০১)
‘বেণীসংহার’ নামে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্প আছে, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী যে গল্পের নায়ক। বেণীমাধব নামের এক বিপত্নীক প্রৌঢ় রহস্যজনকভাবে খুন হন নিজ বাড়িতে। খুন করা হয় দরজা পাহারায় থাকা তার একান্ত সহকারী মেঘরাজকেও। বাড়িতে বাস করা বেণীমাধবের পুত্র-কন্যা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের অনেকেরই মোটিভ আছে ওই প্রৌঢ়কে হত্যার। একাধিক সন্দেহভাজনের মাঝে কে প্রকৃত খুনী, সেই সুরাহা করতে দৃশ্যপটে আগমন ঘটে ব্যোমকেশের।
ব্যোমকেশের প্রায় শেষ বয়েসের কেস ছিল ওই বেণীসংহার। প্রথম যখন পড়ি গল্পটা, এখনও স্মরণ হয়, সেটাকে খানিক আলাদা মনে হচ্ছিল শরদিন্দুর ন্যারেটিভ ভিন্নতার কারণে। অতটা লম্বা ফ্ল্যাশব্যাক, সম্ভবত ব্যোমকেশের অন্য কোনো গল্পে নেই।
কিন্তু এতোদিন পরে গল্পটাকে যে মনে পড়ল, তার কারণ ওই ন্যারেটিভ নয়; সেটা বরং গল্পের শেষে পাঠককে হাঁ করে দেওয়া ব্যোমকেশের ওই উন্মোচনটা– প্রকৃতপক্ষে পয়সাওয়ালা বুড়ো বেণীমাধব নয়, খুনির লক্ষ্য ছিল ভৃত্য মেঘরাজ; মেঘরাজের ছলনাচতুর স্ত্রীকে নিজের করে পেতেই খুনি ওই নৃশংস জোড়াহত্যা ঘটায়।
শরদিন্দুর এই গল্প রহস্যগল্পের পাঠকদের সামনে অনেক পুরাতন একটা সত্য স্পষ্ট করে। একাধিক অপরাধ একত্রে ঘটলে আমরা অনেকটা অবচেতনেই কোনো কোনো অপরাধকে ধরে নেই ঘটনাক্রমের দুর্ভাগ্যজনক বলি (কোলাটেরাল ড্যামেজ) হিসেবে। মালামাল তো বটেই, মানুষের জীবনকেও আমরা ওই ড্যামেজের আওতাভুক্ত করে দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু সেই ‘ঘটনাক্রমে বলি’ হয়ে যাওয়া মানুষটারও যে একটা নিজস্ব জগত আছে, আমাদের সরলীকরণ প্রবণতা সেটাকে স্রেফ অগ্রাহ্য করে যায়।
বলতে সংকোচ হয়, তবুও বলে ফেলি, আমরা সম্ভবত সামিয়া আফরানকেও দীর্ঘমেয়াদে গণ্য করব দুর্ঘটনার বলি হিসেবে।
০২)
গত বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২ রাতে, ঢাকার মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু খুন হন শাহজাহানপুরে। জানা যায়, জাহিদুল ইসলামকে বহন করা মাইক্রোবাসটি ঘটনার সময় আমতলা মসজিদ এলাকায় এসে যানজটে আটকে পড়ে। তখনই নাকি একটি মোটরসাইকেলের পেছন থেকে হেলমেট পরা এক যুবক নেমে এসে মাইক্রোবাসের ভেতরে বসা জাহিদুলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। জাহিদুল এবং মাইক্রোবাসের চালক মনির হোসেনের সাথে সাথে দুর্ভাগ্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হন যানজটে আটকে পড়া রিকশারোহী সামিয়া আফরান জামাল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে জাহিদুল ও সামিয়াকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রতিক আলোচিত এই ঘটনাটার বিস্তারিত এবং কারণ অনুমান-জনিত বিবিধ বিশ্লেষণ ইতোমধ্যেই জায়গা করে নিয়েছে অনলাইন সব নিউজ পোর্টাল আর অফলাইনের পত্রিকার পাতায়, সেই আলাপে আমরা তাই যাব না এখানে।
কেবল এটুকু নিশ্চিত হই, উদ্দিষ্ট এই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে সামিয়া আফরান ঘটনার ‘দুর্ভাগ্যজনক বলি’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছেন ইতোমধ্যে, এবং সেই তকমাই তাকে বহন করতে হবে ভবিষ্যতেও।
দড়ির ওপর বিপজ্জনকভাবে হেঁটে যাওয়া দড়াবাজিকরের মতোই এই ঢাকা শহরে প্রাণ হাতে করে প্রতিদিন চলাফেরা করে মানুষ। যানবাহন দুর্ঘটনা, নির্মীয়মান দালানের ইট খসে পরে মৃত্যু– সবই আমাদের সয়ে গেছে। এহেন ঢাকা শহরেও সামিয়া আফরানের মৃত্যুর ঘটনাটি, ঠিক জানি, সমস্ত সংবেদনশীল মানুষের মনেই দাগ ফেলতে সক্ষম হয়েছে। ভেতরে ভেতরে তাদেরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে একটি অমোঘ প্রশ্ন: দুর্ঘটনার বলি এমনভাবেও হতে পারে কোনো মানুষ?
