বহুদিন ধরেই মাসুমুল আলমকে পড়বো পড়বো করি। বন্ধুর কাছ থেকে তার উপন্যাস ‘র্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো’ যোগাড় পর্যন্ত করা হয়, তবুও কেন জানি তাকে পড়া হয়ে ওঠে না। শেষ পর্যন্ত, কোনো এক সন্ধ্যায় সমমনা কজনের সাথে হাতিরপুল এলাকার কনকর্ডের কোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে চোখে পড়ে যায় মাসুমুলের ২০২১ এ প্রকাশিত উপন্যাস ‘রঁদেভু’। এবং তখন, দীর্ঘদিনেও ‘…কানাগলির হুলো’কে আক্রমণ না করবার উদাসীনতা আমাকে এমন অপরাধী করে তোলে, যে আরো বইয়ের সাথে উদ্দিষ্ট উপন্যাসকে না কিনে আমার উপায় থাকে না। এবং অবশেষে মাসুমুল আলম পাঠ আমার শুরু হয়, উপন্যাস ‘রঁদেভু’ দিয়েই।
এক কথায় বলতে গেলেঃ দুজন মানুষের নিজস্ব মনোলগ আর মেসেঞ্জারের নিভৃতে তাদের আলাপ, সাথে নানা জায়গা থেকে মেরে দেওয়া পত্রিকার সংবাদ-কবিতা-টুকরো গদ্য; ইত্যাদির কোলাজে এক অপ্রচলিত ঘরানা অনুসরণ করে এই উপন্যাস গড়িয়ে গেছে।
আঙ্গিকের নতুনত্ব নিয়ে পরীক্ষার ব্যাপারটা আমার কাছে মোটা দাগে দুইরকম।
কল্পনা করুন যে আপনার পরিচিত কেউ নতুন বাড়ীতে উঠেছে, আর আপনি সেখানে অতিথি হয়ে গেছেন। এক ধরনের নিরীক্ষায় পাঠকের কাছে পরিবেশের নতুনত্বটা প্রকট হয়ে ওঠে না, বরং পরিচিত গৃহকর্তার সাথে সে সহজেই আলাপে জমে যেতে পারে, অর্থাৎ উপন্যাসে ডুবে যায় দ্রুতই। অন্য ধরনের নিরীক্ষায় আঙ্গিকের ভাঙাচোরাটা এমন, যে পাঠকের মনে হয় গৃহকর্তা এখনো নতুন বাড়িতে আসবাবপত্র ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারেননি। এই ধরনের নিরীক্ষাপ্রবণ লেখার ক্ষেত্রে পাঠকের যতই ইচ্ছা থাকুক, মূল উপন্যাসে ঢোকবার আগে কিছুক্ষণ তার মন লাগামহীন ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় ঘরের এখানে-সেখানে। ‘রঁদেভু’ উপন্যাসকে, আমার মনে হয়েছে দ্বিতীয় দলের।
কিন্তু আঙ্গিকের সেই মাতামাতি ছেড়ে, বাহ্যিকতার আবরণ ভেদ করে পাঠক যদি সত্যিই প্রবেশ করতে চায় উপন্যাসের কেন্দ্রে, শেষতক সে কী পায়? পায়ঃ মাঝবয়েসি দুজন লিখতে চাওয়া মানুষের সংলাপ। সেই সংলাপরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একে অন্যের পিঠ চুলকে দিচ্ছে, কখনো কখনো তারা দিচ্ছে যৌন ইঙ্গিত, কখনো তারা হয়ে উঠছে আঘাত করার মতো আক্রমণাত্মক।
কথোকথনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, গল্পের নারী চরিত্রটি বেশ সামাজিক, টুকটাক লেখালেখিও করে। বাড়ির ভোজসভা থেকে শহরের সাহিত্যসভা, সর্বত্রই সে প্রগলভ, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার বিচ্ছিরি রকমের মুগ্ধতা। পেশাজীবী স্বামীর মাঝে মানসিক বোঝাপড়া গড়ে না ওঠায় এই মহিলা কেবলই আকৃষ্ট হয় চারপাশের শিল্প-সাহিত্য মারানো লোকেদের প্রতি। কিন্তু সেখানে তার দশা মানিক ব্যানার্জীর সেই কুসুমের মতো। মন তার আছে, কিন্তু ওটাকে নিয়ে কী করবে- তা বুঝে উঠতে পারছে না বলে অন্যদের কাছে সে কেবল শরীর’ই হয়ে ওঠে।
