টিপ বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় একাকী দাঁড়িয়ে থাকা এমা স্টোনের চাইতেও আমার আকর্ষণীয় মনে হয় ঢাকা শহরকে।
সেই ঢাকা, কবে কোন মোগল আমলে হীরালাল তবলচিকে সাথে করে লখনৌ থেকে উড়ে আসা গওহরজান বাইজী যেখানে চুড়িদার পাজামা আর ঘুঙুরের ছন্দে নাচাতো নবাববাড়ি; সেই ঢাকা শহর, সাড়ে তিনশো বছরেরও আগে ট্যাভেরনিয়ার যেখানে অবাক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন পাগলা নদীর দুধারে লম্বা টাওয়ারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ধৃত ডাকাতদের কেটে নেওয়া মাথা; সেই ঢাকা, সাধকশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মানন্দ গিরির মাথার ওপর দেবীর আদেশে উড়তে থাকা পাথর যেখানে এসে ঠাঁই পায় রমনার কালীবাড়ি প্রাঙ্গণে; ইদানিং যানজট এবং অগণিত কুত্তার বাচ্চা নিয়েও সেই ঢাকা আমার কাছে চিরকালের এক প্রেম। যেহেতু এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু, জয়েসের ডাবলিনার্স কিংবা পামুকের ইস্তানবুলের মতো তাকে নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখতে আমার হাত কেবলই নিশপিশ করে।
তিন দশকের মতো ঢাকায় আমার বসবাস, এবং গত এক দশক ধরে, ঢাকাকে আমি প্রস্থচ্ছেদ করতে চেয়েছি নিজের মতো করে। ইতিহাসের ধূলো, দৈনিকের নিরাশা ভরপুর কলাম আর প্রতিদিনের ব্যক্তিগত হাঁটাচলার বাইরে আমার সেই প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বেশি জ্বালানি যুগিয়ে গেছে নানা মানুষের স্মৃতিকথা।
ঢাকা নিয়ে স্মৃতিচারণ পেলেই আমি তাই খুব আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা করি তা সংগ্রহ করার। মুনতাসীর মামুনের ঢাকা সংক্রান্ত লেখালেখি, মীজানুর রহমানের ‘ঢাকা পুরাণ’ এর মতো বই; বুদ্ধদেব বসু কি সৈয়দ হকের কলমে প্রবল মধুমণ্ডিত স্মৃতিচারণ তো বটেই, রাজনীতিক কি আমলার দুর্বল কলমে উঠে আসা ‘এক জীবনে যা দেখেছি’ গোছের এঁদো রচনাও আমি বারবার খুঁটিয়ে পড়ি ঢাকার বর্ণনা পেলে।
তাসনীম হোসেনের ‘স্মৃতির শহর’ সেজন্যেই আমার অসম্ভব প্রিয় বই।
‘স্মৃতির শহর’ প্রথম প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিলো অনলাইন লেখক সমাবেশ সচলায়তনে, ধারাবাহিক হিসেবে। তাসনীম হোসেন একটা করে পর্ব লিখতেন, অনিয়মিত আকারের বিরতির কারণে পাঠক হিসেবে আমার প্রতীক্ষা করতে হতো।
কিন্তু সেই প্রতীক্ষা পুষিয়ে যেতো লেখকের কলমের শক্তিতে।
স্বাধীনতার ঠিক পূর্বে জন্ম নেওয়া একজনের শৈশবের স্মৃতি থেকে শুরু হয় ধারাবাহিকটি, ক্রমশ তার সাথে আমরা জড়িয়ে যাই এক আশ্চর্য ভ্রমণে। তার স্কুলের টাইগার স্যার যেন আমাদের চিরচেনা কোনো শিক্ষক, আমাদের মতোই সেও ব্যাকুল হয় সেবা প্রকাশনীর আউট বই পড়ার ধান্দায়, রিকশার টুংটাং ধ্বনিতে তার বালকবেলার মুগ্ধতায় আমাদেরও মনে পড়ে এ শহরে আজও ফোটে ফুল। স্মৃতির সেই শহরে যেতে কোন টিকিট লাগে না, সেখানে শৈশবে থাকে গির্জার সাথে লাগোয়া গোরস্তানের ভূতের ভয় আর নাবিস্কো বিস্কুটের কারখানা, কৈশোরে থাকে আশির দশকের স্বৈরাচার আর বাংলামোটরের দারুল কাবাব। থাকে কনসার্ট দেখতে যাওয়া, অপু-দুর্গার রেলগাড়ি না হলেও থাকে দুপুরবেলার নীরব স্টেশন রোড দর্শন। লেখকের বন্ধু টিপুর কথা পড়ে মন খারাপ হয়, আবার নিঃসঙ্গ শেরপা শামসুর রাহমানের কথা পড়ে ভালোও লাগে। (আর কারো কি আমার মতো মনে হয়, যে ঢাকাকে নিয়ে লেখা সবচেয়ে চমৎকার কবিতাগুলো শামসুর রাহমানের?)
