আহমাদ মোস্তফা কামালের লেখার সাথে আমার পরিচয় একটা অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে, মূল আলাপে যাবার আগে সেটা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

মাত্রই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে আমি তখন নিজে টিউশনি ঠ্যাঙ্গানো শুরু করেছি। আমার ছাত্রের বাড়ি সায়েন্স ল্যাবের পাশের এক অ্যাপার্টমেন্টে। ছোকরা নির্বোধ ধরনের, তবে সন্ধ্যা গড়ালে নাস্তা পানি ভালো দেয়। সেই প্রণোদনাতেই সপ্তাহে দিন তিনেক যাই। এভাবে মাসখানেক যাবার পরে পরীক্ষা নেয়ার পালা এলো। ছাত্রকে দেড়ঘণ্টার উপযুক্ত ক্যালকুলাস আর বলবিদ্যা দাগিয়ে আমি বসে উসখুশ করছি (তখনো এযুগের মতো স্মার্ট ফোনের ছড়াছড়ি হয়নি যে ফেসবুক কি ইউটিউবে ঢুকে সময় পার করে দেবো), না পারতে একসময় তাই উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করলাম। এবং তখনই, বিছানা পাশের নিচু মতো এক টেবিলে আবিষ্কার করলাম আহমাদ মোস্তফা কামালের উপন্যাস ‘আগন্তুক’। লেখকের নামও আমার তখন অচেনা, নিছক সময় কাটাতে বইটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলাম।

এবং চমকে গেলাম। কে এই লেখক? দশটা নতুন লেখকদের সাথে তুলনায় বেমানান রকম পরিণত লেখা, কেন্দ্রীয় চরিত্রের মনোজগৎ যেন মনে করাচ্ছে কাম্যুর ‘আউটসাইডার’কে।

অন্য সময় হাতে নিলে কী হতো বলা মুশকিল, তবে সামনে ছাত্র নিয়ে চারপাশ নীরব হয়ে থাকা ওই বিশেষ পরিবেশে, আহমাদ মোস্তফা কামাল নামের ওই আগন্তুক আমাকে একেবারে অধিকার করে নিলেন। মনে পড়ে, সেদিন না পারলেও কয়েক দিন ধরে গোটা বইটা আমি শেষ করেছিলাম ওই ছাত্র পড়ানোর ফাঁকেই। আহমাদ মোস্তফা কামালের নামটা আমার বিশেষ ভাবে মনে থাকার কারণ, সেই ছাত্রের বাসায় আর কখনোই কোনো মননশীল বই দেখিনি আমি। সত্যি বলতে, ধর্মীয় কিছু পুস্তিকা বাদে কোনো বই’ই দেখিনি বাসাটিতে। সাহিত্য জগতের সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন সেই মধ্যবিত্ত পরিবারে কী করে ‘আগন্তুক’- এর মতো একটি অস্তিত্ববাদী উপন্যাস গিয়ে পড়েছিলো, জানতে আমার আজও কৌতূহল আছে।

কৌতূহল আছে এটা জানতেও, আহমাদ মোস্তফা কামাল কেন আরও বেশি পঠিত লেখক হয়ে উঠলেন না। তার ভাষা মায়ের মতোই আটপৌরে, আঙ্গিকের প্যাঁচ-পয়জার কেটে তিনি বিরক্ত করেন না পাঠককে, তার গল্পগুলোও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিটোল গল্পই হয়ে ওঠে; তবু কেন তিনি পাঠকের আছে আরও গৃহীত হলেন না আজতক? কে জানে!

আপাতত অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাচ্ছি না। কামালের গল্প-উপন্যাস নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা জায়গায় আলাপ হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে নিশ্চয়ই; আমি বরং চাই এই আলাপে সৃজনশীল সাহিত্যের বাইরেও অকল্পসাহিত্যের যে বিস্তৃত আঙিনাটা কামালের আছে, সেদিকে সম্ভাব্য কিছু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে।

স্বীকার না করে পারি না, আহমাদ মোস্তফা কামালের অকল্পসাহিত্যের হাতটি ঈর্ষণীয়। সময় নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, পাঠ-প্রতিক্রিয়া সংক্রান্ত আলাপ, কিংবা নেহাত হালকা মুক্তগদ্য হোক; সব সময়েই কামাল নিজের ব্যক্ত করতে চাওয়া কথাটা বলতে পারেন বেশ গুছিয়ে। অন্তর্দৃষ্টির কারণে তার বিশ্লেষণ যেমন সারশুন্য হয় না, তেমনই তথ্যসূত্র টেনে ভারী করবার চাইতে ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণের ওপরেই কামাল আস্থা রাখেন বেশি। ফলে তার অকল্পিত রচনাগুলোও পড়া যায় দারুণ স্বচ্ছন্দে।

আগ্রহীদের জন্য ভাল ব্যাপার, আহমাদ মোস্তফা কামালের এ জাতীয় রচনার সংখ্যা একেবারে অল্প নয়। ফলে তার ভাবনা জগতের সাথে পরিচিত হবার পথও পাঠকের একাধিক। আজকের আলাপে, আমি চাইবো, কামালের সেইসব রচনাগুলোর মাঝ থেকে ব্যক্তিগত পছন্দের তিনটিকে বেছে নিতে।  

