১৮৬০ এর ২৯ জানুয়ারি জন্মেছিলেন আন্তন চেকফ।
লোকটা এমন ভাবে লিখেছে, যেন সে কিছুই বলছে না।
এবং সে সবই বলেছে।

এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো

[টীকাঃ  আন্তন চেকফের গল্পে ইম্প্রেশনাজিম ঘরানার শিল্পীদের ছায়া দেখেছিলেন তলস্তয়, চেকফের গল্পকে বোঝাতে গেলে, এই কথাটা দারুণ মানানসই।

অপূর্ব সব গল্প লিখে গেছেন চেকফ। ছোটর মাঝেও ছোট যে গল্পগুলো, সেখানে তিনি মানুষকে ধরেছেন একটা মুহুর্তের মহিমায় তার গোটা জীবনকে টেনে এনে। আর গল্প যখন একটু বড় হয়েছে, রাশিয়ার নানা স্তরের আপাদমস্তক বৈশিষ্ট্যহীন মানুষগুলোই তার বয়ানে হয়ে উঠেছে চিরকালের মানুষ।

‘শিকারী’ গল্পটা জুলাই, ১৮৮৫ তে লেখা। অল্প কথায় বহু না-বলা-গল্প বলার চেকফীয় ক্ষমতা এখানে পুরোমাত্রায় প্রকাশিত।]

তপ্ত আর দমবন্ধ গুমোট দিন। আকাশে কোনো মেঘ নেই। রোদেপোড়া ঘাসগুলোকে মনে হচ্ছে নিরানন্দ, নিরাশ, বৃষ্টি হলেও তারা যেন আর কখনো সবুজ হবে না। অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে নীরব, নিশ্চল, যেন গাছগুলো মাথা তুলে তাকিয়ে আছে কোথাও বা অপেক্ষা করছে কিছু একটার।

লাল শার্ট আর ভদ্রলোকের উপযুক্ত কুঁচকানো ট্রাউজার পরে বড় আকারের বুট পায়ে মন্থর পদচারণা করছে লম্বা, সরু কাঁধের এক লোক, বয়স তার চল্লিশের মতো হবে। তার ডানদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি, আর বামে দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত পাকা রাইশস্যের সোনালি সমুদ্র। মুখটা লালচে, ঘর্মাক্ত। লোকটার চমৎকার সোনালি চুলের ওপর বসে আছে শিরস্ত্রাণের মতো করে মুখাবয়ব ঝোলানো একটা সাদা টুপি, দেখেই মনে হয় সেটা উদার কোনো ভদ্রলোকের দেয়া উপহার হবে। তার কাঁধে ঝোলানো শিকারের ঝোলা, সেটার ভেতরে দুমড়ে-মুচড়ে আছে কালোরঙা এক পাখি। লোকটার হাতে একটা জোড়া ব্যারেলের শটগান, আড়চোখে সে নজর রাখছে তার বুড়ো, হাড্ডিসার কুত্তাটার ওপর, ঝোপঝাড় শুঁকতে শুঁকতে যেটা এদিক সেদিক ছুটতে ব্যস্ত। কোথাও কোনো শব্দ নাই, জীবিত সবকিছুই যেন এই গরম থেকে বাঁচতে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও।

‘ইয়েগোর ভ্লাসিচ!’ শিকারী হঠাৎ শুনতে পায় মৃদু কণ্ঠটা।

আরক্ত চোখে শিকারী ঘোড়াটাকে নিয়ে ঘুরতে শুরু করে। তার পাশে, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে ফ্যাকাশে মুখের এক বছর ত্রিশের মহিলা, তার হাতে একটা কাস্তে। মহিলাটি তার মুখের দিকে চেয়ে সলজ্জ হাসে।

‘পালেগা! তুমি!’ শিকারী ধীরে ধীরে বন্দুকটা নামায়। ‘আশ্চর্য! … এখানে কীভাবে?’

