হাতে জমে থাকা বইয়ের স্তূপ আর ইন্টারনেটে গণ্ডায় গণ্ডায় ঘুরে বেড়ানো মাগনা ই-বই এর দৌরাত্ম্যে যেটা হয়েছে, সদ্য প্রকাশিত বই কেনার ক্ষেত্রে মন ইদানিং অনেক যাচাই-বাছাই করে। নতুন বের হওয়া কোনো বই কিনবো কি না, স্বীকার করি, অনলাইনের নানা প্রতিক্রিয়াও আজকাল ভূমিকা রাখে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করায়। এসব হিসাবের বাইরে রাখি কেবল অল্প কিছু লেখককে। তাদের নতুন কোনো বই এলে, সেটা সংগ্রহ করে নিয়ে পড়তে আমার দেরি হয় না। ব্যক্তিগত সেই তালিকার একদম প্রথম দিকেই থাকেন শাহীন আখতার।
শাহীনের সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘এক শ এক রাতের গল্প’ তাই প্রকাশের পরে সংগ্রহ করি একদম টাটকা, তখনও বইয়ের বাঁধাই ঠিক মতো শুকায়নি পর্যন্ত। আর পড়তে বসি দু’দিন পরে। কয়েক পাতা এগোনোর পরেই আবিষ্কার করি, উপন্যাসের পটভূমি সেই কুখ্যাত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ-কাণ্ড। অমন আলোচিত একটি ঘটনা নিয়ে দেশের প্রথম বড় ক্যানভাসের কাজটি পাওয়া গেলো প্রিয় ঔপন্যাসিকের কলমে, তেমন একটা ভাবনায় আপ্লুত হতে হতে আমি তখন ঢুকে পড়ি উপন্যাসের আরো ভেতরে।
বলে নেওয়া ভালো, হলি-আর্টিজানের ঘটনার ঠিক বর্ণনা-সুলভ রচনা নয় আলোচ্য উপন্যাস, লেখক বরং ধরতে চেয়েছেন- ঘটনার সাথে যারা মোটেই সংশ্লিষ্ট নয়- আততায়ীদের হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়া সেই পরিবারগুলোর গল্প। শাহীন চেয়েছেনঃ যে সব বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া ছেলেরা টিভি আর সংবাদপত্রে ‘নিহত জঙ্গি’ হয়ে ফিরে এলো, সে-ই সব বাড়ির কয়েকটি মানুষকে আবিষ্কার করতে।
কল্পিত মৃত জঙ্গি শাহরিয়ার জামালের বোন সাফা মরিয়মের সাথে সাথে এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায় শাহরিয়ারের প্রাক্তন বান্ধবী দিলরুবা মেহবুবা, আর আরেক কল্পিত জঙ্গি জাভেদ মুর্তজার গৃহশিক্ষক শফি মোহাম্মদকে। নিহত জঙ্গিদের মাঝে নিজের ছেলে শাহরিয়ার আছে- সেটা জানার পর মুখে ফেনা উঠে মৃত্যু ঘটে সাফা মরিয়মের বাবার, মা যেন কিছুটা বাস্তবতার সাথে যোগ হারিয়ে ফেলেন। আর সাফা মরিয়ম কেবল ঘুরে ঘুরে জানতে চায় ভাইয়ের লাশটা কখন ফেরত দেবে কর্তৃপক্ষ। মর্গ থেকে লাশ ছাড়িয়ে আনার জন্য সাফা মরিয়ম তাই যোগাযোগের চেষ্টা করে বাকি নিহত জঙ্গিদের পরিবারের সাথে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা দিলরুবা মেহবুবা চলে যায় সে-ই গ্রামে, যেখানে মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন আত্মগোপন করে ছিলো তার প্রাক্তন প্রেমিক শাহরিয়ার, প্রস্তুতি নিয়েছিলো রেস্তোরাঁয় হামলা করে বেহেশতে যাবার। আর শফি মোহাম্মদ? নিজের ছাত্রের ‘জঙ্গি’ পরিচয় আবিষ্কার হবার পর থেকে ভীত শফি মোহাম্মদ ইদানিং আর ঘুমোতে পারে না। রাতের পর রাত জেগে সে তাই আরব্য রজনীর ঢং-এ গল্প শোনায় অশরীরী কাউকে, গল্পের কেন্দ্রে থাকে হাজার হাজার বছরের ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাস।
