০১।
ধরা যাক, অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিন হঠাৎ অভ্যুত্থানে বদলে গেলো ‘গিলিয়াড’ নামের কোনো প্রজাতন্ত্রে। তারপর সামরিক জান্তা সেই প্রজাতন্ত্রকে ক্রমশ বদলে দিলো চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদী আর পুরুষতান্ত্রিক এক রাষ্ট্রে। গিলিয়াড রাষ্ট্রে সবচেয়ে নাজুক অবস্থান হলো নারীর, কেড়ে নেওয়া হলো তার সন্তান জন্মদানের অধিকার। দুঃস্বপ্নের এখানেই শেষ নয়, নারীদের এবার কাজে লাগানো হলো কেবল শাসক শ্রেণীর জন্য সন্তান উৎপাদনের কাজে…।
মার্গারেট অ্যাটউডের দুনিয়া-বিখ্যাত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস ‘দা হ্যান্ডসমেইড টেইল’ এর কাহিনি এগিয়ে গেছে এভাবেই, পাঠককে ক্রমাগত অস্বস্তি দিয়ে। কুঁচকানো ভুরু আর মৃদু আতঙ্ক নিয়েও পাঠক কিন্তু ঠিকই পড়ে গেছে কাল্পনিক রাষ্ট্র গিলিয়াডের গল্প, এবং একরকম উপভোগও করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতের বিকৃত একটা রুপ দেখানো এই ধরনের কল্প-সাহিত্য (ফিকশন) পড়তে কেন ভালো লাগে পাঠকের? কেন স্বস্তির চাইতে অনেক বেশি অস্বস্তির সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হলেও ডিস্টোপিয়ান ফিকশনরা আমাদের আনন্দ দেয়?
কারণ সম্ভবতঃ এই ঘরানার রচনায় একটা সতর্কবাণী থাকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। ডিস্টোপিয়ান রচনা পড়তে গিয়ে ক্রমাগত অস্বস্তির থাপ্পড় খাওয়া পাঠক অনুভব করে, চারপাশের বর্তমান যেন ওই ভবিষ্যতের পথে না যায়- সে জন্য এখনো কিছু করণীয় আছে তার। আজকের সমাজ-সভ্যতা-রাষ্ট্রের অমুক ত্রুটি নিয়ে কাজ করা গেলে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে তমুক ব্যাপারটা ডিস্টোপিয়ার জন্ম দেবে না; এমন একটা ভাবনায় পাঠক স্বস্তি বোধ করে, আনন্দ পায়।
আর যেহেতু গাছে গাছে কোকিলের ‘কোকেইন! কোকেইন!’ বলে চিৎকার করার এই মোহময় পৃথিবী ইদানিং অজস্র সমস্যায় টইটম্বুর, দেশে-বিদেশে পাঠকের কাছে তাই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের আবেদন। কেবল বইয়ের পাতায় আটকে না থেকে এই ঘরানার গল্পরা এখন হয়ে উঠেছে লোকসংস্কৃতির অংশ পর্যন্ত। হলিউডের ‘হাঙ্গার গেইমস’, কিংবা পাশের দেশ ভারতে তোপের মুখে পড়া ওয়েব-সিরিজ ‘লায়লা’; সবখানেই পর্দার হাত ধরে ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের ধারা ক্রমশ হয়ে উঠছে আরো স্বাস্থ্যবান।
০২।
আলাপে আরো ভেতরে যাবার আগে পরিষ্কার করা দরকার ‘ডিস্টোপিয়ান’ ব্যাপারটা বলতে আমরা কী বুঝবো।
উত্তরটা সহজ। স্বর্গরাজ্য কিংবা রামরাজত্বের মতো আদর্শ কোনো রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন, সেই ব্যাপারটাকে যদি ‘ইউটোপিয়া’ বলে ডাকা হয়, সেক্ষেত্রে তার বিপরীত ধারণাটাকেই আমাদের ‘ডিস্টোপিয়া’ (নরকরাজ্য?) বলতে হবে। আরেকটু ভেঙে বললে, সক্রেটিস যখন তার আদর্শ রাষ্ট্র ধারণার (অর্থাৎ, ইউটোপিয়া) কথা বলেছিলেন, সেটার ভিত্তি হিসেবে তিনি রেখেছিলেন ন্যায়বিচার-কে। অর্থাৎ ইউটোপিয়ান রাষ্ট্র মানেই সেখানে সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। ইউটোপিয়ার বিপরীত ধারণা হিসেবে ডিস্টোপিয়া তাই – বোঝাই যায় – এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে গোটা বিচারব্যবস্থাটাই ন্যায়ের বদলে অন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত, বিচার যেখানে প্রহসন।