০৩)
শিল্পীদের সংবেদনশীলতার মাত্রা সাধারণত ভিন্ন হয়। সত্যি বলতে, তীব্র বেদনাদায়ক কিছুর মুখোমুখি হলে একজন সাধারণ সংবেদনশীল মানুষ যখন হয়ে ওঠেন মুহ্যমান, শিল্পী বরং তখন হয়ে ওঠেন সক্রিয়। সেই বেদনা, সেই ট্রমা যদি তাকে সত্যি স্পর্শ করে থাকে, তবে তিনি চান তার বেদনার একটা শিল্পরুপ তৈরি করতে। একটা দেশভাগ, একটা মুক্তিযুদ্ধ, বা একটা কাছের মানুষের মৃত্যু তাই জন্ম দেয় অনেক সিনেমা, বহু গান, অজস্র গল্পের।
ভাবি, সামিয়া আফরান জামালের বেদনাদায়ক মৃত্যুটি কি কোনো লেখককে স্পর্শ করেছে? কোনো গল্পকার কি চেষ্টা করবেন অন্য একটি অপরাধের দুর্ভাগ্যজনক বলি হয়ে পড়া সামিয়াকে শিল্পের মাধ্যমে চিরস্থায়ী করে দিতে? অন্ধকার কোনো গল্পের সম্ভাব্য একটি চরিত্র কি হয়ে উঠতে পারেন সামিয়া?
০৪)
খানিক ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে আসি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ লেখক এবং পাঠকদের মাঝে ‘ডিসটোপিয়া’ শব্দটা ব্যবহারের একটা প্রবণতা খেয়াল করছি। একদিকে যেমন কিছু উপন্যাসে (মূলত তরুণরা যাদের লেখক) কর্তৃত্ববাদী কারো অধীনে ভবিষ্যতের একটা ক্রুর, খল, অন্ধকারাচ্ছন্ন রুপ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে; অন্যদিকে তেমন তরুণ পাঠকদের একাংশও অন্ধকার কোনো ভবিষ্যতের আভাস পেলেই সেই লেখাকে ‘ডিসটোপিয়ান’ আখ্যা দিয়ে অতিরঞ্জিত করে তুলছে। বলাই বাহুল্য, এ পর্যবেক্ষণ আমার ব্যক্তিগত।
কোনো বিশেষ লেখার ‘ডিসটোপিয়ান’ হয়ে ওঠার শর্ত কী– তেমন কোনো সাহিত্য-বিতর্ক এই আলাপের লক্ষ্য নয়। ডিসটোপিয়ান সাহিত্যের অতীতকে সংক্ষিপ্ত করে কেবল এটুকু বলি, ‘ডিসটোপিয়া’ বলতে যে সব রচনাকে আমরা একনামে চিনি (‘নাইনটিন-এইট্টি-ফোর’, ‘হ্যান্ডসমেইড টেইল’, কিংবা ‘ফারেনহাইট ফোর-ফিফটি-ওয়ান’), তাদের সবই রচিত উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপের লেখকদের দ্বারা, যারা কখনও কর্তৃত্ববাদী শাসনের আওতায় আসেননি। এই ধারার রচনাগুলোর (এবং পাঠকদেরও) মূল চালিকাশক্তি ছিল একটা আশঙ্কা: যদি আমরা কোনো একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে চলে যাই, তবে কী হবে!
অথচ অন্যদিকে, সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন, যে নিজে দীর্ঘদিন ছিল কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে, সেখানে কিন্তু লেখক বা পাঠকদের ক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট ওই শঙ্কা ডিসটোপিয়ান ঘরানা রচনার প্রণোদনা হতে পারেনি। একটা কারণ অবশ্যই সেন্সরশিপ। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, ডিসটোপিয়ান রচনায় অনুমিত যে ‘ভয়ানক ভবিষ্যৎ’ থাকে, সেটা তো ওই অঞ্চলে ১৯২০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত একপ্রকার বাস্তবই হয়ে গেছে! এ অবস্থায় লেখকেরা নতুন করে ডিসটোপিয়া দিয়ে আর কী ভয় দেখাবেন পাঠককে!
