মানুষ যে বিচিত্র, সম্ভবত বাজারে গেলেই সেটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায়। আর বইয়ের দোকানও যেহেতু আদতে একরকম বাজারই, সেখানেও বিচিত্র সব মানুষের দেখা মেলে। তেমন বিচিত্র কিছু মানুষের আরো বিচিত্র কিছু কথা নিয়ে জেন ক্যাম্পবেলের সম্পাদনায় একটা ছোট, হালকা বই পড়লাম। উইয়ার্ড থিংস কাস্টোমারস সে ইন বুকশপস। ‘চশমাটা বাড়িতে ফেলে এসেছি, আমাকে একটু প্রথম অধ্যায়টা পড়ে দেবেন?’ থেকে শুরু করে ‘বই ধরলে কি বৈদ্যুতিক শক লাগে?’; এমন সব মজাদার প্রশ্নে যে দুনিয়া জোড়া বইবিক্রেতারা অনবরত নাজেহাল হচ্ছেন ক্রেতাদের কাছে, ছোটো এই বইটা সে ব্যাপারটাই স্পষ্ট করলো। আর আজকের আলাপে থাকলো আলোচ্য বইটা থেকে অনূদিত কয়েকটা ঘটনা।

(১)
ক্রেতাঃ অ্যানা ফ্রাঙ্কের বইটার পরের কোনো পর্ব এসেছে নাকি ভাই? প্রথমটা আমার খুব ভালো লেগেছিলো।
বিক্রেতাঃ …আপনি কি অ্যানার ডায়েরির কথা বলছেন?
ক্রেতাঃ ডায়েরি নাকি?
বিক্রেতাঃ জ্বি, ডায়েরি। বইটাও তার আত্মজীবনী ধাঁচের।
ক্রেতাঃ সত্যি?
বিক্রেতাঃ হ্যাঁ, ডায়েরির শেষে সে সত্যিই মারা যায়। তাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়া হয়।
ক্রেতাঃ ইশ!
বিক্রেতাঃ জ্বি, খুবই দুঃখজনক ব্যাপার।
ক্রেতাঃ তরুণ একজন লেখক এভাবে মারা গেলো? … মেয়েটা সত্যিই বড় ভালো লিখতো!

(২)
ক্রেতাঃ ১৯৮৬ বইটা আপনাদের কাছে আছে?
বিক্রেতাঃ ১৯৮৬?
ক্রেতাঃ হ্যাঁ, ১৯৮৬, অরওয়েলের লেখা।
বিক্রেতাঃ ওহ! আপনি ১৯৮৪ এর কথা বলছেন!
ক্রেতাঃ নারে ভাই, বইয়ের নাম ১৯৮৬ ! আমার জন্মসাল ওটা, নাম নিয়ে আমি নিশ্চিত!

(৩)
ক্রেতাঃ জেন আয়ার বইটা কি আছে আপনাদের কাছে?
বিক্রেতাঃ না, দুঃখিত! বইটা আমাদের কাছে ছিলো, আজ সকালেই ফুরিয়ে গেছে।
ক্রেতাঃ আপনি বইটা পড়েছেন?
বিক্রেতাঃ হ্যাঁ, আমার খুব পছন্দের বই।
ক্রেতাঃ আমাকে একটু বইটা নিয়ে বলবেন? কালকে আমাকে ওটা নিয়ে একটা লেখা জমা দিতে হবে।

(৪)
ক্রেতাঃ  মার্গারেট অ্যাটউডের অটোগ্রাফ দেয়া কোনো বই কি আপনাদের কাছে আছে?
বিক্রেতাঃ উম, মার্গারেট অ্যাটউডের বেশ কিছু বই আমাদের আছে, কিন্তু কোনোটাতেই আসলে অটোগ্রাফ দেয়া নাই। আমি দুঃখিত।
ক্রেতাঃ সামনেই আমার স্ত্রীর জন্মদিন। একটা অটোগ্রাফওয়ালা বই পেলে সে খুব খুশি হতো। … আপনারা কি কোনোভাবে একটা জাল অটোগ্রাফ দিতে পারবেন না?

(৫)
ক্রেতাঃ হ্যারি পটারের প্রথম বইটা কী?
বিক্রেতাঃ দা ফিলোসফার’স স্টোন
ক্রেতাঃ আর দ্বিতীয় বইটা?
বিক্রেতাঃ দা চেম্বার অফ সিক্রেটস
ক্রেতাঃ আমাকে দুই নাম্বারটা দ্যান, চেম্বার অফ সিক্রেটসটা।
বিক্রেতাঃ এক নাম্বারটা পড়া আছে আপনার?
ক্রেতাঃ নাহ। কিন্তু সিরিজ ধরে বই পড়তে গেলে প্রথমটা না পড়লেও চলে। শুরুতে তো সব আজাইরা কথাবার্তা দিয়ে ভর্তি থাকে। ওসব পড়ে সময়টা নষ্ট করতে চাই না।
বিক্রেতাঃ হ্যারি পটারে কিন্তু একেবারে শুরু থেকেই আপনি কাহিনির ভেতরে ঢুকে যাবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে আপনার ফিলোসফার’স স্টোন দিয়েই শুরু করা উচিৎ, বইটা দারুণ।
ক্রেতাঃ বইটা বেচতে পারলে কি আপনি কমিশন পাবেন?
বিক্রেতাঃ না তো!
ক্রেতাঃ সিরিজে মোট কয়টা বই আছে?
বিক্রেতাঃ সাতটা।
ক্রেতাঃ অ্যাতোগুলা বই পড়তে হবে, তার মাঝে আমি শুধু শুধু প্রথম বইটা কিনে সময় নষ্ট করবো কেন? আমাকে দুই নাম্বারটাই দ্যান।
বিক্রেতাঃ ঠিক আছে। আপনি যখন বলছেন…