মোটা দাগে ডিস্টোপিয়ান রচনায় আমরা তাই দেখি। কল্প-সাহিত্যের এই ধারায় সমাজের প্রতিটি মানুষকে অবিরাম তটস্থ হয়ে থাকতে হয় অদ্ভুত সব নিয়ন্ত্রণবাদী আইনের ভয়ে, অনবরত তাদের ঠেলে দেওয়া হয় প্রহসনের বিচারের মুখোমুখি। পাঠক দেখে, ডিস্টোপিয়ান সমাজে ক্ষমতাকাঠামো কিংবা সর্বশক্তিমান কর্তৃপক্ষের হাতে ক্রমাগত বলি হতে থাকে ব্যক্তি মানুষ এবং ন্যায়বিচারের ধারণা।
০৩।
পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ডিস্টোপিয়ান রচনাগুলো কী কী?
প্রশ্নটা করা মাত্র খোঁজখবর রাখা পাঠকের মুখের আগায় চলে আসে জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ কিংবা রে ব্র্যাডবেরির ‘ফারেনহাইট ৪৫১’ এর কথা। তবে ডিস্টোপিয়ান রচনার রীতিমতো প্রবাদপুরুষ বলে খ্যাতি পাওয়া অরওয়েল নিজে যে উপন্যাস দ্বারা তুমুল প্রভাবিত- ইয়েভগেনি জামিয়াতিন এর সেই ডিস্টোপিয়ান রচনা ‘উই’ (We)-এর কথা অবশ্য অধিকাংশ পাঠকের অজানা।
দুনিয়ার সর্বপ্রথম ডিস্টোপিয়ান রচনা ও রচয়িতা?
গবেষক এরিকা গটিলেব এ প্রসঙ্গে বলছেন,
যদি দাবি করা যায় যে ‘সমস্ত রাশান উপন্যাসই বেরিয়েছে গোগলের ওভারকোটের পকেট থেকে।’ তবে একইরকম দৃঢ়তা নিয়ে এ কথাও বলা যায়ঃ বিংশ শতাব্দীর সমস্ত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের জন্ম হয়েছে দস্তয়েভস্কির ‘দা ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসের ‘দা গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ অধ্যায় থেকে।
ভেবে দেখলে কথাটা তো সত্যিই! কারণ দুনিয়ার বিখ্যাত সব ডিস্টোপিয়ান রচনায় ব্যবহৃত ছক তো একটাইঃ কর্তৃপক্ষের আরোপ করা কোনো আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নায়ক, একদল ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যহীন লোকের সামনে একটা প্রহসনের বিচার, আর শেষে নায়কের কর্মফল ভোগ। আর ধ্রুপদী উপন্যাসের পাঠক মাত্রই জানে, ‘দা গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর’ অধ্যায়ে ইভান কারামাজভের মুখ দিয়ে দস্তয়েভস্কি তেমন একটা গল্পই আমাদের শুনিয়েছেন।
০৪।
গোছালোভাবে ডিস্টোপিয়া প্রসঙ্গে পড়াশোনা করতে চাইলে ভালো প্রাথমিক পাঠ হতে পারে এরিকা গটিলেবের একটা বইঃ ‘ডিস্টোপিয়ান ফিকশনঃ ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট (ইউনিভার্স অফ টেরর এন্ড ট্রায়াল)’।
শিরোনামে প্রাচ্য থাকলেও, সাহেবদের বদভ্যাস মোতাবেক এরিকা নিজের জগতকে করে তুলেছেন ছোট, উদ্দিষ্ট বইতে তিনি তাই কেবল ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় ডিস্টোপিয়া রচনা ধারাটার ক্রমবিবর্তন নিয়েই আলাপ জুড়েছেন। সুনির্দিষ্ট করে উত্তর আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর ডিস্টোপিয়ান রচনাদের তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘পশ্চিমা ডিস্টোপিয়া’ বলে; আর ইউরোপের পূর্ব দিকটার- আরো নির্দিষ্ট করে বললে প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লকের অন্তর্গত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর- রচনাদের এরিকা বলেছেন ‘প্রাচ্যের ডিস্টোপিয়া’।
দুনিয়া-বিখ্যাত ডিস্টোপিয়ান রচনাদের সবগুলোই এরিকার শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী পশ্চিমে রচিত।
০৫।
ঠিক কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো রচনাকে ডাকা যাবে ডিস্টোপিয়ান বলে?
