এক ধরনের মিশ্র অনুভূতিতে আক্রান্ত হলাম ডন ডি লিলো’র উপন্যাস ‘দ্বিতীয় মাও’ শেষ করে। সেই ডি লিলো, যিনি উপন্যাস লিখতে বসে প্রতি পাতায় কেবল একটা অনুচ্ছেদ বসান, সেই ডি লিলো, আধুনিক মার্কিনি সাহিত্যজগতে পাগলাটে ওঝা বলেও যিনি খ্যাত; তার সাথে অবশেষে আমার সাক্ষাৎ হলো এই ‘দ্বিতীয় মাও’ কে কেন্দ্র করেই। কেমন লাগলো সেই মোলাকাত, তা নিয়ে আলোচনার আগে মনে হয় উদ্দিষ্ট উপন্যাসের কাহিনি সম্পর্কে খানিক বর্ণনা দিয়ে নেওয়া ভালো।

বিশাল এক স্টেডিয়ামে এক গণ-বিয়ের উৎসবের বর্ণনা দিয়ে উপন্যাস শুরু করেন ডি লিলো। ব্যাপারটা এমন পরাবাস্তব লাগে, যে পাঠকের মনে হয় লেখক তাকে অন্য কোনো পৃথিবীর গল্প বলবেন। অথচ এরপরই ডি লিলো পাঠককে নিয়ে আসেন ব্রিটা নামের এক সুইডিশ ফটোগ্রাফারের কাছে। এই মহিলা ছবি তোলে লেখকদের, এবার সে চাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা লেখক বিল গ্রে’র ছবি তুলতে।

ক্ষ্যাপাটে ঔপন্যাসিক ওই বিল গ্রে, নিজের চিন্তাকে বিশুদ্ধ রাখতে চেয়ে বহুদিন ধরে সে একাকী জীবন যাপন করছে শহর থেকে দূরে। পুরোপুরি অবশ্য একা হতে পারেনি লেখক বিল, সেই বাড়িতে তার সঙ্গী হিসেবে আছে স্কট আর কারেন। লোকটা আগে ছিলো লেখকের একান্ত ভক্ত, এখন সে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে বিলের ম্যানেজার হিসেবে। স্কটের সঙ্গিনী হিসেবে আছে কারেন। উপন্যাসের প্রথম দৃশ্যে পাঠক যে গণ বিয়ের উৎসবটা দেখেছিলো, সেখানেই কারেনের সাথে বিয়ে হয়েছিলো এক কোরিয়ানের। বিয়েটা ওভাবে হবার কারণ হচ্ছে, কারেনরা দীক্ষা নিয়েছিলো এক অদ্ভুত ধর্মে (যেখানে এমনকি তাকে বিয়ের কনে হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিলো মাত্র দুদিন আগে, তাও আবার ছবি দেখে)। অদ্ভুত সেই ধর্মের সন্ন্যাসিনী হিসেবে কিছুদিন বেশ নিপীড়নমূলক জীবন কাটিয়ে কারেন পালায় পরে সে আশ্রয় পায় স্কটের কাছে।

চরিত্রদের এসব বিচিত্র ইতিহাস জানতে জানতে পাঠক ওদিকে ঢুকে পড়ে উপন্যাসে। সেখানে ফটোগ্রাফার ব্রিটার সাথে আলাপে বিল জানায় কেন তার ছবি তোলায় প্রকট আপত্তি। বিল গ্রে মনে করে, অনবরত ছবি তোলা কলুষিত করে ফেলছে মানুষকে। এবং দুনিয়া জোড়া গণমাধ্যমের বিপুল বিস্তারের ফলে ছবির মাধ্যমে শিল্পের চেয়েও মানুষের কাছে যা দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে, তা হলো সন্ত্রাসবাদের আতঙ্ক।

বিল গ্রে’র নিস্তরঙ্গ জীবনে একটা ঢেউ তুলে ফিরে যায় ব্রিটা, বিলের মনে হয় তারও এবার দীর্ঘদিন পর ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় হয়েছে। এবং নিউইয়র্কে গিয়ে সে শোনে সুইজারল্যান্ডের এক কবি আটক হয়েছে বৈরুতের এক সন্ত্রাসী সংগঠনের হাতে। নিজের প্রকাশকের অনুরোধে বিল ঠিক করে টেলিভিশনের পর্দায় সে হাজিরা দেবে ওই কবির হয়ে। অথচ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে লন্ডনের সে অনুষ্ঠানেও। কিন্তু যে মাওবাদী সংস্থাটি অপহরণ করেছে ওই সুইস কবিকে, তার একজন প্রতিনিধির সাথে বিল গ্রে সুযোগ পায় সাক্ষাতের।

তারপর এই ঔপন্যাসিক চলে যায় লেবাননের দিকে, অপহৃত ওই কবিকে মুক্ত করতে। কিন্তু পথেই এক জাহাজে মৃত্যু হয় তার। উপন্যাসের শেষে আমরা দেখতে পাই ব্রিটাকে বৈরুত চলে যেতে, লেখকদের ছবি তোলা ছেড়ে দিয়েছে সে, এখন সে সাক্ষাৎকার নিতে এসেছে গেরিলা সন্ত্রাসবাদী নেতা আবু রশিদের।

সংক্ষেপে এই হলো উপন্যাসের ঘটনা। ঠিক কীভাবে একে ব্যাখ্যা করা যায়, পড়া শেষে পাঠক সেটা বুঝে ওঠে না চট করে। হ্যানসেল আর গ্রেটেলের ছড়িয়ে দেওয়া রুটির দানার মতো তখন উপন্যাসের পাতায় ডি লিলো’র ফেলে যাওয়া সূত্রের সন্ধান করতে হয় তাকে। কী বলতে চেয়েছে লোকটা?