[এক সপ্তাহ পর, সেই এই ক্রেতা আবারও এলেন দোকানে।]
বিক্রেতাঃ কেমন আছেন? এবার কি দা প্রিজনার অফ আজকাবান’টা নেবেন আপনি?
ক্রেতাঃ সেটা আবার কী?
বিক্রেতাঃ দা চেম্বার অফ সিক্রেটস এর পরের বইটা।
ক্রেতাঃ ওহ, আপনাদের ওই হ্যারি পটার? নাহ। বইটা আমার কাছে খুব জটিল মনে হয়েছে। আমাকে বলেন তো, আমিই যেখানে পড়ে বুঝতে পারিনি, সেখানে বাচ্চারা কীভাবে ওই বই বুঝবে? … মানে, কোত্থেকে লেখক ভোল্ডেমর্ট নামে একজনকে নিয়ে আসছে! না, না; আমি আর আপনাদের এই সিরিজ পড়ে সময় নষ্ট করবো না।

(৬)
ক্রেতাঃ আচ্ছা বাইবেল যেন কার লেখা? আমি লেখকের নামটা মনে করতে পারছি না।
পাশ থেকে ক্রেতার বন্ধুঃ আরে, ঐটা যীশুর লেখা বই!

(৭)
ক্রেতাঃ আপনাদের দোকানে ধর্ম বিষয়ক বইগুলা কোনদিকে?
বিক্রেতাঃ ওই তো স্যার, ওই দিকটায়।

[খানিক পর]

ক্রেতাঃ আপনারা দেখি রিচার্ড ডকিন্সের বইকে বাইবেলের পাশে রেখেছেন!
বিক্রেতাঃ জ্বি, ধর্ম আলোচনা সংক্রান্ত সব বই ওখানেই রাখা।
ক্রেতাঃ মরার পরে আপনারা যে দোজখে যাবেন, সেইটা জানেন তো?

(৮)
ক্রেতাঃ আচ্ছা, আপনাদের কাছে রবিন হুডের এমন কোনো বই আছে, যেখানে সে ধনীদের কাছ থেকে ডাকাতি করে না? … মানে, আমার স্বামীর নামও রবিন, আমি তাকে জন্মদিনে এই বইটা দিতে চাই। কিন্তু সে একজন বড় ব্যাংকার।

(৯)
ক্রেতাঃ আপনাদের LGBT সাহিত্যের বইগুলা কোন দিকে?
বিক্রেতাঃ ওভাবে তো আলাদা করা নেই, কথাসাহিত্যের বইগুলো সব একসাথেই আছে। তবে LGBT লেখক আছেন কিছু। আলি স্মিথ, সারা ওয়াটার্স। আপনি কার লেখা খুঁজছেন?
ক্রেতাঃ নির্দিষ্ট কারো লেখা না। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি নিজেই খুঁজে দেখছি।

[খানিক পরে দ্বিতীয় একজন ক্রেতা এগিয়ে এলেন কাউন্টারে।]

দ্বিতীয় ক্রেতাঃ আচ্ছা, আপনি কি একটু আগে বললেন যে কথাসাহিত্যের বইগুলোর তাকেই সমকামিতা বিষয়ক সাহিত্য রাখা?
বিক্রেতাঃ জ্বি, সব কথাসাহিত্য একত্রে রাখা।
[দ্বিতীয় ক্রেতা খানিক সন্দিগ্ধভাবে নিজের হাতের বইটাকে দেখে সেটাকে রেখে দিলো।]

(১০)
ক্রেতাঃ পেশা নির্বাচনের ওপরে কোনো বই আছে আপনাদের? আমার মেয়ের জন্য খুঁজছি।
বিক্রেতাঃ আপনার মেয়ে কি বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠবে এবার?
ক্রেতাঃ আরে নাহ! ওই তো, সে ওইদিকে দাঁড়িয়ে আছে। (হাত দিয়ে ডেকে) … মামনি, এদিকে আসো তো একটু!

[ চার কি পাঁচ বছরের এক পিচ্চি এগিয়ে এলো।]

ক্রেতাঃ মামনি, তুমি এই যে আন্টিটার সাথে কথা বলো, আমি তোমার জন্য একটা বই নিয়ে আসছি, ঠিক আছে? দেখবা, বড় হয়ে কীভাবে ডাক্তার, না হলে বিজ্ঞানী হতে পারবে, বইতে সব লেখা আছে! … একটু দেখবেন ওকে, হ্যাঁ? আমি এক মিনিটেই চলে আসবো।

[ক্রেতা দোকানের ভেতর চলে গেলে বিক্রেতা আলাপ জমায় বাচ্চাটার সাথে]

বিক্রেতাঃ তোমার নাম কী মা?
পিচ্চিঃ সারাহ।
বিক্রেতাঃ কী সুন্দর নাম! সারাহ, বড় হয়ে তুমি কী হতে চাও?
পিচ্চিঃ বড় হয়ে? … আমি মৌমাছি হতে চাই।

[মার্চ, ২০২১]