‘মোর গাঁয়ের মেয়েরা কাজ করতে এসছে ইয়েগোর ভ্লাসিচ, আমিও সাথে এসেছি। খেতমজুরের কাজ করছি এখানে।’

‘তা বেশ, তা বেশ।’ ইয়েগোর ভ্লাসিচ গলা পরিষ্কার করে, কী যেন বলতে চায়।

পালেগা হাঁটতে থাকে পাশে। নীরবে তারা হেঁটে যায় বিশ পায়ের মতো।

‘অনেকদিন আপনাকে দেখি নাই ইয়েগোর ভ্লাসিচ।’ শিকারীর চলন্ত কাঁধের দিকে চেয়ে পালেগা সস্নেহে বলে। ‘সেই ইস্টারের দিনে আপনি আমাদের বাড়ি এলেন এক গেলাস পানি খেতে, তারপর থেকে আপনাকে আর দেখি নাই। …কীভাবে কে জানে, আপনি মাতাল হয়ে এক মিনিটের জন্য আসলেন, আর আমায় মেরে গালিগালাজ করে চলে গেলেন… আমি শুধু অপেক্ষা করি আর অপেক্ষা করি। চোখ মেলে থাকি। আর ভাবি যে যদি ইয়েগোর ভ্লাসিচ আসতেন…’

‘তোমার ওখানে গিয়ে আমি কী করবো?’

‘তা ঠিক বটে, ওখানে তো কিছু করার নাই। … তবুও, বাড়ি তো! আপনি কর্তা, সব দেখে রাখবেন। ও কি, পাখি মেরেছেন নাকি ইয়েগোর ভ্লাসিচ? ইশ! বসুন না, একটু জিরিয়ে নিন!’

এসব বলতে বলতে পালেগা বোকার মতো হাসে, তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন সুখ ঝরছে।

‘বসবো? তা খানিক বসা যায়।’ ইয়েগরের স্বর অপরিবর্তনীয়, দুই তরুণ পাইনের মাঝে সে বসবার একটা জায়গা বের করে। ‘আরে তুমি আবার দাঁড়িয়ে কেন? বসো!’

পালেগা খানিক দূরত্ব বজায় রেখে রোদে বসে, সুখের আতিশয্যে সে হাতচাপা দিয়ে নিজের হাসিটা লুকায়। নীরবে কেটে যায় দুটো মিনিট। তারপর সে নরম স্বরে বলে, ‘যদি অল্প সময়ের জন্যেও আসতেন।’

‘কীসের জন্য আসবো বলো তো!’ ইয়েগোর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথা থেকে টুপিটা নামিয়ে লাল কপালের ঘাম মোছে। ‘কোনো দরকার নাই। এক দুই ঘণ্টার জন্য গেলে তোমার ছোটাছুটি বাড়ে, আর আমার তো ওই গ্রামে থাকাটা একটুও প্রাণে সয় না।তুমি তো জানো আমি কেমন লোক। আমি চাই ভালো শয্যা, চমৎকার এক কাপ চা আর মন জুড়ানো আড্ডা। আমি চাই ভালোভাবে থাকতে, কিন্তু গ্রামের চারিদিকে খালি গরিবি, নোংরা কাদা… একটা দিনও আমার ওখানে ভালো লাগে না। সরকার যদি আইন করেও আমাকে সেখানে থাকতে বাধ্য করে, আমি হয় সেই বাড়ি পুড়িয়ে দেবো, নইলে নিজেকেই চাবকে শেষ করবো। আমি সবসময়েই এমন, আমাকে কেউ শোধরাতে পারবে না।’

‘এখন কোথায় থাকেন আপনি?’

‘দিমিত্রি ইভানোভিচের বাড়ি, শিকারী হিসেবে। ওনার শিকারের যোগাড়যন্ত্র করি আমি। … আসলে কী জানো, চাকরিটা উনি দিয়েছেন কারণ উনি আমায় পছন্দ করেন।’  

‘কাজটায় সম্মান নাই ইয়েগোর ভ্লাসিচ। … ওদের জন্য ব্যাপারটা খেলা, কিন্তু আপনার জন্য তো ওটা কাজ, সত্যিকারের পেট চালানো…’

‘তুমি এসব বুঝবে না গাধা!’ আকাশে দিকে স্বপ্নালু চোখে চেয়ে ইয়েগোর বলে। ‘জন্মের পর থেকে তুমি বোঝোনি, আর কখনো বুঝবেও না যে মানুষ হিসেবে আমি কী। তোমার কাছে আমি পাগল, ছন্নছাড়া। কিন্তু সমঝদারের কাছে আমি গোটা জেলার সেরা শিকারী। শিকারে কেউ আমার সাথে পাল্লা দিতে পারবে না। ভদ্রলোকেরা এটা বোঝে, তারা আমার নামে পত্রিকায় ভালো ভালো কথাও লিখেছে।… তোমাদের গেঁয়ো কাজগুলোকে আমি যে গালি দেই, সেটা আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব করি বলে নয়, কারণ হচ্ছে শৈশব থেকেই বন্দুক আর শিকারী কুকুর বাদে আর কিছু আমি জানি না। কেউ যদি আমার বন্দুক নিয়ে যায়, আমি দরকারে মাছ ধরার ছিপ দিয়ে শিকার করবো, ছিপ নিয়ে নিলে আমি খালি হাতেই শিকারে যাবো।

