[ ২০২০ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর কয়েকটাকে নিয়ে আমার এলোমেলো পাঠানুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই ধারাবাহিক। আজ রইলো এর ষষ্ঠ পর্ব। ধারাবাহিকের সবগুলো কিস্তি পাওয়া যাবে এইখানে ]

সেই বই-ই তো নতুন যা পড়া হয়ে ওঠেনি আমাদের। কাজেই ২০২১ এর মাঝপথ পেরিয়ে গেলেও ২০২০ এর বইমেলায় প্রকাশিত এবং এখনো অপঠিত বইগুলোকে আমি গণ্য করি নতুন বই হিসেবেই। তেমনই দুটো নতুন বই নিয়েই থাকলো আজকের সংক্ষিপ্ত আলাপ।

ক) তিমিরযাত্রা / মোজাফ্‌ফর হোসেন
আলো সহ্য হয় না বলে অন্ধকারে নীরব বসে আছে পূর্বপুরুষ, এমন এক দৃশ্যকল্প দিয়ে আরম্ভ হয় মোজাফ্‌ফর হোসেনের প্রথম উপন্যাস, তিমিরযাত্রা

নাম এবং প্রথম দৃশ্যের বয়ান থেকেই পরিষ্কার, কোনো একটা যাত্রায় বেরিয়েছে একজন মানুষ, উপন্যাসের প্রাচীনতম এই ছক দিয়েই আমাদের গল্প শোনাতে চান লেখক। কিন্তু কেমন সেই যাত্রা? জানতে দ্রুত পাতা উলটে যাই।

আবিষ্কার করা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পাশ্চাত্যে বাসরত এক যুবক- গল্পের নায়ক- ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। পেশায় যুবক লেখক। লিখিতব্য উপন্যাসের প্রয়োজনে সে প্রাচ্যের চোখ দিয়েই প্রাচ্যকে আবিষ্কার করতে চায়। সেই উপন্যাসের সুলুক সন্ধান, আর নিজের অতীত খুঁড়ে দেখা; এই দুই উদ্দেশ্য সামনে রেখে যুবক বেরিয়ে পড়ে তারা বাবার জন্মস্থান মফস্বলের দিকে। তার মুক্তিযোদ্ধা পিতা কী কারণে মফস্বল ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন শহরে, সে জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে নেমে গল্পের নায়ক সুরুজ পরিচিত হতে থাকে আজকের বাংলাদেশের প্রধানতম রাজনৈতিক বিভাজনগুলোর দিকে। ক্রমশ তার অতীতযাত্রা হয়ে ওঠে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সন্ধানের সমার্থক। উপন্যাসের শেষে থাকে উত্তরপুরুষের প্রশ্ন আর পূর্বপুরুষের উত্তরকে মুখোমুখি দাঁড় করানো।

বলতেই হয়, সম্পর্কের প্রতীকায়িত উপস্থাপনে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন মোজাফ্‌ফর। শুভবোধের প্রতীক মানুষগুলো উপন্যাসে প্রায়ই অপুংসক, গাজীউল বেশ অস্বাভাবিক এক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে সুরুজের মায়ের সাথে। সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের একত্রে শান্তিতে সহাবস্থানের চেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধ করা আলীমেয়েলি’কে স্বাধীন বাংলাদেশে পশুর সাথে থাকতে হয়, আর ঔদ্ধত্য দেখিয়ে যায় রফিমোল্লা।

তিমিরযাত্রা পড়তে গিয়ে প্রথমেই যা অনুভব করা যায়, তা হলো লেখকের সতর্কতা। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবটাকে লাগামে এনে তিনি আশ্রয় করেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা। পাঠক হিসেবে ব্যাপারটা বেশ লাগে। উত্তরাধুনিকতা কিংবা মেটা-ফিকশনের কারিকুরির সাথে যে মোজাফ্‌ফর ভালোই পরিচিত, সেটাও সমসাময়িক অন্য অনেকের লেখার চাইতে তাকে আলাদা করে।

