লেখালেখি

‘কীভাবে পর্নোগ্রাফিক সিনেমা চিনবেন’: উমবার্তো ইকো

পর্নোগ্রাফিক সিনেমা কীভাবে চেনা যায়?

জানি, প্রশ্নটা শুনে ভুরু কুঁচকে ফেলবেন কেউ কেউ, তরুণেরা হেসেও উঠতে পারেন। আরে বাবা নানা রকম ওয়েবসাইটে দিনে-রাতে সমানে পর্নোগ্রাফি চলছে, একজনের ডাউনলোড করা ইরোটিকা কিংবা পর্নোগ্রাফি মুঠোফোন থেকে মুঠোফোনে ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিক; এমন যুগে পর্নোগ্রাফিক সিনেমা চিনতে কারো মাথা ঘামাতে হবে কেন!

প্রশ্নটা তাই আরেকটু ঘুরিয়ে করিঃ পর্নোগ্রাফিক সিনেমার একমাত্র সনাক্তকরণ চিহ্ন কি তবে রগরগে যৌনদৃশ্য? ধুন্ধুমার যৌনতা থাকলেই কি সেই সিনেমাকে ডাকা যাবে পর্নোগ্রাফি বলে?

অন্যভাবে বললে, মূলধারার সিনেমাতে যদি দেখানো হয় বেশ খোলামেলা যৌনক্রিয়া (তাৎক্ষণিক ভাবে মনে পড়ছে মনিকা বেলুচ্চির ‘Irreversible’ আর টম ক্রুজ ও নিকোল কিডম্যানের ‘Eyes Wide Shut’ সিনেমার কথা), তবে কি তাদেরকেও ডাকা যাবে পর্নোগ্রাফি?

অনুভব করি, প্রথাগত সিনেমার পাঁড় ভক্ত, অথবা পর্নোগ্রাফির নিয়মিত দর্শক, উভয় দলের জন্যই এ প্রশ্নের একটা চটজলদি জবাব দেয়া কঠিন। দু’ধরনের সিনেমার মাঝে একটা পার্থক্য আছে ঠিকই, দর্শক সেটা অনুভবও করে, কিন্তু সেটাকে যেন নিরেট কোনো উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।

সত্যজিৎ রায়ের প্রাসঙ্গিক একটা উক্তি ধার করিঃ

আমরা একটা ভালো লেখা-ভালো সাহিত্য পড়লে বুঝতে পারিঃ এটা পর্নোগ্রাফি নয়। অনেক উঁচু সাহিত্য, যেখানে ইরোটিক বর্ণনা আছে, পড়লে বোঝা যায় এটা পর্নোগ্রাফি নয়। সেরকম ইকুইভ্যালেন্ট ক্যামেরা স্টাইল থাকা উচিৎ, যেখানে দুটোকে তফাৎ করা যায়।

বোঝাই যাচ্ছে, সাধারণ দর্শকের মতোই সত্যজিৎ’ও একটা বেশ সংকটময় পরিস্থিতিতে পড়ে গেছেন পর্নোগ্রাফিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে।

বলাই বাহুল্য, পর্নোগ্রাফিক সিনেমা নির্মাণে ক্যামেরায় অমন কোনো ব্যাকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে কি না, সেটা এখনো আমার অজানা। তবে সৌভাগ্যক্রমে, সত্যজিত এবং অগণিত দর্শককে ঝামেলায় ফেলা প্রশ্নটার (কীভাবে আলাদা করা যায় সিনেমা আর পর্নোগ্রাফি’কে) একটা বেশ ভালো গাণিতিক উত্তর পাওয়া গেলো উমবার্তো ইকোর কাছে।

