অনেকেরই জানা, দুটি চলকের মাঝে সম্পর্ক পাওয়ার জন্য ছক কাগজের বুকে যে বেস্ট ফিটেড কার্ভ (Best Fitted Curve) আঁকা হয়, সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে যদি আমরা মাত্র দুইটি বিন্দুর অবস্থান জানি। অথচ যদি আরেকটা বিন্দু যোগ হয়, কোনো ছকের প্রকৃত গতিপথ বোঝার সম্ভাব্যতা তখন অনেকটা বেড়ে যায়। আমার ধারণা, লেখার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা খাটে।
লেখক হিসেবে নতুন না হলেও উপন্যাস হিসেবে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ মাসরুর আরেফিনের মাত্র তৃতীয় কাজ। মাসরুরের আগের দুইটি উপন্যাসও বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ার ফলে ঔপন্যাসিক হিসেবে লোকটার যাত্রাপথ কীভাবে এগোচ্ছে, সেটা জানার একটা কৌতূহল পাঠক হিসেবে ছিলোই। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সেই জিজ্ঞাসায় কিছুটা আলো ফেললো।
‘সমকাল’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় একই নামে প্রকাশিত একটা বড়গল্পকে দীর্ঘ পরিসরে এনেই রচিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসটা। পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করি, শুরুটা তার দুর্দান্ত।
কী এক কাজের অজুহাতে মস্কো গিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশের এক পত্রিকা সম্পাদক, কিন্তু আসলে সে খুঁজে পেতে চায় তার বড় ভাইকে, কমিউনিস্ট পার্টির দল-উপদলের বিভাজনে জড়িয়ে খুনের দায় মাথায় নিয়ে যে বড় ভাই দুই যুগেরও আগে দেশত্যাগ করে থেকে গেছে এই রাশিয়ায়। অন্যদিকে সেই সম্পাদকেরই বাল্যবন্ধু কামাল বর্তমানে এই রাশিয়ার কেষ্টবিষ্টু, দারুণ প্রতিপত্তি ও অঢেল সম্পদের মালিক সে, পুতিনের নিজস্ব বৃত্তের মানুষ। শৈশবে এক স্কুলশিক্ষকের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো কামাল আর সম্পাদক, দুই বন্ধু। হয়তো সেই দুঃসহ স্মৃতির ভারেই কামালের প্রতি আমাদের সম্পাদক এক ধরনের নৈকট্যের অনুভূতি আজও লালন করে।
চমৎকার এক পটভূমি।
কাহিনি খানিক এগোলেই পাঠকের পরিচয় হয় মস্কোবাসী সাদাতের সাথে, যে সম্পাদকের কী এক বন্ধুর ছোটভাই। ছোটোখাটো ব্যবসায় লস খেয়ে সাদাতের এখন গরীবী হাল, তবুও চোখ ট্যারা করে দেওয়া সুন্দরী স্ত্রী ভ্যালেন্তিনাকে নিয়ে সে বড়দার বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছে একটা কারণেইঃ তদবির। ক্ষমতাবান বন্ধু কামাল ভাইকে বলে সম্পাদক যদি কোনো গতি করতে পারেন তার।
সম্পাদকের কৌতূহল হয়। সত্যিই কি তার ছেলেবেলার বন্ধু কামালের অমন ক্ষমতাবান? সেই জিজ্ঞাসার উত্তর জানতে গিয়েই আমাদের সম্পাদক কামালের বেন্টলি গাড়িতে চড়ে যাত্রা করে আন্ডারগ্রাউন্ডের দিকে। সেখানে, বেশ পরাবাস্তব এক বর্ণনায়, টাকা এবং ক্ষমতার গরমে কাঁপতে থাকা কামাল চোখে আঙুল দিয়ে তার বাল্যবন্ধুকে বুঝিয়ে দেয়, পৃথিবীটাকে কারা চালাচ্ছে।
ক্ষমতার পেছনের সেই রাজনীতির সাথে আরেকটা দিকে টর্চ মারে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস, সাহসী মানুষের কণ্ঠরোধ। আমরা দেখি, সাদাত এবং ভ্যালেন্তিনাকে নিয়ে আমাদের সম্পাদক ঘুরতে যান তার প্রিয় কবি ওসিপ মান্দেলশ্তাম -এর স্মৃতি যাদুঘরে। সেই ওসিপ মান্দেলশ্তাম, যিনি বিশ শতকের অন্যতম সেরা রাশান কবি, যিনি স্তালিনকে কবিতায় খোঁচা মেরে বিরাগভাজন হয়েছিলেন ক্ষমতার, যাকে ধীরে ধীরে হত্যা করেছিলো রাষ্ট্র; সেই ওসিপ মান্দেলশ্তামের স্মৃতি বিজড়িত যাদুঘরে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি, কবির স্মৃতি রক্ষা করতে সুরম্য যাদুঘর বানিয়ে রাখলেও গোটা সিস্টেমটা আজও দুর্নীতিপরায়ণ। আমরা বুঝতে পারি মানুষ মাত্রেই জাতিবিদ্বেষী আর দুর্নীতিপরায়ণ, আমরা দেখি স্বামীর একটা চাকুরির জন্য কামাল নয় শুধু- ভ্যালেন্তিনা প্রস্তুত এমনকি সম্পাদকের সাথেও বিছানায় যেতে।