আলাপের শুরুতেই বলেছিলাম, ডিস্টোপিয়ান রচনাগুলোর সমাজটা প্রতিষ্ঠিত ন্যায়ের বদলে অন্যায়ের ওপর, যেখানে শক্তিমান কেউ বলপ্রয়োগে নির্মূল করতে চায় মানুষের ব্যক্তি-স্বাধীনতা। মোটাদাগে, ওই একটি বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করেই এগোয় ডিস্টোপিয়ান রচনাগুলো।
ভেঙে বলতে গেলে, ডিস্টোপিয়ান কল্প-সাহিত্যে খেয়াল করা যাবে নিচের বৈশিষ্ট্যদের।
ক) ধরা যাক কোনো একটা দ্বীপে নতুন বসতি স্থাপন করলো মানুষ। সেখানে রাষ্ট্রধর্ম বা আদর্শ বলে স্থির করা হলো ‘আমরা প্রতিদিন আগের চাইতে বেশি কাজ করবো, বসতির উন্নয়ন ঘটাবো।’, এই আপ্তবাক্যকে। তা এই পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু যখনই মহৎ ওই স্লোগানের সূত্র ধরে আগের দিনের চেয়ে বেশি কাজ করতে না পারলে চাবুক মারা হতে থাকে মানুষকে, ওই দ্বীপের বসতি তখনই হয়ে ওঠে ডিস্টোপিয়া।
সমস্ত ডিস্টোপিয়ান ফিকশনে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটে। অর্থাৎ, এই উপন্যাসগুলোয় বর্ণিত যে জগৎ; সেগুলোর সূচনায় একটা ইউটোপিয়ান সমাজের স্বপ্ন প্রোথিত থাকে। নাগরিকদের ওপর আরোপ করা হয় একটা সুখী, সমৃদ্ধ জীবনের ধারণা। অথচ ক্রমবিবর্তনে এমন এক সমাজকাঠামো তৈরি হয় ওই গল্পগুলোয়, যে সমাজের কেন্দ্রীয় ভাবাদর্শটাই মানুষকে ক্রমাগত চুরমার করতে থাকে।
খ) ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে তুচ্ছ কারণে বিচারের মুখোমুখি হয় মানুষ। সমাজের আইন ভঙ্গ করায় মানুষকে সেখানে কাঠগড়ায় তোলে মহাশক্তিমান কোনো কর্তৃপক্ষ। অথচ পাঠক টের পায়, আদালতের ওই বিচারটাই স্বয়ং অবিচার।
গ) মানুষ মাত্রই যে এক ধরনের গল্পের শক্তিতে বিশ্বাস করে জীবন চালায়, জ্যারেড ডায়মন্ড বা ইউভাল নোয়া হারারিরা সম্প্রতি তাদের রচনার মাধ্যমে এই ধারণাটা বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছেন। অথচ ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের রচয়িতারা ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছেন ঢের আগে। খেয়াল করা যাবে, ডিস্টোপিয়ান জগতগুলোয় একটা সর্ববিস্তারী ‘রাষ্ট্রধর্ম’ থাকে (যা প্রকৃতপক্ষে কর্তৃপক্ষের তৈরি একটা গল্প মাত্র), যেটা বলপ্রয়োগে চাপিয়ে দেওয়া হয় মানুষের ওপর। ডিস্টোপিয়ান ওই সমাজে সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে বিবেচিত হয় কর্তৃপক্ষের আরোপ করা ওই গল্পটাকে অবিশ্বাস বা সন্দেহ করা।
ঘ) ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসগুলোর আর একটা বৈশিষ্ট্য, শক্তিমান কর্তৃপক্ষ সেখানে গণমানুষের কাছ থেকে ইতিহাস গোপন করে।
ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের নায়কদের দেখা যায়, তারা বারবার ইতিহাস খুঁজতে চাইছে, বুঝতে চাইছে যে কী করে এই সমাজটা এই ডিস্টোপিয়ান অবস্থায় এসে পৌঁছলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এমন সব প্রতিবন্ধকতার জাল ছড়িয়ে রাখে, যে অতীত জানাটা ওই সমাজে নাগরিকদের জন্য খুব সহজ হয় না। অতীতের সাথে এই বিচ্ছিন্নতা সামষ্টিকভাবেই বিষণ্ণ করে তোলে নাগরিকদের। পাঠকেরা তাই ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের নায়কদের কখনো সুখী অবস্থায় পায় না ।
ঙ) ডিস্টোপিয়ান ফিকশনের আরেকটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, সেখানে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য বা গোপনীয়তার কোনো জায়গা থাকে না। উইনস্টনকে যেমন বিগ ব্রাদার সর্বদাই দেখতে পায় (১৯৮৪), ডি-৫০৩’কে যেমন থাকতে হয় অপরের দৃষ্টিগ্রাহ্য কাঁচের ঘরে (উই), রে ব্র্যাডবেরির উপন্যাসে নায়ক যেমন মনে করতে পারে না যে স্ত্রীর সাথে তার কোনো একান্ত স্মৃতি আছে কি না (ফারেনহাইট ৪৫১)। ব্যক্তিগত আড়াল নেই বলেই ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস অনবরত অস্বস্তির খোঁচা দিয়ে চলে পাঠকদের।
০৬।
বাংলাদেশে ডিস্টোপিয়ার চর্চার দিকে খানিক নজর দেয়া যায় আবার।
ডিস্টোপিয়ান কল্প-সাহিত্য রচনার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয় এখানে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার অনেকগুলো কিশোর উপন্যাসে ডিস্টোপিয়ান সমাজের নানা মাত্রা উপস্থাপন করেছেন; তবে সেগুলো একদিকে যেমন ঠিক ‘বাংলাদেশ’-কেন্দ্রিক ডিস্টোপিয়া নয়, অন্যদিকে তেমন তার উপন্যাসে কাহিনি এগিয়ে যায় জঁরা সাহিত্যের ছক মেনে, বড় ধরনের কোনো সংকট আবিষ্কারের চেষ্টা সেখানে থাকে না। সত্যি বলতে, বাংলাদেশে ডিস্টোপিয়ান লেখালেখির প্রায় সবটুকুই জঁরা সাহিত্যের আওতায় সৃষ্ট, ধ্রুপদী ধারার লেখকেরা এদিকে তেমন পা রাখেন নি বললেই চলে।
ধ্রুপদী ধারায় কাজের উদাহরণ ভাবতে গেলে চট করে মনে আসে আনিসুল হকের ‘অন্ধকারের একশো বছর’ এর কথা, ডিস্টোপিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য ভালোই অক্ষুণ্ণ থেকেছে ছোট আকারের ওই উপন্যাসে। ভাবতে গেলে আরো কিছু উপন্যাসের নাম যোগ করা যায় (মশিউল আলমের ঔপন্যাসিকা ‘প্রিসিলা’, মাসউদুল হকের ‘তৃতীয় নারী’ যেমন), তবে তাদের কোনোটাই যেন ঠিক ডিস্টোপিয়ার অস্বস্তি দেয় না, ডিস্টোপিয়ার সীমানা ঘেঁষে সেগুলো বরং চলে যায় অন্য কোনোদিকে।