… তবে হাতে কিছু পয়সা জমলে আমি মেলায় মেলায় ঘুরে ঘোড়ার ব্যবসাও করি। তুমিও তো জানো, যে একবার শিকারী আর ঘোড়া ব্যবসায়ীদের সাথে জুটে গেলে চাষারাও চাষ করা ছেড়ে দেয়। মানুষ স্বাধীন হতে শিখলে কিছুই তাকে আর আটকে রাখতে পারে না। দেখবে, কোনো ভদ্রলোক যখন নাটক বা ওইরকম শিল্পচর্চায় জড়িয়ে যায়, সেও তখন আর জমিদার কি রাজকর্মচারী হতে চায় না। অবশ্য তুমি মেয়ে মানুষ, এসবের কী বুঝবে? এসব বুঝতে মাথা লাগে।’

‘আমি বুঝি ইয়েগোর ভ্লাসিচ।’

‘ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদো না তো! তোমার কান্না দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তুমি কিছু বোঝো না।’

‘কই, কাঁদছি না তো!’ পালেগা অন্যদিকে ফিরে থাকে। ‘এটা পাপ ইয়েগোর ভ্লাসিচ! আমি একজন সামান্য মেয়েমানুষ, অন্ততঃ একটা দিন তো আপনি আমার সাথে কাটাতে পারতেন! বারো বছর হলো আমাদের বিয়ে হয়েছে, কিন্তু… কিন্তু একটা দিনও আপনি আমায় ভালোবাসেন নি। আমি কাঁদছি না…’    

‘ভালোবাসা!’ ইয়েগোর হাত চুলকায়। ‘আমাদের মাঝে কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে না। আমরা শুধু কাগজ-কলমেই স্বামী স্ত্রী। বাস্তবে আমি তোমার কাছে একজন বুনো মানুষ, আর তুমি আমার কাছে  একজন সামান্য মহিলা, যাদের মাঝে কোনো বোঝাপড়া নাই। আমরা কী করে জোড় বাঁধবো? আমি বন্ধনহীন, ক্ষ্যাপাটে, বখে যাওয়া এক লোক; আর তুমি, খালি পায়ের এক মজুরনি, থাকো নোংরার মাঝে, পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পর্যন্ত শেখোনি! আমি নিজেকে ভাবি একজন প্রথম শ্রেণীর শিকারী, কিন্তু তুমি আমাকে দেখো অবজ্ঞার চোখে। আমরা কীভাবে স্বামী স্ত্রী হই, অ্যাঁ?’

‘কিন্তু আমাদের তো চার্চে বিয়ে হয়েছে ইয়েগোর ভ্লাসিচ!’ পালেগা ফুঁপিয়ে ওঠে।

‘নিজের ইচ্ছেয় নয়! … তোমার ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ কাউন্ট সের্গেই পাভলোভিচকে, আর নিজেকে। আমার নিশানা তার চেয়ে ভালো বলে কাউন্ট আমায় ঈর্ষা করতো, গোটা একটা মাস সে আমাকে মদে চুর করে রেখেছিলো, আর মাতাল মানুষকে তো পোষ মানিয়ে বিয়ে পর্যন্ত দিয়ে দেয়া যায়! প্রতিশোধ নিতেই কাউন্ট আমাকে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছে। শিকারীর সাথে রাখাল বালিকার বিয়ে, হাহ!

… তা তুমি কেন আমায় বিয়ে করলে? তুমি তো দেখেছিলে যে আমি মাতাল? তুমি তো দাস নও, তুমি তো তাকে মানা করতে পারতে! হ্যাঁ, একজন শিকারীকে বিয়ে করা অবশ্যই তোমার চৌদ্দোগুষ্টির ভাগ্য, তাই বলে কি যুক্তি বুঝবে না? … হয়েছে তো, এখন কষ্ট পাও আর কাঁদো! কাউন্টের কাছে ওটা কেবল ঠাট্টা ছিলো, কিন্তু তুমি এখনো কাঁদছো, দেয়ালে মাথা ঠুকছো…’   

নীরবতা নেমে আসে। তিনটা বুনো হাঁস মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়, বনের ওদিকে মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত ইয়েগোর তাদের চোখ দিয়ে অনুসরণ করে।

