২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইগুলো পড়া শেষে আমার এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আশা করি, এই স্বেচ্ছা-উদ্যোগ চালু থাকবে বছর জুড়েই। আজ রইলো এর প্রথম পর্ব, থাকলো দুটো গল্প সংকলন নিয়ে আলাপ।
(১) রাইরিন্তার শেষ উপহার / মাহবুব ময়ুখ রিশাদ
মাহবুব ময়ূখ রিশাদের গল্প পড়ছি বোধহয় প্রায় এক দশক হয়ে গেলো। ব্লগমণ্ডলের পাতা থেকে কাগুজে বইয়ের পাতায় তার যে যাত্রা, বললে অন্যায় হবে না যে সেই বিবর্তনের আমি একজন সাক্ষী। এবং বছরের পর বছর ধরে তাকে অনুসরণ করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, রিশাদের লেখা উপভোগ করতে হলে- ঠিক যেমনটা করি হারুকি মুরাকামির ক্ষেত্রে- মনের যুক্তিচালিত অংশটাকে তালাবদ্ধ করে রাখতে হয়। অন্যভাবে বললে, রিশাদের জগতকে আমাদের তখনই ভালো লাগে, যখন আমরা ঘটনার কারণ না খুঁজে ঘটনার স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেই।
রাইরিন্তার শেষ উপহার’ নামের সংকলনের ক্ষেত্রেও এই যুক্তি খাটে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে রিশাদের সেরা কাজ ছিলো ‘তর্কশয্যায় মৃত্যু’ নামের গল্প-সংকলনটা, তবে এখন থেকে ‘রাইরিন্তার শেষ উপহার’ও সমানে সমানে টক্কর দেবে সেই বইটির সাথে।
এই সংকলনে ঘুরে-ফিরে এসেছে কয়েকটা উপাদান। জন্ম-মৃত্যু, অন্তর্ধান, রুপবদল। এই উপাদানগুলো গল্পে আসে বেশ রিশাদ-সুলভ রাস্তায়, সোজা বাংলায় অদ্ভুতুড়ে উপায়ে। তবে এবার রিশাদের লেখায় লক্ষ করি একটা নতুন প্রবণতা। এমনিতে প্রকৃতি যে নানা কিছু ঘটায়, রিশাদের জগতে আমরা তা নিত্য দেখি। তবে, এবার ‘প্রকৃতি’ নামক সত্তাটার প্রতি গল্পকারের অতিমুগ্ধ হয়ে মাথা নোয়ানোর ব্যাপারটা কিছু গল্পে বেশ মাইকিং করে জানানো হয়েছে।
নামগল্পটার কথাই ধরা যাক। প্রকৃতি অর্নিলকে কীভাবে নিজের এক পরীক্ষার অংশ করে তুললো, এই নিয়ে বেশ টানটান একটা গল্প। শুরুর এই গল্প থেকেই বইটার প্রতি পাঠকের মনোযোগ বেড়ে যায়। আরেকটু এগিয়ে গেলে ‘রেবেকা’ গল্পটায় আবার দেখা যায় প্রকৃতির সেই পরীক্ষার আরেকটা দিক, যখন পূর্বপুরুষের বদলে শোনা যায় উত্তরপুরুষের গল্প।
পড়তে গিয়ে টের পাই, মানুষী সম্পর্কের কয়েকটা দিক দারুণভাবে আক্রান্ত করেছে গল্পকারকে। এই প্রেক্ষিতে ‘রিওনা’ গল্পটা খুবই চমৎকার। আবার, ততটা ভালো না হলেও ‘সম্পর্ক শহর’ গল্পটাও একই বিষয়ে কথা বলেছে।
সমকালকে এড়িয়ে যাবার উপায় গল্পকারদের কখনোই থাকে না। সে কারণেই আমরা দেখি এই বইয়ের গল্পে মুছে যাচ্ছে জীবিত ও মৃতের ভেদাভেদ (‘এই মৃত শহরে’); আমরা দেখি, আমাদের নিকটজনকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে স্পষ্টবাদিতার অপরাধে (‘সুনর্ম’); আমরা দেখি, আমাদের সমকাল এমনই অসহনীয় যে আত্মুহত্যার অধিকার চাইছে মানুষ (‘হাতি’)। রিশাদের গল্প আমাদের আঘাত দেয়, যখন দেখি সুন্দর সবকিছু হয়ে যাচ্ছে ভোগের সামগ্রী (‘ডুমুর পাখির মাংস’), যখন দেখি এমনকি কাছের মানুষও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমাদের ছলনায় (‘যেমন খুশি তেমন সাজো’)।
মানুষের অবিরাম রুপবদলের এই সব খণ্ডচিত্রই উঠে এসেছে রিশাদের রচনায়। রিশাদের জগত পছন্দ করা পাঠকের জন্য তাই ‘রাইরিন্তার শেষ উপহার’ বেশ উপভোগ করবার কথা।
(২) এক সন্ধ্যায় শ্যামশ্রী রায় / হামিম কামাল
কোন লেখককে আমাদের সবচেয়ে পছন্দ? উত্তর সহজ। যাকে পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে হয়ঃ এই কথাটা আমারই বলার কথা ছিলো, কিন্তু গুছিয়ে বলার ভাষা আমার জানি না, এই লেখক জানেন। সত্যি বলতে, হামিম কামালকে পড়তে গিয়ে আমার কখনোই মনে হয় না তার গল্প কি উপন্যাসের এই কথাটা আমি বলতে চাই।
