২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক (অন্য পর্বগুলো পাওয়া যাবে এইখানে)। আশা করি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ চালু থাকবে বছর জুড়েই। আজ এর তৃতীয় পর্ব।
(১) সত্যজিতের শতবর্ষ / হিল্লোল দত্ত
“এগুলো ঠিক প্রবন্ধ নয়, গবেষণা নয়, স্মৃতিচারণ নয়, রম্যরচনা নয়; এককথায় বলতে গেলে ব্যক্তিগত রচনা বলা যায় …” – মুখবন্ধে এই সাফাই গেয়েছেন লেখক হিল্লোল দত্ত; সেই হিল্লোল দত্ত- বই কিংবা বই সংক্রান্ত যার বিভিন্ন আলাপ আকর্ষণীয় গদ্যে অনলাইনের নানা জায়গায় পড়ে আসছি প্রায় এক যুগ। সত্যজিৎ-কে নিয়ে হিল্লোলের এই রচনা-সংকলন পড়তে তাই মুখিয়ে ছিলাম, পড়া হলো কদিন ধরে।
২৮০ পাতার ঝরঝরে গদ্যে লেখা বইটা পড়তে যে কয়েকটা দিন লাগলো, তার কারণও হিল্লোল বলেছেন মুখবন্ধে, যে উরুগুয়ের সাংবাদিক এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর লেখার ধারাটা কিছুটা প্রভাব ফেলেছে এই ছোট আকারের প্রবন্ধগুলো রচনায়। গ্যালিয়ানোকে যারা পড়েছেন, তারা জানেন, বিন্দুর মাঝে সিন্ধু ধরতে ওস্তাদ ওই লোক, কবিতার মতো কয়েক চরণেই ইতিহাসের সামগ্রিকতা তিনি তুলে আনতে পারতেন। কিন্তু চুটকি সাইজের ওইসব রচনা হজম করতে টাইম লাগে বলেই গ্যালিয়ানোকে টানা পড়া যায় না, কয়েকটা ভুক্তি পড়েই বিরতি না নিলে একঘেঁয়ে লাগতে থাকে শব্দের মোচড়গুলো। সত্যজিতের শতবর্ষ নিয়ে হিল্লোল দত্তের আলোচ্য সংকলনে গ্যালিয়ানোর মতো শেষ বাক্যের চমক নেই; কিন্তু টানা পড়তে গেলে – যতই গড়পারের মানিকময় হোক- মন বসানো যায় না।
সংকলনের বেশ কিছু ছবি ফিল্মের নেগেটিভের মতো অস্পষ্ট। আর যেহেতু অধিকাংশ প্রবন্ধের কলেবরও ছোট, ফন্ট কমিয়ে পেপারব্যাক আকারে আনলে আরও আকর্ষণীয় হতে পারতো সংকলনটা। কিন্তু ওসব অগ্রাহ্য করে যখন বইয়ের ভেতর উঁকি মারা যায়, লেখকের উদ্দেশ্যে তখন সত্যিই বলতে হয়ঃ চাটগাঁয়ের ছেলে, তুমি দ্যাখালে ভাই!
লেখকের বিপুলের শ্রমের পরিচয় পাওয়া যায় সংকলনটার পাতায় পাতায়। পাঠক হিসেবে মজা পাই বাঙালি হয়েও আমের প্রতি সত্যজিতের বিতৃষ্ণার কথা পড়ে, ওয়ার্ডলময় এই যুগে হতাশ হতে হয় সত্যজিতের নিজের আবিষ্কৃত শব্দজাল খেলাটি হারিয়ে যাওয়ায়। সুচিত্রা সেনের সাথে সত্যজিতের দ্বৈরথের কথা পড়ে চমক লাগে, শিশুর মতো আনন্দ পাওয়া যায় লোকটার টিনটিনপ্রেম দেখে। তবে বইয়ের ফুটেজ অধিকাংশ খেয়ে নিয়েছেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিত। জানি, মানুষটার সেই পরিচয়টাই সর্বাধিক উল্লেখ্য, তবুও লোকটার শিশুসাহিত্য আর আঁকাবুকির কথা যেন একটু আড়ালেই থেকে গেলো এই সংকলনে।
পরম পূজনীয় সত্যজিতের বদলে লোকটার ‘দোষে-গুণে মানুষ’ সত্তাটাকেই সামনে আনার প্রশংসনীয় চেষ্টা করেছেন হিল্লোল দত্ত। কিন্তু মহারাজের দোষগুলো নিয়ে লেখাগুলো- এক মৃণাল সেনের সাথে পত্রিকার ওই পত্রবিনিময় বাদ দিলে- ঠিক জমলো না যেন। ‘ওথেলো সিন্ড্রোম’কে তাই বড্ড সংক্ষিপ্ত মনে হয়, তেমনই ‘শালবৃক্ষের মতন সিনা’ কে মনে হয় অকারণে বড় করা।