খামতিটা লাগে উপন্যাসের আয়তনে। উচ্চাভিলাষী যে গল্প বলতে চেয়েছেন মোজাফ্‌ফর, আয়তনের স্বল্পতায় (এবং, বিদ্যমান বাস্তবতায় নানা জায়গায় অধিক সতর্ক হয়ে পড়াতেও, বোধহয়) সেটার কিছু কিছু জায়গা ঠিক মসৃণ হয় না। সুন্দর করে সাজানো বাগানে হঠাৎ দৃষ্টিকটু গজিয়ে ওঠা কোনো ফুলঝাড়ের মতোই- সৌদিগামী গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন কিংবা মাদক ব্যবসার মতো- সামাজিক ধারাভাষ্যগুলো তখন কিছু আরোপিত মনে হয়।

পাতলা এই অসন্তুষ্টি সরিয়ে রাখা গেলে তিমিরযাত্রা পড়তে কিন্তু বেশ লাগে। এক ধরনের অস্বস্তির যাত্রায় আমাদের সামিল করতে চাওয়ার যে চেষ্টা, মোজাফ্‌ফর হোসেনকে সেই উদ্দেশ্য পূরণে সফল বলে বোধ হয়।

খ) তৃতীয় নারী / মাসউদুল হক
উপন্যাস তৃতীয় নারীকে লেখক মাসউদুল হক দাবি করছেন ডিস্টোপিয়ান ধারার উপন্যাস বলে। আর ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো পাঠক প্রত্যাশা করে, তার মাঝে অন্ততঃ দুটিকে (প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট কোনো দুর্যোগের পরে বদলে যাওয়া পৃথিবী, আর কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাকাঠামো) সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় তৃতীয় নারীতে।

উপন্যাসের ঘটনাক্রম খুব জটিল নয়। মানুষের সীমাহীন লোভ আর বৈষম্যের কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঢাকা শহরের বাসিন্দারা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের নানা এলাকায়। সন্তান জন্ম দিতে এখন প্রয়োজন গ্রিনকার্ডের, অন্য কোনো নারীর গর্ভ ধার কিংবা ভাড়া করাও আইনত অপরাধ। এমন একটি পরিস্থিতিতে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শাদাব কবির একটি কৃত্রিম জঠরে বাঁচিয়ে রেখেছেন চৌদ্দো বছর বয়েসি ভ্রুণ হেক্টরকে, তিনি খুঁজছেন রক্ত মাংসের একজন গ্রিনকার্ড পাওয়া নারী, যে এই ভ্রুণকে ধারণ করে জন্ম দেবেন।

শাদাব কবিরের পালকপুত্র নোয়াহ ছিলো এই ভ্রূণটির জৈবিক পিতা। পিতার মতো মাতাও ত্যাগ করেছে হেক্টরকে। চেষ্টা করা হয়েছিলো নোয়াহ’র মা শাওলির গর্ভের সাহায্যে হেক্টরকে পৃথিবীতে আনবার। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ায় শাদাব কবির এখন সন্ধানে আছেন তৃতীয় কোনো নারীর।

সংক্ষেপে এই হলো উপন্যাসের গল্প। কিন্তু জটিলতাহীন এই গল্পেও ঠিক মনোনিবেশ করা যায় না, আটকাতে হয় খানিক পরপর। পাঠক হিসেবে নিজের এই হোঁচট খাওয়াটা মানতে পারি না বলে খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে কেন এমনটা হচ্ছে। কেন এমন একটা কাহিনি উপভোগ করতে পারছি না নির্বিঘ্নে?

একটা কারণ, বোধ করি, ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার। শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশায় বিজ্ঞান সংক্রান্ত পারিভাষিক শব্দভাণ্ডার আমাদের এমনিতেই দীন, স্বীকার করি। কিন্তু তবু মুহম্মদ জাফর ইকবাল কিংবা হুমায়ূন আহমেদের বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো যখন পড়ি, সেখানে তাদের ভাষাকে কৃত্রিম মনে হয় না কিছুতেই। তার বাইরে যদি দীপন ভট্টাচার্যের আরও তীব্র কল্প-গল্পগুলো (হার্ড সাই-ফাই) পড়তে বসি, সেক্ষেত্রেও কোয়ার্টজ বা প্রোটোপ্লাজমের মতো ঘোরতর বিজ্ঞান বিষয়ক শব্দমালা (যাদের পারিভাষিক শব্দ অপ্রচলিত) ছাড়া তার বাংলাকে মনে হয় দারুণ প্রতিভামণ্ডিত। অথচ তৃতীয় নারীর ক্ষেত্রে তা হয় না। যান্ত্রিক শব্দগুলো ছাড়াও প্রায় প্রতিটি বাক্যেই ইংরেজি শব্দের প্রাদুর্ভাব থাকে। শুধু তাই নয়, চরিত্রদের কথোপকথনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটে বাংলা হরফে লেখা ইংরেজি ভাষায়। অথচ যখনই বিদেশি ভাষার প্রতি অতিনির্ভরতা কাটিয়ে মাসউদুল হক ফিরে আসেন বাংলায়, তাকে পড়তে ভালোই লাগে, তার বানানো জগৎটার সাথে সংযুক্তিও বাড়ে।