‘তোমার চলে কীভাবে?’ পালেগার দিকে চোখ ফিরিয়ে সে জানতে চায়।

‘আমি তো এখন কাজ করতে বাইরে যাই। শীত পড়লে অনাথাশ্রমের কোনো বাচ্চাকে ঘরে এনে রাখি, ওরা মাসে দুই রুবল দেয়। কাজেই…’

আবার নীরবতা। রাই খেতের ওদিক থেকে কোমল একটা গান ভেসে আসে, কিন্তু আবার থেমেও যায়। এই বিশ্রি গরমে গান গাওয়া যায় না।

‘লোকে বলে আপনি নাকি আকুলিনার সাথে এক ঘরে থাকেন।’ পালেগা বলে।

ইয়েগোর চুপ করে রয়।

‘তার মানে আপনি তাকেই মনে জায়গা দিয়েছেন…’ 

‘তোমার কপালটাই এমন অনাথ মেয়ে, সেটাকে মেনে নাও।’ শিকারী আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে। ‘যা হোক, অনেক কথা হলো, এবার চলি। বিকালের মাঝে বলতোভো পৌঁছতে হবে আমায়।’

ইয়েগোর উঠে দাঁড়ায়, হাত পা ছোঁড়ে খানিক, বন্দুকটা কাঁধে নেয়।

পালেগা দাঁড়ায়। নরম স্বরে বলে, ‘আপনি কখন গ্রামে আসবেন?’

‘কী দরকার! সুস্থ হালতে তো আমি কখনো যাবো না, আর মাতাল হয়ে যদি যাই, তাহলে তো তোমার কোনো লাভ নেই! মাতাল হলে আমি খুব রেগে থাকি। চলি, বিদায়।’

‘বিদায়, ইয়েগোর ভ্লাসিচ!’

ইয়েগোর টুপিটা আবার মাথায় চড়ায়, কুকুরটার জন্য হাত বাড়িয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে এগোয়। পালেগা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকে পেছন থেকে দেখে। … তার কাঁধের নড়াচড়া, উদ্ধত মাথা, অলস, জমিদারি পদচারণা, সবই পালেগা দ্যাখে, আর তার চোখে ভর ওঠে দুঃখ মেশানো স্নেহে। তার দৃষ্টি স্বামীর লম্বা ছিপছিপে দেহে ঘুরে বেড়ায়, সেটাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে।

শিকারী মনে হয় সেই দৃষ্টিপাত অনুভব করে, সে থেমে পেছন ফিরে তাকায়। সে চুপ করেই থাকে, কিন্তু তার মুখ, তার কাঁধ দেখে মনে হয় লোকটা কিছু একটা বলতে চায়। পালেগা তখন ভীরু পায়ে কাছে যায়, দু’চোখ মেলে স্বামীর দিকে তাকায়।      

‘তোমার জন্য।’ একটা জীর্ণ রুবল হাতে ধরিয়ে দিয়েই শিকারী উল্টোদিকে ঘুরে দ্রুত হাঁটতে থাকে।

‘বিদায় ইয়েগোর ভ্লাসিচ!’ যন্ত্রের মতোই রুবলটা গ্রহণ করে পালেগা বলে।

লম্বা রাস্তাটা ধরে শিকারী হেঁটে যায় পাকানো একটা দড়ির মতো। মেয়েটা দাঁড়িয়ে থাকে ফ্যাকাশে, মূর্তির মতো নিশ্চল, এবং চোখের ভেতর ঢুকিয়ে নিতে থাকে লোকটার প্রতিটা পদক্ষেপ। কিন্তু এখন লোকটার লালরঙা শার্ট মিলিয়ে যাচ্ছে তার গাঢ় রঙের ট্রাউজারের সাথে, তার পদক্ষেপ আর দেখা যাচ্ছে না, কুকুরটাকে আলাদা করা যাচ্ছে না তার বুটের থেকে। শুধু শিরস্ত্রাণের মতো টুপিটাই চোখে পড়ে এখনো, কিন্তু হঠাৎ ইয়েগোর ডানদিকে ঘুরলে সেই টুপিটাও সবুজের মাঝে হারিয়ে যায়।

‘বিদায় ইয়েগোর ভ্লাসিচ!’ ফিসফিসিয়ে পালেগা পা উঁচু করে আরেকবারের জন্য সাদা টুপিটাকে দেখতে চায়।

[জানুয়ারি, ২০২১]