জুলাই মাসের এক সকালবেলায়- দুপুরও হতে পারে- অন্তর্জালে একটা ক্লিক করে আপনি ঢুকে পড়েছেন সুহান রিজওয়ানের লেখালেখির সাইটে, লিংকটা বলছিলো এখানে ইতালো কালভিনোর উপন্যাস ‘ইফ অন আ উইন্টারস নাইট এ ট্রাভেলার’ এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাবে।
হ্যাঁ, এই সাইটে আপনি সত্যিই সুহানের লেখাটা পড়তে পারবেন। কিন্তু ধৈর্য্য ধরতে হবে। জানি, কয়েক লাইন পড়ে ফেলার পরেও উদ্দিষ্ট বইটা নিয়ে কিছু খুঁজে না পেয়ে আপনি অধৈর্য হচ্ছেন, সাথে সাথে, নিজের বিচারও আপনাকে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে যে এই লেখাটা চট করে স্ক্রল করে পড়া যাবে না। তবে এটা ঠিক, যে বই নিয়ে এই বিচিত্র ভঙ্গীতে লেখা প্রতিক্রিয়া আপনার কৌতূহল জাগিয়েছে, আপনি তাই পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আপনি এটাও জানেন যে অন্তর্জালে কোনো কিছুতে মন দেয়া কেমন কষ্ট, তাই আপনি ভয় পাচ্ছেনঃ যে এলোমেলো এই লেখা আপনাকে অচিরেই করে তুলবে ক্লান্ত। এসব ফালতু বকুনি আর কতক্ষণ?
আপনাকে স্বস্তি দেয়া দরকার, দেরি না করে তাই চলে যাই বইয়ের আলাপে।
১) প্রথমেই যেটা আপনার জানা দরকার, তা হলোঃ এই উপন্যাসটা একটা উপন্যাস নিয়ে। আপনি সেখানে পাঠক তো বটেই, এমনকি মাঝে মাঝে উপন্যাসের চরিত্রও হয়ে উঠবেন।
পাঠ-প্রতিক্রিয়াটা আপনি পড়লেন, জেনে গেলেন ‘ইফ অন আ উইন্টারস নাইট এ ট্রাভেলার’ প্রসঙ্গে মূল কথাটাই। কিন্তু পাঠক হিসেবে আপনার তো স্বস্তি মিললো না! আপনি বরং বিরক্ত হলেন, মনে হলোঃ প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সুহান রিজওয়ান এমন করছে কেন!
লেখাটা কি আরেকটু পড়বেন? … আরেকটু দেখে নেবেন আপনি, কালভিনোর উপন্যাসটা নিয়ে জানতে হয়তো আরেকটু সময় দেয়া যায়।
২) প্রতিটি উপন্যাসে একটা নায়িকা থাকে, আপনার জন্যেও তাই একটা নায়িকা বরাদ্দ আছে কালভিনোর উপন্যাসে। মেয়েটি বই পড়ে, বলতে গেলে বইয়ের জগতেই বাস করে সে।
পড়ুয়া নায়িকা? বাহ! … পাঠক হিসেবে আপনি জানেন, পড়ুয়া মেয়েদের আপনার খুবই আকর্ষণীয় লাগে। বইয়ের দোকানে সুন্দরী কোনো মেয়ে এগিয়ে এসে আপনার সাথে আলাপ করতে চাইছে, পড়ুয়া হিসেবে এই বাসনা আপনাকে বহুদিন তাড়িত করেছে। মেয়েটি দেখতে কেমন, তা নিয়েও নিজস্ব কিছু কল্পনা আছে আপনার।
কিন্তু সুহান যেহেতু জেনে গেছে যে পড়ুয়া মেয়ে নিয়ে ফ্যান্টাসির প্রসঙ্গটা আসা মাত্র আপনার মনোযোগের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেছে, সে এখন তাই আবার উপন্যাসে ফিরবে।
৩) উপন্যাসে একটা লক্ষ্য থাকতে হয়। কালভিনোর উপন্যাসের নায়কেরও লক্ষ্য থাকে, সে চায় একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করতে।
… সিরিয়াসলি? এভাবে এক লাইন- এক লাইন করে রিভিউ দিয়েছে এখানে? আপনার রাগ লাগে। এবার আপনি সত্যিই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে চান এই পুরো লেখাটা পড়ার বিষয়ে। হাজার হোক, আপনার সময়ের দাম আছে। জুলাইয়ের এই ভ্যাপসা দুপুরে ছুটির দিনের দুপুরের ঘুম কাজা করে, কিংবা অফিস থেকে ফেরার পথে যানজটে আটকে পড়া অবস্থায় এই লেখা পড়ার ধৈর্য্য থাকার কথা না। জীবনে এমনিতেই অনেক রকম ঝামেলা আপনার, একটা বইয়ের আলাপ পড়তে গিয়ে তাই এতো প্যারা নেবার কোনো মানে নাই।
