২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আশা করি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ চালু থাকবে বছর জুড়েই। আজ এর দ্বিতীয় পর্ব, এই পর্বে রয়েছে দুটো গল্প সংকলন নিয়ে আলাপ।

(১) তখন গল্পের তরে / রিফাত আনজুম পিয়া

রিফাত আনজুম পিয়ার প্রথম গল্প-সংকলন ‘তখন গল্পের তরে’ হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই দেখা যায় গল্পকার সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি অদীর্ঘ ভূমিকা। অনুজ লেখকদের উৎসাহ দিতে গিয়ে- সাহস করে বলি- এ ধরনের মুখবন্ধ রচনায় অগ্রজ লেখকেরা সাধারণত কিছুটা অতিরঞ্জন করেই থাকেন। সেই ছোটোলোকি চিন্তা মাথায় নিয়েও সৈয়দ মনজুরুলের বক্তব্যটা পড়তে গিয়ে পাঠক যে চমকে যায়, তার কারণ একটা ব্যক্তিগত উপলদ্ধিঃ অক্ষর কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

মুগ্ধ পাঠকের সৎ প্রতিক্রিয়াকে, আমার বিশ্বাস, আলাদা করা যাবে সমস্ত কিছুকে পণ্যায়িত করবার এই অনলাইন রিভিউর যুগেও। আলোচ্য সংকলনের শুরুতে সৈয়দ মনজুরুলের ওই ভূমিকাটিও তাই- যতই সংক্ষিপ্ত হোক- পোশাকি কাঠামোর ভেতরেও ফুটিয়ে তুলেছে প্রাজ্ঞ পাঠকের ব্যক্তিগত ভালো লাগা। আমি তাই রিফাতকে পড়তে বসি কিছুটা বাড়তি আগ্রহ নিয়ে, এবং ঘণ্টা দুই ধরে তার গল্প-সংকলনটা পড়ে উঠে টের পাই, মনজুরুলের সেই ভালো লাগা আমারও সঙ্গী হয়ে উঠেছে।

‘তখন গল্পের তরে’কে নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে যে কথাটি মাথায় আসে, তা হলো, গল্পগুলো নতুন। নতুন বলতে এমন নয় যে এখানে মানুষের সংকটগুলো নতুন, সেগুলোর তো আসলে বিবর্তন হয় না, আন্না কারেনিনা থেকে আয়েশা খাতুন কি আদিবা জামানের যুগেও সেগুলো একই থেকে যায়। নতুন যা, তা হলো গল্পগুলোর উপস্থাপন। রিফাতের গল্পেরা নিশ্চিত ভাবেই একবিংশ শতাব্দীর সন্তান। এই শতাব্দীর মানুষেরা যেভাবে মোকাবিলা করছে মানুষের বহুদিনের পুরোনো সংকটগুলোকে, রিফাত সেগুলোকে- অন্য সব দক্ষ গল্পকারের মতোই- উপস্থাপন করেছেন নিজের সময়ের ভাষায়। পর্যবেক্ষণ বলো, বা ভাষার কারুকাজ, সব কিছুতেই গল্পকার একটা নিজস্বতার আভাস দিয়ে যান প্রতিনিয়ত।

একটি ব্যতিক্রম ছাড়া রিফাতের সমস্ত গল্পের পটভূমি নগরের। কিন্তু ভিন্ন সময় আর বিভিন্ন অবস্থানের হয়েও রিফাতের কেন্দ্রীয় চরিত্ররা সকলেই মিশে গেছে একটা জায়গায়ঃ তারা প্রত্যেকেই- মুরাকামির গল্পের জগতকে উলটে দিয়ে- ওম্যান উইদাউট ম্যান। এমন নয় যে এই চরিত্রদের নিজের কেউ নেই। তাদের স্বামী আছে, প্রেমিক আছে, ফেসবুক বন্ধুও অগণিত; কিন্তু তাদের মনের মানচিত্রে কোনো এক গোপন স্থান আছে, যার অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের মালিকানা তারা কোনো পুরুষকে দেয়নি তো বটেই; বরং সময়ে সময়ে তারা নিজেই সেখানে হয়ে ওঠে অবাঞ্ছিত। বেঁচে থাকার জন্য নিঃসঙ্গতা বলে যে ট্যাক্স দিতে হয়, তার ভারে ন্যুব্জ এই মানুষগুলো সংকলনের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ায়।

সংকলনের সবগুলো গল্পই রিয়ালিস্ট ধারার। কিছু কিছু গল্প তো রীতিমতো উপন্যাসের বীজ বুনে রেখেছে ভেতরে। এবং অনেকদিন পরে কোনো সংকলন পড়া হলো, যেখানে গল্পকার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন ছোটগল্পের একটা খুব পুরাতন কায়দা, শেষ বাক্যের ধাক্কা। সমকালীন গল্পকারদের ঈর্ষা জাগানোর মতো ব্যাপার, বহু পুরোনো এই কায়দাকেও রিফাত প্রায় প্রতিবারই ব্যবহার করেছেন দুর্দান্তভাবে।

সংকলনের সেরা গল্প বলে মনে হয় ‘বৃত্তস্থ ত্রিভুজ’কে। ভাইয়ের প্রাক্তন প্রেমিকাদের নিয়ে, এই গল্পে, কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনোজগতে তৈরি হওয়া নতুন ধরনের এক বিপ্রতীপ কোণ এঁকেছেন রিফাত। ‘যে দিন গেছে’ বা ‘ট্রানজিট লাউঞ্জ’ও পাঠককে স্বাদ দিয়েছে নতুন যুগের জটিলতাময় গল্পের।