শাহীনের কাজটা কঠিনই ছিলো। কারণ ‘হাজার চুরাশির মা’ পাঠকের মাঝে ব্রতী চ্যটার্জীর জন্য যে মায়া তৈরি করে, শাহীনকে কাজ করতে হয়েছে তার উলটো দিকে; শহুরে উচ্চবিত্ত শাহরিয়ার জামাল কিংবা গ্রামের দরিদ্র বাদশা মিয়ার বেছে নেওয়া রাস্তাকে অবিরাম তিরস্কার করতে হয়েছে তাকে। টের পাই, একটা অতি-সতর্কতা তাই যেন অবচেতনে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো শাহীনকে।
সাথে সাথে, উপন্যাসের যে আঙ্গিকটা বেছে নিয়েছেন লেখক, তাতেও যেন ইতিহাসকে কাঠখোট্টা ভাবে বলার একটা চাপ তৈরি হয়েছে শাহীনের ওপর। মূল গল্পের সমান্তরালে চলা ক্রুসেড, ফিলিস্তিনের শরণার্থী, আলী ভাইদের খিলাফত আন্দোলন আর একুশ শতকে সিরিয়াগামী যুবকের মোহভঙ্গের গল্প- পাঠককে যেন খানিক দূরেই সরিয়ে রাখে। বরং, সাফা মরিয়মের অনুসন্ধান কিংবা মৃত জঙ্গি ভাইয়ের বোন আমিরন ফারাবি কীভাবে পা রাখলো ওই একই পথে, পাঠকের কাছে বরং সেই কাহিনিই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ সৎ উপন্যাসের কাছে আমাদের চিরদিন প্রত্যাশা থাকে যে সেটা অন্যের জীবনে উঁকি মারার গর্ত তৈরি করে দেবে।
উল্লেখ করতে হয়, প্রায় একই আঙ্গিক ও বিষয় নিয়ে বছর দুয়েক আগে প্রকাশিত আরেকটি উপন্যাসের কথা, অদিতি ফাল্গুনীর ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’। শাহবাগের গণজাগরণের পর নাড়া খেয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা কী করে সরাসরি আক্রমণ করা শুরু করলো এদেশের কিছু মানুষের ওপরে, আমার জানা মতে অদিতির ওই উপন্যাসেই সেটা প্রথম উঠে এসেছে। লেখক, ব্লগার, প্রকাশক- এদের ওপর হামলার একটা কল্পমূলক বয়ান তার উপন্যাসে দাঁড় করিয়েছিলেন অদিতি, সময়ক্রম অনুসরণ করে। সেই সাথে, তিনিও টেনেছেন মানুষের ইতিহাস জুড়ে ধর্মের নামে সংঘটিত হওয়া বিভিন্ন আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস। ইসলামে, সনাতন ধর্মে, খৃস্টীয় ধর্মে।
শাহীনের আলোচ্য উপন্যাসের সাথে অদিতির উপন্যাসের পার্থক্য মূলতঃ আয়তনে। তুমুল পরিশ্রম করেছেন অদিতি। এদেশে নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, পাশের দেশ ভারতে বিজেপির হাত ধরে মারাঠা বীর শিবাজীর মাধ্যমে আওরঙ্গজেব তথা ইসলামবিদ্বেষী আন্দোলনের সূচনা, ধর্মীয় পোশাকের আড়ালে কী হলো চট্টগ্রামে; পুলিশের কেইস ফাইলের মতোই এই ঘটনাগুলোর বিশদ বয়ান সাক্ষ্য হয়ে থাকে বাংলাদেশের একটি বিশেষ কালপর্বের- আগ্রহী পাঠকের কাছে যার আবেদন অনেক। ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ খুবই উচ্চাভিলাষী আর বিস্তৃত, সে কারণেই নির্দিষ্ট কিছুকে ফোকাসে রাখাটা তার হয়ে ওঠেনি।
অন্যদিকে, উচ্চাভিলাষী না হয়ে অল্প কিছু জায়গাতে মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছেন বলে শাহীনের বয়ানকে অপেক্ষাকৃত সংহত লাগে, মানবিক লাগে।
সত্যি বলতে, অনুভব করি, পাঠক হিসেবে দুটো উপন্যাস একত্রে পড়লেই যেন ওই কয়েকটা বছরের কদর্যরুপ আমাদের সামনে সবটুকু বীভৎস হয়ে ফেরত আসবে। সিনেমার মতো কাছের-হয়েও-দূরের ওই সময়টার স্মৃতি আমাদের অনেকের কাছেই ঝাপসা হয়ে গেছে মাঝের কয়েক বছরে। ডুবে যাওয়া কোনো শহরে ফিরে যেতে চাইলে উপন্যাসের চাইতে ভালো বাহন আর কী-ই বা হতে পারে?
[আগস্ট, ২০২২]
* বিগত ২রা সেপ্টেম্বর, ২০২২ ‘দৈনিক প্রথম আলো’তে প্রকাশিত লেখাটির পরিমার্জিত রুপ।
Leave a Reply