১৯৯৩ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস-এলিয়ট নরটন লেকচার সিরিজের অংশ হিসেবে ছয়টি ধারাবাহিক বক্তব্য দিয়েছিলেন ‘The Name of the Rose’ খ্যাত ঔপন্যাসিক উমবার্তো ইকো। সেখানে তিনি আলাপ করেছিলেন লেখকের নানা রুপ, কল্পসাহিত্যের নানা কৌশল, কিংবা গল্পে আমাদের বিশ্বাস স্থাপন প্রসঙ্গে। ওই বক্তব্যগুলোই পরে সংকলিত হয়ে এসেছে ‘Six Walks in the Fictional Wood’ নামের বইতে। পর্নোগ্রাফি প্রসঙ্গে রসিক ইকোর ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণটি সেই বই থেকেই পাওয়া।

কথা আর না বাড়িয়ে এবার ইকোর সেই পর্যবেক্ষণ সরাসরি তুলে দেওয়া যাকঃ

… আপনি যখন বোঝার চেষ্টা করবেন যে রগরগে যৌনদৃশ্য থাকা কোনো সিনেমা সত্যিই পর্নোগ্রাফি কি না, আপনাকে তখন খেয়াল করতে হবে যে কোনো চরিত্রের লিফট চড়তে, বা গাড়িতে উঠতে যে সময়টা লাগে, তখন মানস-সময় আর কাহিনি-সময় একই থাকে কি না।

…লেখকেরা হয়তো একটা বাক্যেই বলে দেবে, যে ফ্রেডরিক এরপর দীর্ঘ একটা যাত্রা করলো। এবং সাধারণ সিনেমায় তখন দেখাবে যে বোস্টনের লোগান এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চড়া একটা লোক পরের দৃশ্যে ল্যান্ড করছে সান-ফ্রান্সিসকোতে। কিন্তু পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় যদি কেউ গাড়িতে উঠে দশ ব্লক দূরের কোনো বাড়িতে যায়, তাহলে গাড়িটা ওই দশটা ব্লকের ভেতর দিয়ে বাস্তব সময়ের গতিতেই যাবে। পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় যদি কেউ ফ্রিজ খুলে স্প্রাইটের একটা বোতল বের করে, এবং তারপর সে আর্মচেয়ারে বসে বোতলে আয়েশ করে চুমুক দিতে দিতে সুইচ টিপে টিভি ছাড়ে; সেক্ষেত্রে সে ঠিক ততটুকুই সময় নেবে – যতটা সময় আপনার লাগবে ওই একই কাজটা নিজের বাড়িতে করতে।

কারণটা বেশ সহজ। পর্নো সিনেমার মূল কাজ হচ্ছে দর্শকের যৌনদৃশ্য দেখার তাড়না মেটানো। কিন্তু পরিচালক তো সেখানে দেড়ঘন্টা ধরে অবিরাম কেবল সঙ্গমই দেখাতে পারেন না! তখন অভিনেতারা ক্লান্ত হবেন তো বটেই, দর্শকের কাছেও ব্যাপারটা হয়ে পড়বে একঘেয়ে। সঙ্গম দৃশ্যগুলোকে তাই ছড়িয়ে দিতে হয় পুরো গল্পের নানা জায়গায়।

কিন্তু এসব সিনেমার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য একটা গল্প তৈরি করার মতো সময় বা পয়সা ঢালার মতো তেল কারো নেই, আর দর্শকেরাও এখানে গল্পের ব্যাপারে আগ্রহী নয়, তারা শুধু অপেক্ষা করে যৌনদৃশ্য দেখার জন্য। গল্পটাকে তাই ভরিয়ে তোলা হয় হয় প্রতিদিনের ছোটখাটো অনুল্লেখ্য কিছু কাজকর্ম দিয়ে; যেমন কোথাও যাওয়া, গ্লাসে ঢেলে হুইস্কি খাওয়া, কোট গায়ে চড়ানো, আজাইরা সব বিষয়ে আলাপ করা। এবং গল্পের চরিত্রকে নামি-দামি কোনো হোটেলে গোলাগুলির দৃশ্যে নামিয়ে দেয়ার চাইতে গাড়ি চালাতে দেয়াটা, অর্থনৈতিক কারণেই সহজতর (বলাই বাহুল্য, গোলাগুলির দৃশ্যে নামিয়ে দিলে দর্শকের আগ্রহটাও আবার অন্যদিকে সরে যাবে)। এবং সে কারণেই, এখানে যৌনতাহীন দৃশ্যগুলোও ঠিক আমাদের বাস্তব জীবনের সমান সময়ই নেয়- এবং যৌনদৃশ্যগুলোকে হতে হয় বাস্তবের চাইতে দীর্ঘস্থায়ী।