রিফাত আনজুম পিয়ার আরও গল্প সংকলনের অপেক্ষায় থাকলো পাঠক।

(২) অরিগামির গোলকধাঁধায় / মাহরীন ফেরদৌস

মাহরীন ফেরদৌসকে টুকটাক পড়ি অনলাইনের এদিক-সেদিক, নানা ওয়েবজিন কিংবা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে। তার গল্পগ্রন্থ ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ তাই হাতে নেই আগ্রহ ভরে, দেখতে চাই মলাটবদ্ধ একটা কাঠামোতে তার অক্ষরগুলো কীভাবে স্পর্শ করে পাঠককে। আর অনুভব করি, সংকলনটাকে শেষ করে তা নিয়ে মনে প্রথম যে শব্দটা আসে, সেটা হলো ‘বৈচিত্র্য’।

বৈচিত্র্য কথাটা এজন্যেই মাথায় আসে, কারণ ছোট্টো এই সংকলনের গল্পগুলোর স্বাদ অবিমিশ্র নয়। একটু সময় নিলেই আবিষ্কার করা যায়, তিন ধরনের গল্প আছে এই সংকলনে। একভাগে রয়েছে খাঁটি বাস্তবতার গল্প, একটা ধারায় আছে নিত্যদিনের বাস্তবের সাথে যাদু মেশানো পরাবাস্তব কিছু গল্প; আর একটা ধারা- পাঠকের মনে হয়- রুপকথা ধাঁচের; যেখানে গল্প বলা হয়েছে ‘এক দেশে ছিলো এক অমুক’ ঘরানায়।

এমন তিন-স্রোতা গল্পের সম্মিলনের ফলে যেটা হয়েছে, সংকলনটাকে টানা পড়তে গেলে পাঠককে বেশি কষ্ট করতে হয় না। একটা গল্পকে আত্মস্থ করবার জন্য অল্প বিরতি নিয়েই পরের গল্পে চলে যাওয়া যায়। মধ্যবর্তী ওই বিরতিটা আবার দরকার, কারণ মাহরীন প্রধানত গল্প বলেন মনোলোগ বুনে বুনে, সংলাপের ব্যবহার তার অল্পই। এবং লক্ষ করা যায়, তিনটি ধারায় গল্প বলতে গিয়ে মাহরীনের ভাষাও বদলে গেছে বারবার। আর বাইরের এসব আবরণকে উপেক্ষা করে যদি অক্ষরগুলোর হৃদয়ের দিকে তাকানো যায়, খেয়াল করা যাবে, গল্প লেখার মূল উদ্দেশ্য মাহরীন বিস্মৃত হয়নি, সে কেবল গল্পই বলতে চেয়েছে।

তবে, অক্ষরের নিজস্ব দুনিয়ার ব্যাকরণ মেনে পাঠককেও যেহেতু পাল্টাতে হয় গল্পের ধরন অনুযায়ী, সংকলনের তিন ধারার গল্পের সাথে পাঠকের বোঝাপড়াও হয় তিন রকমের।

প্রথমেই আসি রুপকথা ধাঁচের গল্প প্রসঙ্গে। এদের পড়তে গিয়ে মনে পড়েছে সম্প্রতি পড়া উমবার্তো একোর একটা আলোচনার কথা। একো বলেছিলেন, যখনই বড়দের কোনো গল্প শুরু হয় ওই ‘এক দেশে ছিলো এক অমুক’ ধাঁচে, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের মন তখন নিজেকে বসিয়ে দেয় কোনো শিশুর জায়গায়, যেন সে দাদীর গা ঘেঁষে গল্প শুনছে। স্যাঁৎ-একজ্যুপেরির ‘লিটল প্রিন্স’ ঘরানার এই রচনাগুলো লেখা খুব কঠিন, কারণ বুড়ো পাঠককে দীর্ঘক্ষণ খোকার জায়গায় আটকানোটা সহজ ব্যাপার নয়। মাহরীনের এই ধাঁচের গল্পগুলো (‘চাঁদের গায়ে ছায়া’, ‘পৃথিবীর শেষ গান’) পড়তে গিয়ে, পাঠকও অনুভব করে বারবার, তার ভেতরের বুড়োটা বারবার বেরিয়ে আসতে চাইছে।

কিন্তু গল্প যত বাস্তবতার দিকে যায়, মাহরীন ততই হয়ে ওঠেন নিখুঁত। নিঃসন্দেহে তাই ‘মথ’, ‘এক কামরার ঘর’ বা ‘চক্র’ এর মতো যাদু মেশানো গল্পগুলো বেশি ভালো লাগে রুপকথার চাইতে। এই পরাবাস্তব ধারা আর পুরোদস্তুর বাস্তব ধারার যে গল্পগুলো সংকলনে আছে, তাদের সবগুলোর উপস্থাপন আনকোরা নতুন হয়ে ওঠেনি, কিন্তু যখনই মাহরীন নতুন দিনের ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তার চরিত্রদের সংকটগুলো, গল্পগুলো সত্যি হয়ে গেছে চমৎকার। সংকলনের সেরা তিনটা গল্পই (‘রুবি তোমাকে চিনি’, ‘চেকলিস্ট’, ‘প্যারাকজম’) এই দাবির পক্ষে জোরগলায় সাক্ষ্য দেবে। বিশেষ করে ‘চেকলিস্ট’ গল্পটা বহুদিন মনে রাখার মতো।

‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ তাই, সব মিলিয়ে সাক্ষর দেয়, লেখালেখির যাত্রায় মাহরীন ফেরদৌসের একের পর এক নতুন স্টেশন পেরিয়ে যাওয়াকে। আমরা তো জানি যে চলমান ট্রেন একসময় ঠিকই লক্ষ্যে পৌঁছে।

[মার্চ, ২০২২]