ডিসটোপিয়া নিয়ে এই ইতিহাস আওড়ানোর কারণ আর কিছু নয়, এটুকু সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে বাস্তব যখন হয়ে ওঠে কল্পনার চাইতে নারকীয়, সাংবাদিকের চেয়ে লেখকের কাজ তখন অনেকগুণ কঠিন। যে সব তরুণ লেখক ডিসটোপিয়া রচনার চেষ্টা করছেন আমাদের সমকালে, বোধ করি রীতিমতো ঐশ্বরিক কল্পনাশক্তি না হলে তারা হার মানতে বাধ্য বাস্তবের পাশে।
কিন্তু এই সংশয়ের সাথে আরেকটি পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন না করলেও চলে না, এবং সেই পর্যবেক্ষণটাই চূড়ান্ত নৈরাশ্যজনক। এই যে কদর্য সব ভবিষ্যত অনুমানের চেষ্টা চলছে আমাদের লেখকদের মাঝে, তার কারণ কি এই যে আমাদের দেশে এর চেয়ে অদ্ভুত সময় আর আসেনি? যে বাস্তবে গুলিবিদ্ধ মা বেঁচে যায় অথচ মৃত্যু হয় তার গর্ভে থাকা সন্তানের, যেখানে শুকনো রাস্তায় নির্মাণ করা হয় সেতু, যে পৃথিবীতে নর্দমায় ভেসে যায় গাদা-গাদা টাকা; সেই সমকালের চাইতে অদ্ভুত কি আর কিছু হতে পারে?
০৫)
নারকীয় এই অদ্ভুতুড়ে বাস্তবে তাই সামিয়া আফরানও কল্পিত কোনো গল্পের আলোড়ন তোলা চরিত্র হয়ে উঠতে পারে না।
সংবাদপত্রের ধারাবাহিক প্রতিবেদন কিংবা আদালতের আইনি ধারাবিবরণীতে সামিয়ার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তার বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্রত্ব, কারখানায় কাজ করা বাবা, শান্তিবাগে তাদের দুই কামরার বাসা এবং অতিথি এলে সেই বাসায় স্থান সংকুলান না হবার স্থূল-প্রাচুর্যহীনতার মাঝে। এসবের আড়ালে ওই মানুষটি যেন নেহাতই একটা নাম, ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকবার উদাহরণে একটা পরিসংখ্যান কেবল।
আর গাছে গাছে কোকিলের ‘কোকেইন! কোকেইন!’ বলে চিৎকার করবার এই বসন্ত আমাদের চারপাশে এমন মোহময়; যে সামিয়া আফরানের নামটা মনে গাঁথবার আগেই কোথাও চলে আসে তনু, কোথাও চলে আসে নুসরাত, কোথাও চলে আসে আবরার। এদের প্রত্যেকের মৃত্যুই এমন অকাল এবং কল্পনাতীত নির্মম, যে আমাদের গোটা জগতটাকেই বোধ হতে থাকে ধুরন্ধর কোনো নির্মাতার রিয়েলিটি শো; হয়তো এখান থেকে বিদায় নেওয়া চরিত্রেরা অন্য কোনো জগতে গিয়ে সুখী জীবনই কাটাচ্ছে।
… লেখক তাই ভাবতে গেলেই আক্রান্ত হয় অপরাধবোধে। তার মনে হতে থাকে, লেখার টেবিলে নিরাপদ বসে কাগজের বুকে সামিয়া আফনানের প্রতি ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বর্ণনা করা এক মারাত্মক দ্বিচারিতা হচ্ছে তার জন্য। দরজা বন্ধ করে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছে যে লেখক, অরক্ষিত সামিয়ার অন্তিম রিকশাভ্রমণকে বর্ণনা করতে চাওয়াটা কি তার সাজে? লেখকের কাজ কি তবে জীবনে অংশ না নিয়েই জীবনকে বর্ণনা করা? প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলতে চায় না বলে, লেখকদের তাই আর সামিয়াকে লেখা হয়ে ওঠে না।
সামিয়া আফরানের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, কারণ তাকে নিয়ে কিছুই লেখা হবে না। তিনি থেকে যাবেন অনামা কোনো লেখকের কোনো অলিখিত গল্পের চরিত্র হয়ে, গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে যাকে দেখা হবে দুর্ঘটনার বলি হিসেবেই।
[মার্চ, ২০২২]
Leave a Reply