আপাত রুঢ় এই কথাটা শুনে হয়তো ভুরু কুঁচকে যেতে পারে অনেকের। আমি তাই এই বক্তব্যের বিপরীত রুপ উপস্থাপনের জন্য একটা মধুর কথা বলিঃ হামিম কামালের পৃথিবী তার নিজের, সেই পৃথিবীর রাগ-দ্বেষ-ক্লেদ-ভালোবাসাকে সে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মতোই, পাঠকের অনুভূতির সাথে সমসুর না হয়ে তারা কাজ করে আরেকটা- উঁচু বা নিচু নয়, বরং পৃথক- স্কেলে। সেই পৃথিবীর কথা তাই, হামিম ছাড়া অন্য কারো বলার সাধ্যই নেই।
হামিমের লেখাপত্র পড়ছি, সেও প্রায় অর্ধ-দশক হয়ে গেলো। মনের মাঝে একটু খচখচানি নিয়ে বলেই ফেলি, গল্প সংকলন ‘এক সন্ধ্যায় শ্যামশ্রী রায়’ তার এখন পর্যন্ত সেরা কাজ।
হামিমকে পড়তে গেলে অনুভব করা যায়, তার বিচরণ নিরলস দিবাস্বপ্ন দেখার মাঝে। তার জগৎ এমনই কাব্যিক, যে সেখানে অনুষঙ্গ হয়ে থাকে আমাদের নগরজীবনে ব্রাত্য হয়ে থাকা বাঁশি, কলসি আর অরণ্য। সেই জগতে আমরা দেখি এমনকি ঢাকা শহরও ইচ্ছেমাফিক ট্রেন চলার পথ পেতে দিচ্ছে রমনার আশপাশে, লোকাল বাসের কুত্তার-বাচ্চা-মার্কা জটের মাঝেও মাত্রার অতিরিক্ত কোনো ক্ষোভ কি জিঘাংসা ছাড়াই মানুষ বসে বসে বই পড়ছে। আমাদের চারপাশ, নিত্যদিনের যে পপ-কালচারময় দুনিয়া, হামিমের জগৎ তা থেকে আলাদা। লক্ষ করি, ‘এক সন্ধ্যায় শ্যামশ্রী রায়’ বইতে আমাদের একবিংশ শতাব্দীর ঢাকা থেকে একটিমাত্র উপকরণ প্রবেশ করেছে সেই জগতেঃ কিন্ডল।
তবু যে আলোচ্য গল্প-সংকলনটা পড়তে গিয়ে তীব্র ভালো লাগে, কারণ পাঠক আবিষ্কার করে, লেখক প্রকৃতপক্ষে রুপকথা বুনেছে সেখানে। রুপকথা পড়তে আমাদের ভালো লাগে, কারণ কেবল সেখানেই কবিতার শব্দেরা দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয় কোনো তরুণীকে (‘আন্দালুসিয়া’); রুপকথা আমাদের শিহরণ দেয়, কারণ কেবল সেখানেই কারো নিঃশ্বাসের বাতাস দিয়ে বাজানো যায় বাঁশি আর চুরি করে নেয়া যায় তার প্রাণ (‘সুরেলা’)। রুপকথা তো আসলে ইচ্ছাপূরণ, সেখানে চাইলেই কাগজে পেন্সিল নামিয়ে কেউ ভেদ করতে পারে ঢাকার যানজট (‘যানপ্রেতের বর’), সেখানে চাইলেই মৃত প্রেমিক আত্মহত্যায় প্ররোচিত করতে পারে প্রেমিকাকে (‘প্রেমিক’)। সংকলনের প্রতিটি গল্পই আসলে এমন পরাবাস্তবতায় মাখা। ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচাইতে ভালো লেগেছে ‘পাঁচকন্যা পরিবার’ আর ‘এক সন্ধ্যায় শ্যামশ্রী রায়’।
বইটা পড়তে গিয়ে, হামিমের নিয়মিত পাঠক হিসেবে মনে জাগে আরেকটা ভাবনা। বলতে ভয় হয়- তবু বলে ফেলি সাহস করে- হামিমের কাজ করবার ক্ষেত্র হিসেবে ছোটগল্প অনেক বেশি মানানসই। যেহেতু সে রুপকথা বুনে, সেই জগতের নিয়মেরা তাই আমাদের নিত্য বাস্তবের পৃথিবীর সাথে তুলনায় যথেষ্ট শিথিল। ছোটগল্পের আঁটোসাঁটো বাঁধুনিতে সেই শিথিলতা চমৎকার কুণ্ডলী পাকিয়ে রয় শীতঘুমে থাকা সাপের মতো। অন্যদিকে, মাধ্যম হিসেবে উপন্যাস নিজেই শিথিল। কাজেই যখনই হামিম নিজের কাহিনিকে নিয়ে যায় উপন্যাসে (তারই উপন্যাস ‘জাদুকরী ভ্রম’ বা ‘লিন্ডার বাগানবিলাস’ এ যেমনটা হয়েছে), সেটার অন্তর্গত বাড়তি শিথিলতা তখন নানা ধরনের অসামঞ্জস্য তৈরি করে পাঠকের মনে, গল্পের রসটাকে সে পুরোপুরি আস্বাদন করতে পারে না।
আমরা আশা করবো, একদিন উপন্যাসের সংহতি নিয়ন্ত্রণের সেই আরাধ্য চাবিটিও চলে আসবে হামিম কামালের কাছে। কারণ আমরা দেখছি, তিনি অবিরাম সাধনা করে চলেছেন। আর যখন কেউ অবিরাম সাধনা করেই চলে, সাহিত্য তখন, সাধারণত, তাকে ফেরায় না।
[মার্চ, ২০২২]
Hamim Kamal
Glad to hear from our great Shuhan.