গল্পের পুরুষ চরিত্রটি অন্যদিকে আবার বেশ উন্নাসিক। লেখাটা ভালো হয় না বলে সে নিজে লেখে না ঠিকই, কিন্তু নারী চরিত্রটির সামাজিক বৃত্ত যাদের নিয়ে, ওসব রাইটার্স ক্যাম্প আর নৌবিহার করে বেড়ানো পোষা লেখকদের সে গোণে না। মূলত এসব নিয়েই সে ইনবক্সে খোঁচাখুঁচি করে চলে নারীটির সঙ্গে।
চ্যাটবক্সের বাইরে এসে পাঠক যখন দুজনের মনোলগের দিকে তাকায়, নারী চরিত্রটিকে তার মনে হয় অনেক আপন। কারণ নিজের কাছে নিজেকে খোলাসা করতে সে দ্বিধা করেনি। সে জানান দিয়েছে নিজের গোপন ট্রমার কথা (যা এসেছে শৈশবের যৌন নিপীড়ন থেকে), বলেছে নিজের যৌন সঙ্গীদের কথা। জানান দিয়েছে নিজের ভণ্ডামিও, যখন নিজের ছেলেকে বাড়িতে আটকে রেখে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে রাস্তায় নামা কিশোরদের জন্য সে নিয়ম করে কষ্ট পেয়েছে। অথচ পুরুষ চরিত্রটা সেদিক দিয়ে থেকে যায় পাঠকের দূরের। মুখে তুষার রায় আর ভার্গাস ইয়োসা জপতে জপতে সাহিত্য উদ্ধার করে ফেললেও এই মানুষটির সকল চিন্তার গন্তব্য যেন শয্যা। নুনুর্ষু মানুষটি কি তবে সে কারণেই একসময় কিছুটা ঈর্ষাপরায়ণ, আগ্রাসী হয়ে উঠলো?
হয়তো। পাঠক কেবল দেখেঃ সঙ্ঘ নয় শুধু, সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কও ভেঙে যায় ক্রমশ। থাকে শুধু মেসেঞ্জার, দুজনের মুখ ফেরাবার রীতি। পাঠক অনুভব করে; ওয়েবপোর্টাল, নোটিফিকেশন আর রাজনীতি নিয়ে সমকাল কি দারুণভাবে হারিয়ে দিচ্ছে লিখতে চাওয়া মানুষদের।
পরাজিত ওই দুজন মানুষের সংলাপ ছাড়া উপন্যাসে আরো এসেছে তিন কেজি নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, তিন পাউন্ড ইদি আমিন, আধ গেলাস কোভিডের দুনিয়া, কয়েক ছটাক সাত্রে, জিম জারমুশ, সন্দীপন। পাঠক সেই খিচুড়ি উপভোগও করে, কিন্তু বালের আলাপ (আক্ষরিক অর্থেই) জাতীয় ব্যাপারস্যাপার তার ভালো লাগে না। কে জানে, হয়তো ঠিক এই ব্যাপারগুলোই ভালো লাগবে অন্য কোনো পাঠকের। বিশেষত, কেউ যদি যুক্তি দ্যায়, যে ‘রঁদেভু’ র ব্লার্ব স্বয়ং যখন বলছেঃ ‘এই উপন্যাসে বিহবল ফুল্ল-কোমলতা, প্রচল সৌন্দর্যবোধ অথবা নান্দনিকতাকে হত্যা করা হয়েছে।‘, তখন হয়তো নান্দনিকতা খুঁজে খুঁজে হন্য হওয়াটা পাঠকেরই দোষ।
বিপরীতে বলতে হলে, মৃদুস্বরের চিরকুট লিখে পাঠক হয়তো দৃষ্টি আকর্ষণ করাবে উদ্ধৃত ওই বাক্যের ‘উপন্যাস’ শব্দটির দিকে। সুবিমলমিশ্রের ‘তেজস্ক্রিয় আবর্জনা’ কিংবা ডেভিড মার্কসনের ‘দিস ইজ নট আ নভেল’ ঘরানার অ্যান্টি-উপন্যাস ঘরানার রচনা হলে এ প্রসঙ্গ উঠতোই না, কিন্তু ‘রঁদেভু’ তো উপন্যাসই হতে চেয়েছে। আর যে রচনা উপন্যাস হতে চায়, তাকে নিতান্ত হত্যাকারী বেয়োনেট হয়ে উঠতে দেখাটা পীড়াদায়ক তো বটেই।
কিন্তু যদি বেয়োনেট হওয়াটাই উপন্যাসের এইম ইন লাইফ হয়ে থাকে, তবে?
পাঠক এবার নিরুত্তর থাকে। কারণ পুরাতন এই প্রশ্নটা আজও অমীমাংসিত। আর সাহিত্য, চিরকালই অমীমাংসিত প্রশ্নদের সামনে নিয়ে আসে।
[জানুয়ারি, ২০২২]
Leave a Reply