সূত্র খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই চোখ পড়ে উপন্যাসের নামকরণে। উপন্যাসে উল্লেখ আছে, স্কট একবার কারেনকে উপহার দিয়েছিলো অ্যান্ডি ওয়ারহলের একটা বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র বা ক্যারিকেচার (পোস্ট-মর্ডান আর্ট’ও বলা যায় সেই ছবিকে), যা আঁকা হয়েছিলো মাও সেতুংকে নিয়ে। পাঠকের তখন মনে হয় সেই অ্যান্ডি ওয়ারহলকেই বুঝি ব্যঙ্গ করলেন ডি লিলো। ভেবে অবশ্য মনে হয়, সেই অ্যান্ডি ওয়ারহল, যে বাণী দিয়েছে যে পৃথিবীতে সকল কিছুই ১৫ মিনিটের বেশি টেকে না, যার কাজ টেলিভিশন ভারাক্রান্ত হিটখোর মিডিয়ার কাছে রীতিমতো ঐশ্বরিক, তার সাথে ঘরবন্দী ঔপন্যাসিকের একটা দ্বন্দ্ব থাকারই কথা। ভুলে গেলে চলবে না, উপন্যাসে বৈরুতের সন্ত্রাসীরাও মাও’কে মনে করে নিজেদের গুরু।

এইসব খেয়াল করে পাঠকের মনে হতে থাকে, সন্ত্রাসের সাথে সাথে ‘রিমিক্স’ বা ‘ফিউশন’ নামে খ্যাত শিল্পধারাকেও বোধহয় আধুনিক লেখকের শত্রু বলে চিহ্নিত করলেন ডি লিলো। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ উত্তরাধুনিক বা পোস্ট-মর্ডার্ন উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিজেই নিজের বিরোধিতা করা। এবং আঙ্গিকে আর বর্ণনায় ডি লিলো যেহেতু নিশ্চিতভাবে একটা উত্তরাধুনিক উপন্যাসই ফেঁদেছেন, ফলে উত্তরাধুনিক শিল্পধারার প্রতি তিনি যে রূষ্ট, সেই অভিযোগ তো হালেই পানি পাবে না!

তিন দশক আগে লেখা উপন্যাস, কিন্তু লক্ষ করি, আমাদের এই পোস্ট-ট্রুথ আর সেলফি-মুখর জগতের সংকট বেশ স্পষ্ট ডি লিলোর হাতে। লেখকেরা যে ভবিষ্যৎ দেখতে পান, ডি লিলোর উপন্যাস পড়ে সেই বিশ্বাসে আরো একবার আস্থা স্থাপন করতে হয় তাই।

আমরা তো বাস করি এমন এক সময়, যখন লেখকের চাইতে ক্ষমতা অনেক বেশি কোনো সন্ত্রাসীর। মানুষের মনকে অতীতে প্রভাবিত করতেন ডিকেন্সের মতো লেখকেরা, সেই কাজটা টিভির পর্দায় এখন অকল্পনীয় দ্রুততায় করতে সক্ষম বিন লাদেনের মতো সন্ত্রাসীরা। এ এমন এক পৃথিবী, যেখান লেখক বিল গ্রে’কে চিনতে পারে না কেউই, অথচ বোমা বিস্ফোরণের খবর চাউর হয়ে যায় মুহুর্তেই। কবি হয় অপহৃত, আর তাকে উদ্ধারের জন্য লেখার টেবিল ছেড়ে বাস্তবের জগতে নামলে লেখককে হারতেই হয়।

ছবি তোলার প্রসঙ্গটাও বেশ ধুয়ে দিয়েছে বিল গ্রে। ছবি মানেই তো একরকম ইতিহাস, এ যুগে আমরা যেন প্রতিমূহুর্তে ইতিহাস তৈরি করছি নিতান্ত খেলো বিষয়কে কেন্দ্র করেও। পাবলো এসকোবার যেহেতু বেশি ফুটেজ পাচ্ছে, গ্যাবো মার্কেজের চাইতে দুনিয়া যে তাকেই বেশি চিনবে, তা নিয়ে আর সন্দেহ কোথায়? ছবির এই দুনিয়ায় বাকি সমস্ত চিন্তার অসারতা ফুটে উঠেছে ‘দ্বিতীয় মাও’ উপন্যাসের প্রথম আর শেষ দৃশ্য থেকে, দুটো বিয়ের অনুষ্ঠান দেখানো হয় সেগুলোতে, যে অনুষ্ঠান মানুষের সবচেয়ে বেশি ছবির যোগান দেয়।

তবে, সকল ক্ষেত্রে ডন ডি লিলো’র প্রতিও ভালো লাগাটা অক্ষুণ্ণ থাকে না ‘দ্বিতীয় মাও’ পড়তে গেলে। উত্তরাধুনিক উপন্যাসে চিরকালই যে ভাবনা বা ধারণা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দেয়া হয় চরিত্রায়ন, বর্ণনা বা সংলাপের চাইতে; ব্যক্তিগতভাবে এই ব্যাপারটা আমায় ততটা টানে না। আলোচ্য উপন্যাসকে সেদিক থেকে ভীষণ অমসৃণ লাগে পাঠক হিসেবে। নানা ঘটনাকে মনে হয় অনর্থক অস্থিরতা। সংলাপ রচনাও ভারি অদ্ভুত ডি লিলো’র। একটার সাথে অন্যটার কোনো মিল নেই। বিল গ্রে’র ওপর আরও নিবদ্ধ থাকলেই বোধ হয় উপন্যাসটা বেশি সুস্থির থাকতো।

[জুলাই, ২০২১]