কাজেই এটাই হচ্ছে নিয়মঃ যদি কোনো সিনেমায় দুটো চরিত্র ‘ক’ স্থান থেকে ‘খ’ স্থানে যেতে বাস্তব জীবনের সমান সময় নেয়, আমরা তখন পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি যে সিনেমাটা পর্নোগ্রাফিক।

লক্ষ করবো, ইকো তার আলাপে দুটো ধারণা ব্যবহার করেছেন, কাহিনি-সময় আর মানস-সময় (ইকো এদের বলেছেন যথাক্রমে Story Time আর Discourse Time)। উল্লেখিত বইতে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আছে, পাঠকের সুবিধার জন্য আমি ব্যাপার দুটো এখানে বলে যাবো খুবই সংক্ষেপে।

ধরা যাক ৯০ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটা ফুটবল ম্যাচের কথা। আমরা যখন কোনো ফুটবল ম্যাচের বর্ণনা পড়ি, তখন কিন্তু কখনোই ওই গোটা ৯০ মিনিটের সমস্ত ঘটনার বিবরণ পড়ি না। আমরা পড়ি সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ৩/৪ বা ৫ মিনিটের বর্ণনা। ফলে, একটা ফুটবল ম্যাচের জন্য কাহিনি-সময় হচ্ছে ৯০ মিনিট, এবং মানস-সময় হচ্ছে ওই ৩/৪ বা ৫ মিনিট

শুধু ফুটবল ম্যাচের বর্ণনা দিতে নয়, আমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছি যে কথাসাহিত্য চিরকাল এভাবেই কাজ করে। এমনকি সেরাদের সেরা লেখকেরাও কখনোই কোনো কিছু (ঘটনা বা জীবন) পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন না, সেটা সম্ভবই নয়! আন্না কারেনিনার গোটা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের বর্ণনা না দিয়ে পাঠককে বরং বলা হয় আন্নার জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য দিনের ঘটনা, পাঠকের মনে সেটাই আন্নার গোটা জীবনের সমার্থক হয়ে বসে থাকে।

আবারও ছবির উদাহরণে ফিরে এসে বলি, একটা ফুটবল ম্যাচের ৯০ মিনিটের সরাসরি সম্প্রচার হবে তার কাহিনি-সময়, আর সেখানে হাইলাইটস হবে তার মানস-সময়। আর যখন আমরা কোনো ফুটবল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার দেখি, তখন কিন্তু কাহিনি-সময় আর মানস-সময় হয়ে যায় পর্নোগ্রাফির মতোই সমান (৯০ মিনিট)।

অর্থাৎ, যৌনদৃশ্য বাদে গল্পের অন্যান্য অংশগুলো (কফি খাওয়া, গাড়ি চড়া) সাধারণ সিনেমায় দেখানো হয় হাইলাইটসের মতো সংক্ষিপ্ত; কিন্তু পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় তাদের দেখানো হয় সরাসরি সম্প্রচারের মতো দীর্ঘ করে।

পর্নোগ্রাফিক সিনেমা চিনতে, উমবার্তো ইকোর মতে, এটাই সায়েন্স!

[মে, ২০২২]

Previous

গল্পের একটি সম্ভাব্য চরিত্র

Next

কোথাও ডাইনি আজও হতেছে শিকার

1 Comment

  1. Muin

    কথা নেহাত ভুল না একেবারে, যদিও এর জন্য পর্নোগ্রাফিক ফিল্ম যথাযথ মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করে তবেই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress & Theme by Anders Norén

error: Content is protected !!
%d bloggers like this: