কৌশিক মজুমদারের লেখার সাথে এবারই প্রথম আলাপ নয়, এই মাসখানেক আগেই পড়ার ভাগ্য হয়েছিলো তার রহস্যোপন্যাস, ‘সূর্যতামসী’। উনিশ শতকের কলকাতা শহরে একটি রহস্যময় খুন, ‘দারোগার দপ্তর’ খ্যাত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা বাংলার যাদুকরদের আদিগুরু গণপতি রায়ের উপস্থিতি, শ’খানেক বছর আধুনিক কলকাতাতেও পুরোনো সেই রহস্যের ফিরে আসা; কিছুই যেন বাদ যায়নি সে বইতে। অথচ অমন সব মুখরোচক জাংকফুডের আধিক্য সত্ত্বেও, ‘সূর্যতামসী’ পড়ে অনুভূতি হচ্ছিলো থ্রিলার নয়, রীতিমতো এনসাইক্লোপিডিয়া পাঠের।

মনে পড়ে, ফেলুদা একদা লালমোহন বাবুকে বলেছিলেন, ‘ভাবছিলাম, আপনার গল্প যতই গাঁজাখুরি হোক না কেন, স্রেফ মশলা আর পরিপাকের গুণে শুধু যে উতরে যায় তা নয়, রীতিমতো উপাদেয় হয়!’

সূর্যতামসী’ পড়ে আমার বোধ হচ্ছিলো ঠিক তেমনটাই, গল্প আগাগোড়া গাঁজাখুরি এবং জোড়াতালি দিয়ে মেলানো, মশলার গুণে উপাদেয় হয়নি ঠিকই, তবে উতরে যেতে কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু লেখক ঠিকই বাহবা আদায় করে নিয়েছিলেন। কারণ, কাগজ ঘেঁটে চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কারের মতো একটি বিরল গুণ চোখে পড়েছিলো ভদ্রলোকের লেখায়। অনেক ক্ষেত্রেই ‘সূর্যতামসী’ পড়ে বোঝা যাচ্ছিলো, অমুক অমুক বিষয়ে দারুণ পড়াশোনা আছে কৌশিক মজুমদারের, সুযোগ পেয়ে এই থ্রিলারে তিনি সেটা ঝেড়ে দিয়েছেন। মনে হচ্ছিলো, ওই একই বিষয়ে ভদ্রলোক কোনো অকল্পসাহিত্য (নন-ফিকশন) লিখলে, এবং তা পড়বার সুযোগ পেলে বেশ হয়।

তাই পড়া হয়ে গেলো শার্লক হোমসকে নিয়ে কৌশিক মজুমদারের লেখা ‘হোমসনামা’। বলতেই হয়, বেশ উপভোগ করেছি বইটাকে।

কী আছে এই বইতে? আছে, এককথায়, শার্লক হোমসের আদ্যোপান্ত।

বেকার স্ট্রিটের ওই গোয়েন্দা এবং তার ল্যাংবোট ডঃ ওয়াটসনকে রক্তমাংসের মানুষ কল্পনা করে বহু গবেষক হোমসের জন্ম-মৃত্যু-বংশ পরিচয়-কর্মকাণ্ড নিয়ে বিবিধ যেসব তত্ত্ব দিয়েছেন, কৌশিক মজুমদার সেগুলো পরিবেশন করেছেন একপাতে। আর্থার কোনান ডয়েলের লেখা চারটি উপন্যাস ও ছাপ্পান্নটি গল্প থেকে নানা যোগসূত্র কল্পনা করে গবেষকদের দাঁড় করানো এসব তত্ত্বের আওতা দেখে স্রেফ তাজ্জব বনে যেতে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে। উদাহরণে বলা যায় লোলা মনটেজের কথা। জোসেফ বেল নামের বাস্তবের এক চিকিৎসকের অনুকরণেই যে হোমসের সৃষ্টি, সে কথা আজ অনেকেরই জানা। কিন্তু আইরিন অ্যাডলার নামের চরিত্রটির মূল প্রেরণাও যে একজন বাস্তবের চরিত্র,  যিনি ছিলেন বাভারিয়ার রাজা লুডউইগের প্রণয়িনী লোলা মনটেজ, সে তথ্য আমরা কজন জানি?

ক্যানভাসারের ভাষায় বলতে গেলে তাই, এই বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন হোমস কবে কোথায় ক্যামন ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন, জানতে পারবেন শার্লক হোমস এবং আইরিন অ্যাডলারের পুত্র সন্তানের কথা (নিরো উলফ, মার্কিন লেখক রেক্স স্টাউটের সৃষ্ট এই চরিত্র নিজেও গোয়েন্দা), জানতে পারবেন যে হোমসের মঞ্চনাটকের একদম আদিপর্বেই শার্লকের সহকারী বিলি নামক ছোকরার ভূমিকায় একদা অভিনয় করেছিলেন চার্লি স্পেনসার চ্যাপলিন।

হোমসকে নিয়ে এসব দারুণ তথ্যের সমাহার ছাড়াও রচয়িতা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়েও বেশ বিস্তারিত আলাপ আছে ‘হোমসনামা’ তে। হোমসের চাইতে অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘরানার উপন্যাস লেখাতেই আগ্রহ বেশি ছিলো ডয়েলের, অথচ অর্থের প্রয়োজনে তাকে বারবারই ফিরে আসতে হয়েছে হোমস রচনায়। আর আজ আমরা জানি, নাইটহুড লাভ করা কোনান ডয়েলের যাবতীয় খ্যাতির প্রায় সমস্তটাই হোমসের হাত ধরেই আসা।

এছাড়া, দুনিয়ার নানা প্রান্তে (এমনকি বাংলাভাষী কলকাতাতেও) হোমসকে নিয়ে চর্চা বা মাতামাতি প্রসঙ্গেও লম্বা আলোচনা করেছেন কৌশিক মজুমদার। সিনেমা, মঞ্চ, বিজ্ঞাপণ, কার্টুন; নানা ক্ষেত্রে হোমসের পদচারণার একটা বেশ কালানুক্রমিক ছবি ফুটে ওঠে পাঠকের সামনে তখন। তার সাথে হোমসের সঙ্গে জড়িত অজস্র ছবি, খবরের কাগজের টুকরো; সব মিলিয়ে গোটা বইটাই হয়ে উঠেছে সংগ্রাহকদের জন্য একটা দারুণ লোভনীয় বস্তু।

তথ্যের সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার তৎকালীন ইংরেজ সমাজের প্রতিভূ হোমসের চরিত্র বিশ্লেষণও করা হয়েছে ‘হোমসনামা’ তে। অপরাধ সমাধানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শার্লকের চরিত্রের কালো কিছু দিকও তখন উন্মুক্ত হয়েছে পাঠকের সামনে।

যেমন, হাইস্কুলে পড়তে গিয়েই কিছু কিছু গল্পে ভারতীয়দের প্রতি হোমসের মন্তব্য পড়ে যে বেশ ইয়ে বোধ হতো আমার, দেখতে পেলাম, কৌশিক মজুমদারের আলাপেও শার্লকের সেই ব্যাপারটা ঠাঁই পেয়েছে। ‘দ্যা সাইন অফ ফোর’ উপন্যাসের কথাই খেয়াল করুন। কোনান ডয়েল যে শিখদের নাম হিসেবে মোহাম্মদ সিং, আবদুল্লা খান, দোস্তো খানকে উল্লেখ করছেন; সেইটেই তো ভারত সম্পর্কে তার অজ্ঞতা তুলে ধরতে যথেষ্ট। আবার হোমস যখন জোনাথন স্মলের আন্দামানি শাগরেদ টোঙ্গার শারিরিক বিবরণ দিচ্ছে, সেই বামনকে পরিচিত করাচ্ছে জাতিগত ভাবে নরখাদক বলে; তখন কিন্তু আমাদের প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্রের বর্ণবিদ্বেষটাও গোপন থাকে না। পাঠকের খেয়াল থাকতে পারে, এমনকি ‘দ্যা স্পেক্টেলড ব্যান্ড’ গল্পেও যখন ধুরন্ধর শয়তান ডঃ গ্রিমসবি রয়েলটকে বর্ণনা করা হচ্ছে, লোকটার রক্তপিপাসু মনোভাবকে বৈধতা দিতে গিয়ে তখন কারণ হিসেবে টানা হচ্ছে প্রাচ্যবাসীদের সংস্পর্শে তার কিছুদিন কাটিয়ে আসাটাকেই।

শুধু কি এই বর্ণবিদ্বেষ আর ঔপনিবেশিক মনোভাব? নিজের চারপাশের সমস্ত মানুষই কি হোমসের সমান মনোযোগ পেয়েছিলো?

