠকের জন্য নয়, Notes for my people নামটা তাই আমার কাছে ধরা দেয় ‘তোমাদের জন্য চিরকুট’ অনুবাদে। তানাইসের ওই ‘তোমরা’ তো বাংলাদেশি, ভারতীয়, এমনকি মার্কিনিরাও!

রাজনীতির এসব বিভাজন যদি দূরে ঠেলে দেয় মানুষকে, লেখক হিসেবে তানাইস তবে তার উৎকর্ষ নিশ্চিত করেন বইয়ের অন্য অংশটায়। যখন তিনি বলেন নিজেকে আবিষ্কারের টানাপোড়েনের গল্পঃ ভারতীয় তথা বাংলাদেশি হিসেবে, নারী হিসেবে, মানুষ হিসেবে। বাবার গল্প, মায়ের গল্প, ভালোবাসা পাওয়া, হারানো কিংবা ভালোবাসা আবিষ্কারের গল্পগুলো বলতে গিয়েই তানাইস হয়ে পড়েন আমাদের চেনা একজন দুঃখী মানুষ।

ভিনভাষী লেখক তানাইসকে তাই, In Sensorium : Notes for my people পড়া শেষে আরেকটু কাছের মানুষ বলে মনে হয়। এমন কাছের কেউ, যার গল্প শুনতে আবার অপেক্ষা করতে পাঠক রাজি থাকে।

[নভেম্বর, ২০২২]