তবে কৌতূহল জাগানো ব্যাপার হচ্ছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ লেখক এবং পাঠকদের মাঝে ‘ডিস্টোপিয়া’ শব্দটা নানা জায়গায় ব্যবহারের একটা প্রবণতা খেয়াল করা যাচ্ছে। একদিকে যেমন তরুণদের রচিত কিছু উপন্যাসে কর্তৃত্ববাদী কারো অধীনে ভবিষ্যতের একটা ক্রুর, খল, অন্ধকারাচ্ছন্ন রুপ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে; অন্যদিকে তেমন তরুণ পাঠকদের একাংশও অন্ধকার কোনো ভবিষ্যতের আভাস পেলেই সেই লেখাকে ‘ডিস্টোপিয়ান’ আখ্যা দিয়ে অতিরঞ্জন করছেন।
তবে আমরা যেহেতু এটা জানি যে লেখকেরা উপাদান নিয়ে থাকেন মূলত সমকাল থেকেই, উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ তাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে আরেকটা প্রশ্ন। কেন হঠাৎ আমাদের লেখকেরা আশ্রয় করতে চাইছেন ডিস্টোপিয়ার ছক? তারা কি দেখতে পাচ্ছেন কোনো ইউটোপিয়ান আদর্শের সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠা? তারা কি টের পাচ্ছেন আরোপিত কোনো সত্যের ভার? তারা কি অনুভব করছেন অতীতের সাথে বিচ্ছিন্নতা?
০৭।
‘উই’ উপন্যাস লিখে ইয়েভগেনি জামিয়াতিন আধুনিক ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসকে রাস্তা দেখাচ্ছেন, প্রায় শতবর্ষ হয়ে গেলো সেই ঘটনার। গত একশো বছরে এই ঘরানায় যেমন জন্ম হয়েছে স্মরণীয় কিছু ধ্রুপদী উপন্যাসের, তেমনই জঁরা সাহিত্যেও লেখা হয়েছে অজস্র ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস।
বলা ভালো, উত্তরাধুনিক কালে যখন অন্য সমস্ত কিছুর মতোই ডিস্টোপিয়ান সমাজের ধারণা নিয়েও প্রচুর ভাঙচুর হয়েছে। চেনা ছকের বাইরেও উদ্ভব ঘটেছে নতুন রকম সব ডিস্টোপিয়ার। করম্যাক ম্যাকার্থি, ডন ডি লিলো, কাজুও ইশিগুরো- এরা সবাই নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন ডিস্টোপিয়াকে।
তবে খেয়াল রাখা দরকার, এই পোস্ট-ট্রুথের যুগে লেখকরা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতিব্যবহারও করছেন ডিস্টোপিয়া ধারণাটাকে। ফলে তাদের বিরুদ্ধেও জোরালো হয়ে উঠছে একটা অভিযোগঃ বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি দেখলেই যে কোনো সমাজকে তারা অতিরঞ্জন করে ডিস্টোপিয়ার তকমা দিয়ে দ্যান, সে ব্যাপারটা-ই তো নরকরাজ্যের সংজ্ঞার সাথে সাঙ্ঘর্ষিক!
তা এই অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা বিচারের সামর্থ্য অবশ্য সময় ছাড়া আর কারও নেই।
[সেপ্টেম্বর, ২০২২]
* বিগত ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ‘দৈনিক প্রথম আলো’-তে প্রকাশিত রচনাটির একটি পরিমার্জিত রুপ
Leave a Reply