৪) কিন্তু ঝামেলা ছাড়া একটা লক্ষ্য সম্পূর্ণ হয় কী করে? কালভিনোর উপন্যাস জুড়েও তো দেখা যায় নানা রকম ঝামেলা এসে দাঁড়ায় নায়কের পথে। নায়ক একটার পর একটা উপন্যাস পড়া শুরু করে, কিন্তু প্রতিবারই সে ওই উপন্যাস পড়া শেষ করতে পারে না।
… আচ্ছা! এইবার আপনি যেন বুঝতে পারছেন ঠিক কী ঢঙে এই প্রতিক্রিয়াটা লেখা। রিভিউ লেখক আপনাকে কিছুতেই লেখাটার শেষ দেখতে দিচ্ছে না। নিজেকে শালা খুব চালাক ভাবে।
… ঠিক আছে, কিন্তু আপনিও তো কম যান না! আপনি সিদ্ধান ন্যানঃ এই লেখাটা আর মন দিয়ে পড়বেন না আপনি, বরং স্কিম করে যাবেন। সত্যি বলতে, আপনি এতোক্ষনও স্কিম করেই যাচ্ছিলেন, এবার সেটার গতি বাড়িয়ে দেবেন আর কি। তবে বলে রাখি, সুহান কিন্তু- কালভিনোর মতো না হলেও- একটা খেলা দেখাবে এখন। এখন সে তুলে দেবে রিভিউর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ অংশটা, মানে কালভিনোর উপন্যাসে কী আছে- সেটা।
৫) উপন্যাসে নানারকম টুইস্ট দিয়ে রহস্য তৈরি করেন লেখকেরা। কালভিনোর মোচড়গুলো আক্ষরিক অর্থেই বই-সংক্রান্ত মোচড়। ধরুন, ভুল মলাটের বই নিয়ে আসা। কিংবা ছাপাখানার ভূতে পাণ্ডুলিপি বদলে যাওয়া। কিংবা, লেখকের লিখতে না পারা। প্রচুর প্যাঁচ দিয়ে এই ঘটনাগুলো সাজানো।
… বই নিয়ে বই? ইন্টারেস্টিং। কিন্তু প্যাঁচ বেশি বলছে যে? এখন কি আপনার আর এইসব ঘোরালো বই পড়ার সময় আছে? থ্রিলার-ট্রিলার হলে না হয় ট্রাই করা যেতো! নাহ, এই বইটা মনে হয় পড়া হবে না। অনলাইনে কয়েকটা রিভিউ পড়েই সারতে হবে। ডিটেলড রিভিউ হলে ভালো হয়। সুহান রিজওয়ানের এই লেখাটার মতো পাকনা কিছু হলে চলবে না।
৬) দুনিয়া জুড়ে কত রকম উপন্যাস আছে, কত বিচিত্র তাদের জগত! কালভিনো লোকটা এমন জিনিস, যে এই উপন্যাসের ভেতরে সমস্ত জগতই সে পারলে ঢুকায়। প্রেম আছে, ঈর্ষা আছে, রাজনীতি আছে, সেন্সরশিপ আছে। বিমান ছিনতাই থেকে গুপ্তসংঘ, কিছুই বাদ যায়নি।
… এবার কিন্তু আগ্রহটা বেড়ে যাচ্ছে আপনার। ভালোই থ্রিলিং ব্যাপার-স্যাপার দেখা যায়! একটা ট্রাই মেরে দেখবেন নাকি? কিন্তু গুডরিডসে তো দেখে আসলেন (হ্যাঁ রে ভাই, এই ছোট্ট রিভিউ পড়ার ফাঁকে আপনি গুডিতেও একটু ঢুঁ মেরে এসেছেন!) বেশ হাই-থট বই, একডজন নীলপদ্মের মতো চট করে শেষ করা যাবে না। … ওয়েল, বই পড়ার সিদ্ধান্তটা আপাতত থাকুক। আপনি আগে এই রিভিউটা পড়ে দেখবেন বলে মনস্থির করেন।
৭) [‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ উপন্যাসের লেখক সুহান রিয়াসাতের ডায়েরি থেকেঃ]
স্বস্তি পাচ্ছি। নিজের কাছেই আমি স্বস্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে নিজের তৃতীয় উপন্যাস লেখার আগে কালভিনোর ‘ইফ অন আ …’ আমার পড়া হয়নি। মূর্খতা কখনো কখনো প্রভাবিত হওয়া থেকে লেখককে বাঁচায়।
… কী বা*!