একটা শহর মানে আসলে সেই শহরের অধিবাসীরা,যখন আমরা কোনো শহরকে নিয়ে পড়ি, তখন আসলে আমরা আয়নার মতো সেখানে দেখতে পাই শহরের মানুষগুলোরই প্রতিবিম্ব। নিজের শহরকে বর্ণনা করতে গিয়ে শক্তিশালী লেখকেরা আসলে নিজেকেই বর্ণনা করেন প্রতিবার। তাসনীম হোসেন সেটাই করেছেন। তার বয়ানে তার পরিবার হয়ে উঠেছে আমাদের নিজের পরিবার, তার শহরটা হয়ে উঠেছে আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ শহর। আর ‘স্মৃতির শহর’ হয়ে উঠেছে ঢাকার কাছে যেমন প্রেমপত্র লিখতে চাই আমি, তেমন কোনো চিঠি।
তাসনীম হোসেনের সেই স্মৃতিকথা তাই আমার মনে গেঁথে রয়; অনলাইনের পিডিএফ হয়েও আমার ডাঊনলোড ফোল্ডারের অজস্র বইয়ের মাঝে সেটা হয়ে থাকে স্বতন্ত্র, তাকে আমি বারবার পড়ি। অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করি, তাসনীম হোসেনের সেই মায়াবী স্মৃতির শহরকে অবলম্বন করেই আমি তৈরি করি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘পদতলে চমকায় মাটি’ এর কেন্দ্রীয় এক চরিত্রের মনোজগৎ।
যখন জানলাম সেই ‘স্মৃতির শহর’ এই বছর পুরোদস্তুর মলাটবদ্ধ বই হয়ে বেরিয়েছে অনার্য প্রকাশনী থেকে, সুকুমার রায় পড়ার মতো আনন্দ পেয়েছি খবরটা শুনে। স্মৃতির সেই শহরে আমি বহুবার পায়চারি করেছি আশির দশকের আশেপাশে, নতুন করে জেনেছি ঢাকা শহরের একটা একটা ডিএনএ। সেই আনন্দযাত্রায় সঙ্গী হিসেবে আরো পাঠক যোগ হতে পারেন, সেই সম্ভাবনা আমার জন্য খুব আনন্দের।
আজ একবিংশ শতাব্দীর দুই দশকের জিডিপি নিয়ে আমার পকেট ভার হয়ে থাকে ঠিকই, কিন্তু যখনই ফিরে তাকাই ঢাকার পেছনে, কেন যেন চোখে ভেসে ওঠেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের এক কোণে সস্তা চাদরে নিজেকে মুড়ে নিয়ে দাবা খেলে চলা আবদুর রাজ্জাক। প্রতিপক্ষের একটি একটি করে ঘুঁটি তিনি কাটেন, সেটিকে পাশে না রেখে এরপর জমা করেন নিজের বাঁ হাতের মুঠোয়। মুঠিটি পূর্ণ হয়ে গেলে সৈন্য-সামন্ত-মন্ত্রীরা সব ছিটকে যায় চারপাশে। আমাদের ঢাকা শহর এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। যতই তাকে আঁকড়ে ধরতে চাই,আমরা জানি, তার হাতের মুঠি পূর্ণ হয়ে উঠবে একদিন, আমাদের সে ছুঁড়ে ফেলে দেবে তখন।
অথচ দাবার ঘুঁটি হয়ে থাকার সেই অভিজ্ঞতাটুকুই আমার মতো ঢাকাবাসীর সারাটা জীবন। তাসনীম হোসেন ঢাকা শহরের হাতের মুঠোয় বন্দী হয়ে থাকার সেই জীবনের কিছুটা অংশকে আটকে ফেলেছেন কাগজে, ‘স্মৃতির শহর’ হয়ে উঠেছে এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিন। প্রতিদিনের ইতরপনা আর অসহনীয়তার মাঝে যারা ঢাকা শহরকে আবিষ্কার করতে চায় অন্য কোনো চোখে, তাদের তাই আমন্ত্রণ দিয়ে যাই সেই টাইম মেশিনে ঘুরে আসার।
[এপ্রিল ২০২১]
Leave a Reply