পাঠকের বরং ভালো লাগে সত্যজিতের lighter side গুলোই। কল্পবিজ্ঞানে কেমন আগ্রহ ছিলো সত্যজিতের, উত্তমকুমার কীভাবে তাকে নাজেহাল করেছিলেন, বিজয়ার সাথে আলাপের জন্য কীভাবে গুপ্ত সংকেত আবিষ্কার করেছিলেন সত্যজিত; সিনেমা-নির্মাণ জনিত উৎকর্ষতার বদলে এগুলো পড়তেই ভালো লাগে পাঠকের।
সব মিলিয়ে, সত্যজিত রায় বর্ণিল জীবনের কিছু আকর্ষণীয় অংশ জানতে যারা চান, বিশেষত স্বল্প কথায় ও ব্যতিক্রমী ভঙ্গীতে, ‘সত্যজিতের শতবর্ষ’ তাদের জন্য একটা খোরাক হতে পারে।
(২) সুরাইয়া / শিবব্রত বর্মন
তিন বছর আগের এক ভোরে ঘণ্টা দুয়েক টানা পড়ে শেষ করেছিলাম ‘বানিয়ালুলু’, এবং ততক্ষণাৎ ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম শিবব্রত বর্মনকে, সেবা প্রকাশনী-ময় শৈশবের রহস্যপত্রিকার সেই অলীক গল্পগুলোর স্বাদ আরেকবার ফিরিয়ে দেওয়ায়। আর এবার, আবারও এক বসাতেই ‘সুরাইয়া’ পাঠ শেষ করে মনে হলো, বিদেশি গল্পের ব্যাকাপ হিসেবে নয়, শিবব্রত একদম নিজ অধিকারমন্ডিত একটি বাংলা গল্প-ধারা তৈরি করে নিয়েছেন।
বইটা পড়ে যেটুকু আশাহত হতে হয়, তার কারণ ‘বানিয়ালুলু’র গল্পগুলোর গড়মানের চাইতে ‘সুরাইয়া’-এর গল্পেরা মোটাদাগে পিছিয়ে। ‘দাবা’, ‘চেইন ক্যাফে’ বা ‘হামশাকল’; এই গল্পগুলোর রাস্তা বেশ অনুমানযোগ্য।
চিন্তাবীজ বাদে বাকি সবকিছু শিবব্রতের কাছে, মোটা দাগে, বাহুল্য। গল্প না বলে তিনি- বোর্হেসের মতোই- খেলতে চান আইডিয়া বা চিন্তাবীজ নিয়েই। ‘লোকটা’ গল্পটা এই ঘরানার সেরা উদাহরণ। পরিসর তৈরি হতে না হতেই গল্পটা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই চিন্তাবীজ ঠিকই আলোড়িত করে গেছে পাঠককে।
সংকলনের সেরা তিনটা গল্প কী হতে পারে?
তিন নাম্বারে থাকবে ‘নিষিদ্ধ’। যে ঘরানার গল্প বলতে চান শিবব্রত, তার একটা ভালো উদাহরণ এই গল্পটা। কী হলে কী হতে পারে, তার একটা প্রকল্পিত অনুমান বা হাইপোথিসিস নির্ভর এই গল্পটা এগিয়েছে গতিময় কথোপকথনের মাধ্যমে, ‘উনলৌকিক’ ওয়েব-সিরিজে খ্যাতি পেয়ে যাওয়া ‘দ্বিখন্ডিত’ বা ‘মিস প্রহেলিকা’ -এর মতো।
দুই নাম্বারে থাকবে, ‘উত্থান’ গল্পটা। একটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই গল্পে, আঙ্গিকের নিরীক্ষা আর নানা রকম ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি ব্যবহার করে। যেই চিন্তাবীজের কথা বললাম একটু আগে, শিবব্রত এই গল্পের শেষ লাইনে তারই একটা প্রমাণ রেখেছেন।
আর সংকলনের সেরা গল্প, নিঃসন্দেহে নামগল্পটা, ‘সুরাইয়া’। চমৎকার কোনো আইডিয়া যখন পায় গল্প হয়ে ওঠার পরিবেশ আর ভাষা, তখন যে কী বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে, এই গল্পটা তার সার্থক উদাহরণ। এই একটি গল্প এমনই দুর্দান্ত, বাংলা ভাষায় ফ্যান্টাসি ঘরানার কোনো ছোট্ট তালিকা করলেও ‘সুরাইয়া’ সেখানে জায়গা করে নেবে।
শিবব্রত বর্মনের পরবর্তী সংকলনের জন্য মুখিয়ে রইলাম।
[মার্চ, ২০২২]
Leave a Reply