খেয়াল রাখা দরকার, শার্লক হোমস সেই মানুষটি, যিনি দাবি করতেন যে লন্ডন শহরকে তিনি চেনেন হাতের তালুর মতোই, ‘দ্যা সাইন অফ ফোর’-এ কুয়াশা ঢাকা লন্ডনের বুকে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে তিনি বিড়বিড় করে রাস্তার নাম পর্যন্ত আওড়ে যাচ্ছিলেন ‘ওয়ার্ডসয়ার্থ রোড, প্রায়োরি রোড, লার্কহল লেন…’ বলে; অথচ গবেষণা কিন্তু বলছে অন্য কথা। হোমসের আবির্ভাবের বছর দুয়েক পরে, ১৮৮৯ সালে সমাজবিজ্ঞানী চার্লস বুথ লন্ডন শহরের একটা মানচিত্র বের করেন, যেখানে লাল রাস্তা দিয়ে চিহ্নিত করা ছিলো উচ্চবিত্তদের এলাকা, হলুদ দিয়ে উচ্চ মধ্যবিত্তদের, আর কালো রঙ ব্যবহার করা হয়েছিলো দরিদ্র (এবং অপরাধপ্রবণ, ইংরেজুদের কাছে ও যুগে দুটো শব্দ রীতিমতো সমার্থক) মানুষের এলাকা চিহ্নিত করতে। হোমস বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্কো মোরেত্তি সেই মানচিত্র ধরে প্রমাণ করে দিয়েছেন, যে শার্লক হোমস আজীবন ছুটে বেড়িয়েছেন ওই লাল কিংবা হলুদ চিহ্নিত রাস্তাগুলোতেই, দরিদ্র মানুষের এলাকায় তিনি পা পর্যন্ত রাখেননি কোনো গল্পে।

জানি, সমকালের সমস্ত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা কোনো লেখকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অল্পবয়েসি পাঠকের ভালো লাগাকে পরিণত মানুষের বোধবুদ্ধি দিয়ে মাপতে যাওয়াটাও হয়তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ একরকমের। শার্লকের খামতির তালিকা না করে এই আলাপ তাই শেষ করবো হোমসের প্রতি আমাদের মুগ্ধতার স্মৃতিকে খানিকটা উসকে দিয়ে, আর অবশ্যই, কৌশিক মজুমদারের চমৎকার বইটা পড়বার আমন্ত্রণ জানিয়ে।

হোমসকে একবার মেরে ফেলেও পাঠকের দাবিতে তাকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলেন স্যার কোনান ডয়েল, এ বিষয়ে সকলেই অবহিত। কিন্তু ওভাবে চলতে চলতে যখন হোমসের গল্পগুলো হয়ে উঠছিলো একঘেঁয়ে, তখন সত্যিই হোমসকে নিয়ে গপ্পো লেখা থেকে চিরকালের জন্য সরে দাঁড়ান ডয়েল। এবং, অবসর নেবার আগে, নিজের পছন্দের এক ডজন শার্লক গল্পের তালিকা তৈরি করেছিলেন লেখক তখন। হোমস ভক্তেরা চট করে সেই তালিকায় খানিক চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, আর চেষ্টা করতে পারেন গল্পগুলোকে ঠিকঠাক মনে করারঃ

  • দ্যা স্পেকটেকল্ড ব্যান্ড
  • দ্যা রেড হেডেড লীগ
  • দ্যা ড্যান্সিং ম্যান
  • ফাইনাল প্রবলেম
  • এ স্ক্যান্ডাল ইন বোহেমিয়া
  • দ্যা এম্পটি হাউজ
  • দ্যা ফাইভ অরেঞ্জ পিপস
  • দ্যা সেকেন্ড স্টেইন
  • ডেভিল’স ফুট
  • দ্যা প্রায়োরি স্কুল
  • দ্যা মাসগ্রেভ রিচুয়াল
  • দ্যা রাইগেট স্কোয়ার


গল্পগুলো মনে না থাকলে, ধরে নিতে হবে, পাঠকের সময় হয়েছে আরও একবার বেকার স্ট্রিটের ওই গোয়েন্দা প্রবরের সাথে অভিযানে বেরোবার। আর মনে থাকলেও সমস্যা কোথায়, হোমস যদি সঙ্গী থাকেন, তবে তো আজও ‘দ্যা গেইম ইজ অন !

[জুলাই, ২০২১]