পটভূমির এই উৎকর্ষতার সাথে, উপন্যাসের প্রথম অংশটুকু তরতর করে পড়ে ফেলার ফাঁকে লেখককে তারিফ দেই আরও একটা কারণে, ভাষা। আগের দুটো উপন্যাসের চাইতে এবারে যেন ভাষিক নিরীক্ষায় আরো দুঃসাহসী মনে হয় মাসরুরকে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় তার বাক্য, সিলভার বার্চের দুপাশে বাড়ানো ডাইনির ঝাড়ুর মতো হাত আর শৈশবের বরিশালের ভাটিখানার নালায় খলবল করা করকিনা মাছ; সবাই সেখানে আশ্চর্য সজীব। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস এগিয়ে যায় সেই ভাষায় ভর করেই।
তবে, স্বীকার করতে হয়, ভাষার এই কেরদানি থাকলেও গতিশীল এই উপন্যাসের শেষে পাঠকের মনে হয় যেন সে এক ধরনের অসমসত্ত্ব মিশ্রণের মুখোমুখি হয়েছে।
কারণ পৃথিবীটাকে কারা চালায়, আর কীভাবে সাহসী মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়; এই দুই প্রশ্নের প্রত্যেকটি নিজগুণেই বড্ড ভারি। প্রশ্নদুটিকে একত্রে মোকাবেলায় আখ্যানের যে গড়ন পাঠকের কাছে কাম্য ছিলো, মনে হয়, সেই পথে না হেঁটে মাসরুর যেন তাদের উত্তর খুঁজলেন আলাদা দুটি আখ্যানে। এবং শেষে উপন্যাসের দুই ভিন্ন সুরের অংশকে ওয়েল্ডিং করে দিলেন তিনি। দুই বা ততোধিক ভিন্ন ভরকেন্দ্রের টানাপোড়েন প্রায়ই কোনো উপন্যাসকে আকর্ষণীয় করে তোলে পাঠকের কাছে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা ঘটে না। বরং জানার কৌতূহল হয়, মাসরুরের চিন্তার মূল বীজটি কোন ভরকেন্দ্রগামী ছিলো, অর্থাৎ বড়গল্প হিসেবে এই আখ্যানকে প্রকাশকালে ঠিক কোন প্রশ্নকে কেন্দ্র করে তিনি তার কথাগুলো বুনেছিলেন।
উপন্যাসে মাসরুরের কলমের দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তিত্বও বেশ নজর কাড়ে। ব্যাপারটা খানিক ব্যাখার দরকার আছে।
প্রয়াত সৈয়দ হকের একটা প্রিয় খেলার কথা পড়েছিলাম, যেখানে তিনি কোনো গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করতেন, কোন জায়গায় লেখক একটা বিরতি নিয়েছেন। অর্থাৎ, লেখাটার ঠিক কোন জায়গায় এসে লেখক লিখতে শুরু করেছেন ভিন্ন মেজাজ বা মানসিকতা নিয়ে- পাঠকের দৃষ্টি থেকে সেটা বুঝতে চাওয়া। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের ক্ষেত্রে, ভাষার ওই স্প্লিট পার্সোনালিটি বেশ স্পষ্ট কিন্তু! কারণ শৈশবের প্রদীপবাবু, ওসি মিজান কিংবা বরিশালের অন্যান্য স্মৃতিরা যখন সামনে এসেছে, উপন্যাসটা অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তখন। অথচ লেখকের হাতে ইতিহাসের বয়ান কিংবা আন্ডারগ্রাউন্ডের সুররিয়াল জগত অঙ্কন যেন ততোটা মনে দাগ কাটে না। তবে এটাও ঠিক, এই আপাত বিশৃঙ্খলাটার মাঝে একটা শৃঙ্খলাও কীভাবে যেন আছে। ফলে সন্দেহ হতে থাকে এই দ্বৈত সুর লেখকের সচেতন ভাবেই আরোপ করা।
মাসরুরের উপন্যাসগুলোয় চরিত্রদের আদলে যে পাশ্চাত্য-নির্ভর ছাঁচের উপস্থিতির কথা আগেও বলেছিলাম, এবারও সেটার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। খুঁজে পাওয়া গেছে বৈশ্বিক উপন্যাসের শ্রেণিভুক্ত একরকমের বিশেষ ঘরানার প্রতি মাসরুরের আকর্ষণও। বেস্ট ফিটেড কার্ভ এর সূত্র ইঙ্গিত দেয়, এই ব্যাপারটি প্রকৃতপক্ষে হয়তো মাসরুরের নিজের স্বরটাকেই বহন করছে, হয়তো ‘দা গ্রেট বাংলাদেশি নভেল’ তার অভীষ্ট নয়। হয়তো, স্বদেশের চাইতে সমকালটাই মাসরুরের চিন্তাজগতে আবর্তিত হয় বেশি।
তবে তার জন্য লেখাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোও চলে না। আমরা তো জানিই যে আজকের পৃথিবীতে কবিদের স্মৃতি বিজড়িত যাদুঘরে গিয়েও সেলফোনকেই বেশি গুরুত্ব দেয় মানুষ, সেই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে নিজের স্বরে কথা বলায় লেখকের দিকে আঙুল তুললে স্তালিনের সাথে পাঠকের আর পার্থক্য থাকে কই?
[জানুয়ারি ২০২২]
Leave a Reply