১) বাংলা গল্পের উত্তরাধিকার

আহমাদ মোস্তফা কামালের সেরা কাজ।

বাংলা ছোটগল্পের ঐতিহাসিক বিবর্তন নিয়ে নানা ধরনের আলাপ পাওয়া যাবে বিচ্ছিন্নভাবে, সংকলনও চোখে পড়বে অনেক। শ্রেণিবিভাগ করলে কামালের লেখাটিও হয়তো সে দলেই যাবে। তবু যে কামালের বইটি বিশেষ করে মনে জায়গা নেয়, কারণ তার ভঙ্গি সমালোচকের, কিন্তু আত্মাটা সৃজনশীল লেখকের।

বাংলা ছোটগল্পের এক সর্বভুক পাঠক হিসেবে সাহিত্যের ওই বিশেষ ধারাটিকে পর্যালোচনা করেছেন কামাল। রবীন্দ্রনাথের হাতে সূচনা, তারপর প্রভাতকুমার-শরৎচন্দ্র পেরিয়ে কল্লোলের বুদ্ধদেব-প্রেমেন্দ্র, তারপর জগদীশ গুপ্ত, বনফুল, তিন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রসঙ্গে ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল্লিশের দশকে এসেই কামাল ঢুকে গেছেন মূলত বাংলাদেশে বা পূর্ববঙ্গে। মূলতঃ বললাম ঠিকই, কিন্তু একইসাথে পশ্চিমবঙ্গের ছোটগল্পে কী ঘটছে, সেটাও লেখক স্বল্পভাষে আলাপ করতে ছাড়েননি। তাছাড়াও বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারাটি নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে মাইলফলক হিসেবে কামাল প্রবন্ধ টেনেছেন বেশ কিছু লেখককে নিয়ে; যার মাঝে আছেন ওয়ালীউল্লাহ, আবু রুশদ, আবু ইসহাক, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের ও শহীদুল জহির।

বোধ হয়, সমালোচকের সাথে লেখকের পার্থক্য তৈরি হয়ে যায় কোনো সাহিত্য নিয়ে তৈরি আলোচনায়। সমালোচক কোনো লেখাকে আক্রমণ করেন এমনভাবে, কঙ্কালটা বড় নগ্ন হয়ে যায় তখন। কিন্তু একজন লেখক যখন উন্মুক্ত করেন অন্য কোনো লেখকের করণকৌশল, পাঠক আবিষ্কার করে, আতস কাচের নিচে থাকা রচনাটাকে সে যেন আরো বেশি ভালোবেসে ফেলে, পড়ার আগ্রহ তার আরও বেড়ে যায়।

ব্যক্তিগত এই পর্যবেক্ষণ খুব করে খেটে যায় কামালের উদ্দিষ্ট সংকলনের জন্য। অত অত গল্পের আলাপ, তবুও তা কিছুতেই যেন প্রথাগত সাহিত্য সমালোচনা বা ইতিহাস হয়ে ওঠে না লেখকের পরিমিতির জন্য। বাংলাদেশের ছোটগল্পের যাত্রাপথ অনুসন্ধানে আগ্রহী পাঠকের জন্য এই সংকলন তাই অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করি।

২) হিরণ্ময় কথকতা

লাতিন আমেরিকার কোনো লেখক কিংবা ইউরোপের কোনো চলচ্চিত্রনির্মাতা সম্পর্কে যখনই আগ্রহ জাগে, অন্তর্জাল ঘেঁটে কোনো ভালো সাক্ষাৎকার বের করে তাদের মনোজগতে ঢোকার চেষ্টা করি। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় যে সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করা হয়, সেগুলোর প্রায় শতভাগই জোড়াতালি মারা। ফলে সাক্ষাৎকারের পথ ধরে গতাসু কোনো কৃতী মানুষের কাছে যাওয়াটা আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব।

সেই প্রেক্ষিতে, আহমাদ মোস্তফা কামাল সম্পাদিত ‘হিরণ্ময় কথকতা’ একটা চমৎকার সংকলন। সাক্ষাৎকার কামাল খুব কম নেননি, সেগুলো নিয়ে ‘তাঁহাদের সঙ্গে কথোপকথন’ নামেও একটা সংকলন তার আছে। কিন্তু ‘হিরণ্ময় কথকতা’-কে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, কারণ এই সংকলনটি মাহমুদুল হককে নিয়ে।

সেই রহস্যময় মাহমুদুল হক, খ্যাতির তুঙ্গে থেকেও যিনি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন, নিজেকে দিয়েছিলেন একরকম স্বেচ্ছা নির্বাসন; তাকে নিয়ে বাংলাদেশের পাঠকদের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। ‘হিরণ্ময় কথকতা’ সেই আগ্রহের অনেকটাই মেটাতে পারে।