সত্যি বলতে, তৃতীয় নারী উপন্যাসকে নির্বিঘ্ন উপভোগ করার পথে অন্য খামতি বলে মনে হয় এখানে বর্ণিত জগতের প্রতি লেখকের অতি আসক্তিটাকেই। ভবিষ্যতের জগৎটাকে অতি স্পষ্ট করতে চেয়ে চরিত্রদের মনোজগৎ যেন গুরুত্ব কম পেয়েছে এখানে। উপন্যাস মানে কী? উপন্যাস মানে তো একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি আর পরিবেশের ভেতরে মানুষকে স্থাপন করে তার অনুভূতিগুলো নেড়েচেড়ে দেখা, ঠিক পরীক্ষাগারের গিনিপিগদের মতোই। অথচ তৃতীয় নারী-তে মাসউদুল সেই পথে হাঁটেন কম, তিনি বরং পাঠকের কাছে বর্ণনা করে যান কীভাবে উপন্যাসের চরিত্ররা পরীক্ষাগারের ওই পরিবেশে এসে পৌঁছলো।

উদাহরণে বলা যায় পোষা কুকুর চিক্কু-এর ব্যাপারটা। চিক্কুর মৃত্যুর পরে যখন ক্লোন করে আবারও তাকে এনে দেওয়া হয় শাদাব কবিরের পরিবারের মাঝে, মৃত সেই কুকুরের স্মৃতির সাথে নতুন চিক্কুকে কীভাবে গ্রহণ করবে মানুষগুলো, তা নিয়ে মানসিক এক টানাপোড়েনের পট তৈরি হয় উপন্যাসে। ঔপন্যাসিকের সামনে তখন সুযোগ আসে ভবিষ্যতের মানুষের মনকে খুঁটিয়ে দেখার। কিন্তু মাসউদুল তা গ্রহণ করেন না, তিনি বরং ব্যাখ্যা করেন সেই দুনিয়ায় ক্লোনিং এর ইতিবৃত্তান্ত। ঠিক এভাবেই, প্রায় সর্বক্ষেত্রে মাসউদুল তার জগৎটাকে সাজাতে থাকেন অতীতে গিয়ে (নোয়াহ’এর শৈশব নিয়ে বলতে গিয়ে যেমন তার প্রিয় অ্যানিমেশন চরিত্রের একটা গোটা অভিযানই বর্ণনা করা হয়)।

কিন্তু যখন কোনো উপন্যাসে কেবল অতীত চারণ করা হয়, পাঠকের মাঝে তখন দ্বিধা বা প্রশ্ন তৈরি হয় না। স্মরণীয় উপন্যাসগুলোয় আমরা যেমন চরিত্রদের সংলাপ বা আচরণ দিয়ে চারপাশের জগতটা বুঝে উঠি ক্রমে, মাসউদুল সেই সুযোগটাই দ্যান না। তিনি কেবল পেছনের গল্প বলেন, উপন্যাসটা সামনে এগোয় কম। প্রথম অধ্যায়ে হেক্টরের মুখোমুখি হবার পর মুহুর্ত থেকে উপন্যাসের তিন-চতুর্থাংশ সময় ধরে আমরা তাই কাহিনিকে এগোতে দেখি না।

অথচ যা দুর্বলতা, সেটা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই শক্তিও বটে। আগামীর পৃথিবী বর্ণনায় মাসউদুল হকের নিবেদনকে উল্লেখ না করাটা তাই অনুচিতই হবে। দুর্যোগ আক্রান্ত বাংলাদেশের একটা মোটামুটি বিশ্বাস্য রুপ দাঁড় করানোয় মাসউদুল হক যে শ্রমের পরিচয় দ্যান, সমকালীন কল্প-গল্পকারদের মাঝে সেটাকে বিরল বলেই মনে হয়।

[জুন, ২০২১]