এই ন্যারেশন আবার কোত্থেকে আসলো? আপনি এখন সত্যিই কনফিউজড! …আচ্ছা, ওয়েইট আ মিনিট! এই রিভিউটা তো সুহান মনে হয় কালভিনোর উপন্যাসের অনুকরণে লিখতে চেয়েছে, রাইট? তার মানে উপন্যাসেও এমন কিছু একটা ব্যাপার আছে, যেখানে কথক বদলে যায়? … হ্যাঁ, এটা একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় কি? তা অবশ্য যায় না। এমন অনিশ্চিত ভাব থাকলে মুশকিল কিন্তু। তেমন হলে আপনাকে এই উপন্যাস পড়ার চিন্তা বাদ দিতে হবে।
৮) সুলিখিত একটা উপন্যাস নিয়ে আলাপ হবে, আর ভাষা প্রসঙ্গে কিছু বলা হবে না, তা তো সম্ভব নয়! তাই বলতেই হচ্ছে, কালভিনো লোকটা এই উপন্যাসে ভাষা বদলে রীতিমতো হরবোলা। কখনো সে বোর্হেসের ভাষায় অসীম খোঁজে, কখনো সে চেকভের মতো কাঠখোট্টা, টানটান। কখনো সে বুনো পশ্চিমের শ্বাসরুদ্ধকর এক কাহিনি শোনায়, কখনো সে হয়ে ওঠে প্রাচ্যের মায়াবী কোনো জগতের নির্মাতা।
এবারের আলাপটা কিন্তু আপনার ভালো লেগেছে। কোনো প্যাঁচ নাই, কারিকুরি নাই। কি উপন্যাসে, কি উপন্যাস নিয়ে আলোচনায়- আপনি চান লেখক সোজাসাপ্টা কথা বলবে। কেউ যখন বেশি প্যাঁচায়, সেটা আপনার ভালো লাগে না। আঁতেলরা যত কথাই বলুক, ওইসব মার্কেজ- বোর্হেস আপনার ঠিক সহ্য হয় না। এই আলাপ পড়ে মনে হচ্ছে কালভিনো লোকটাও অমন আঁতেলই হবে।
৯) উপন্যাসে মানে কেবল গল্প নয়, তবে উপন্যাসে একটা কাহিনি থাকে। আর কালভিনো এই উপন্যাসে অনেক কাহিনির শুরু দেখান ঠিকই, শেষ দেখান না। সেই কাহিনিগুলোর পুর্ণাঙ্গ রুপ জানতে পাঠকের ভেতরটা নিশপিশ করে, ঠিক যেভাবে এই লেখা পড়তে গিয়েও বারবার সে হতাশ হয়ে ওঠে উদ্দিষ্ট বই প্রসঙ্গে নিরেট কিছু খুঁজে না পেয়ে।
… এই কথাটা কি আগে বলা যেতো না? মানে, আপনি সময় খরচ করে একটা উপন্যাসের রিভিউ পড়তে বসছেন, আর আপনাকে সেখানে কোনো কথা না বলেই এভাবে ধোঁকা দিয়ে দেবে? … তবে এটা ঠিক, যে রিভিউটা দ্রুতই পড়ে ফেলা গেছে। তেমন ঝামেলা হয়নি, সময়ও বেশি নষ্ট হলো না। আবার সুহানও স্বীকার করলো, যে সে কালভিনোর অনুকরণেই রিভিউটা এভাবে সাজিয়েছে। আপনি তো আর মূর্খ নন, ঠিক অনুমানই করেছিলেন আপনি।
১০) উপন্যাসের শেষে আমরা জেনে যাই, পৃথিবীর যাবতীয় কাহিনির অন্তিমে থাকতে পারে দুটো মাত্র পরিণতি। মৃত্যু, অথবা জীবনের বয়ে যাওয়া। তবে বই সংক্রান্ত কোনো আলাপের শেষে, বলাই বাহুল্য, কেবল জীবনই সত্য থাকে।
সুহানের লেখাটাও এখানে শেষ হয়। আপনার বিরক্তি এখন কিছুটা কমের দিকে। তবে মনের ভেতর আপনার এখনো দ্বিধা আছে। কালভিনোর উপন্যাসটা কি পড়বেন, না পড়বেন না?
… জুলাইয়ের দুপুরে এই বিষয়ে চট করে কোনো সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারেন না। বইপড়ুয়া হিসেবে এই বিষয়ে আরেকটু ভেবে দেখবেন বলে স্থির করেন আপনি। তবে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ভবিষ্যতে যখনই কেউ এই উপন্যাস পড়ার বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাইবে, আপনি তখন তাকে এই আলাপটার কথা জানাবেন। আপনি বলবেনঃ ‘সুহানের লেখাটা পড়ে দেইখো, হয়তো কালভিনোর উপন্যাসটা নিয়ে একটা ধারণা তুমি পাইতেও পারো।’
[জুলাই, ২০২২]
Leave a Reply