মাহমুদুল হকের স্বেচ্ছা নির্বাসনের জীবনের বেশ কিছু সময় তার সাথে আড্ডা দিয়েছেন কামাল। এক পর্যায়ে সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন তার। সেই মোলাকাতের বর্ণনা ছাড়াও এই সংকলনে জায়গা পেয়েছে মাহমুদুল হকের আরো কিছু চমৎকার সাক্ষাৎকার; গ্রহীতা হিসেবে ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী, প্রশান্ত মৃধা ও হামীম কামরুল হক, ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ, আবু হেনা মোস্তফা এনাম, আদনান সৈয়দ প্রমুখ।

যেমনটা হয় এই ধরনের বইগুলোতে, নানা ব্যক্তি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বলে কিছু কথার হয়তো পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু সেগুলোকে ছাপিয়ে পাঠককে স্পর্শ করে যায় নানা প্রসঙ্গে মাহমুদুল হকের বক্তব্য। তার ওপরে শহীদ সাবেরের প্রভাব নিয়ে তিনি যেমন খোলামেলা, তেমনই আমাদের লেখকদের জনপ্রিয়তার লোভ নিয়েও মাহমুদুল হক কথা বলেছেন সরাসরি। লেখালেখির সাথে তার বিচ্ছেদ কেন ঘটলো, সেই উত্তরের সাথে পাওয়া যায় নিজ উপন্যাসের ভাষা বা প্রকরণ নিয়ে মাহমুদুল হকের বক্তব্যটাও।   

সব মিলিয়ে ‘হিরণ্ময় কথকতা’ বাংলাদেশে মাহমুদুল হক চর্চায় এক গুরুত্বপুর্ণ সংযোজন।   

৩) শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়

সংশয়ীদের ঈশ্বর’ নামে কামালের আরও একটি প্রবন্ধ সংকলনের সাথে দীর্ঘক্ষণ তুলনা করে এগিয়ে রাখতে হলো ‘শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়’ -কেই।

তুলনাটা এজন্যেই আসছে, যে দুটো বইতেই আলাপের ধরনটা এক। বোঝাই যায়, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মনে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ভাবনাকে গুছিয়ে আনতে গিয়েই ওই দুটো পাণ্ডুলিপিতে হাত দিয়েছিলে লেখক। পার্থক্য কেবল বিষয়বস্তুতে। ‘সংশয়ীদের ঈশ্বর’ বইয়ের আলাপের বিষয়বস্তু যতটা ব্যক্তিগত, ‘শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়’ এর ভরকেন্দ্রটা ততটাই সামাজিক।

তবে শুধু সমাজকে (অন্ততঃ তার একটা অংশকে) ধরতে চেয়েছে বলেই নয়, ‘শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়’-কে এই তালিকায় বেছে নেবার একটা বড় কারণ, সেটার প্রাসঙ্গিকতা।

বইটির কেন্দ্রীয় প্রবন্ধগুলোতে মূলত ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারাটিকে। এরকম নির্দিষ্ট কোনো শব্দ দিয়ে সাহিত্যের কোনো ধারাকে চিহ্নিত করা আমার কাছে মুশকিল, এটাও জানি যে ফেসবুকের যুগে এমন ‘পলিটিকালি ইনকারেক্ট’ শব্দবন্ধ ব্যবহারের কারণে কোর্টমার্শালও হয়ে যেতে পারে লেখকের। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে ‘শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো আজ থেকে একযুগ পূর্বে যখন সাইবারস্পেস হয়ে ওঠেনি সর্বব্যাপী; আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, মনের গহীনে আমরাও জানি সাহিত্যের এমন কিছু স্রোত চিরকালই থাকে, যারা সৎ নয়।

আহমাদ মোস্তফা কামাল এই সংকলনে খোলামনে আলাপ করেছেন বাংলাদেশের সেই সাহিত্য ধারাটি নিয়ে। জনপ্রিয় সাহিত্যের পুরোধা ছিলেন যে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন- তাদের জনপ্রিয়তার কারণটা খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন কামাল। তাদের পরবর্তী প্রজন্মে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আনিসুল হকের কর্মকাণ্ডও উঠে এসেছে আলাপে। কামালের সমস্ত আলাপই যে ওই ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ এর পাশমার্ক পায়, তা নয়, বরং অনেক জায়গায় তাকে উন্নাসিক বলেই মনে হয়। কিন্তু এটাও ঠিক, যে নিজস্ব এক উপায়ে শেষতক তিনি আমাদের লেখকদের নানারকম স্বমেহনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেই ছাড়েন। বিশেষ করে সংকলনের প্রথমার্ধের লেখাগুলো তাই বেশ উপভোগ্য।

 

সংক্ষেপে এই হলো আহমাদ মোস্তফা কামালের অকল্পসাহিত্যের তিনটি টুকরো। আশাবাদ জারি রাখলাম, যে এ বইগুলোয় নজর বুলিয়ে ভবিষ্যতে কোনো পাঠক নতুন করে আবিষ্কার করতে চাইবেন কামালের অন্যান্য রচনাও।

[ডিসেম্বর, ২০২১]