বিজ্ঞানীসুলভ অধ্যাবসায় নিয়ে লেখালেখির কাজটাকে গাণিতিক ছকের মতো করে তুলেছিলেন কোন্ লেখক, ভাবতে গেলে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নামটাই সবার আগে মাথায় আসে। বাংলাভাষী লেখকদের মাঝে লেখার দক্ষতা অর্জনকে শাস্ত্রের মতো করে তোলার ব্যাপারটা যে সৈয়দ শামসুল হকের মাঝে দেখি, কাকতালীয় মনে হয় না মোটেই, যখন জানতে পাই যে তাকেও তার সহধর্মিনী আনোয়ারা সৈয়দ হক ডাকতেন ‘হেমিংওয়ে’ বলে।
লেখালেখি নিয়ে যখনই মুখ খুলেছেন হেমিংওয়ে, কৌতূহল জাগানো সব সংস্কার আর নিয়মের কথা তার কাছ থেকে পেয়েছে পাঠক। আর সেই হেমিংওয়ে যখন কথা বলেছেন অন্যান্য লেখকদের নিয়ে, তাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে, পাঠক তখন সেখানেও উন্নাসিক এক কৌতুকী স্বর খুঁজে পেয়েছে ভালো ভাবেই।
তো নিজের লেখা গল্প, উপন্যাস কি অকল্প সাহিত্যের জায়গায় জায়গায় হেমিংওয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন অন্যান্য লেখকদের নিয়ে, তার মাঝে কয়েকটি এখানে তুলে রাখা হলোঃ
(০১)
আধুনিক আমেরিকান সাহিত্যের পুরোটাই এসেছে মার্ক টোয়েনের ‘হাকলবেরি ফিন’ থেকে। বইটা যদি পড়ো তো যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জিমকে ছেলেদের কাছ থেকে চুরি করা হয়েছে, ওখানেই পড়া থামিয়ে দিও। বইটা আসলে ওখানেই শেষ, বাকিটুকু স্রেফ ধোঁকাবাজি। কিন্তু ওটাই আমাদের সেরা বই। ওই বইয়ের আগে আমেরিকান সাহিত্যে কিছু ছিলো না, পরের কোনো কিছুও ওই বইয়ের মতো হয় নাই।
[ পৃষ্ঠা ২২, গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা ]
(০২)
…আমাদের আমেরিকা দক্ষ কিছু লেখক পেয়েছে। অ্যালান পো যেমন। তার লেখা খুব কুশলী, নির্মাণ শৈলী দারুণ। আমাদের এমন সব লেখকও ছিলো যাদের বর্ণনা খুব অলঙ্কার সমৃদ্ধ, যারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কোনো মানুষের দিনলিপি, অথবা ধরা যাক কোনো তিমি মাছ ধরার অভিযানের বর্ণনা দিয়েছে এমনভাবে, যে কেকের মাঝে লুকিয়ে থাকা কিশমিশের মতো সেখানে সারবস্তু খুবই কম। তবে মাঝে মাঝে যখন সারবস্তুটা অলঙ্কার ছাড়াই বেরিয়ে এসেছে, তখন সেটাকে ভালো লাগে। মেলভিল হচ্ছে এমন লেখক। কিন্তু লোকে যখন এ জাতীয় লেখার প্রশংসা করে, তারা প্রশংসা করে লেখাটার অলঙ্কারের জন্য, যা অপ্রয়োজনীয়। তারা লেখাটায় আরোপ করতে চায় এমন রহস্য, যা আসলে ওখানে নেই…
[ পৃষ্ঠা ২০-২১, গ্রিন হিলস অফ আফ্রিকা ]
(০৩)
ফিল্ডিং কিংবা ওদের যে কারো চাইতে যে তুমি ভালো লেখক, এ সত্যটা মেনে নিয়ে তোমার কেবল লিখে যাওয়া উচিৎ। সত্যিই বাড়িয়ে বলছি না, আমার কাছে তোমার লেখা ওদের যে কারো চাইতে অনেক বেশি ভালো লাগে।
জীবিত লেখকদের সাথে নিজের তুলনা পড়তে যেও না। তোমার উচিৎ নিজের সেরা লেখাটা লিখে সেটাকে মৃত লেখকদের সাথে তুলনা করা, যাতে আমরা তাদের উচ্চতা (উচ্চতা না ঠিক, বলা ভালো ক্ষমতাটা) বুঝতে পারি এবং একে একে হারাতে পারি। প্রথমেই দস্তয়েভস্কির সাথে লাগতে যাওয়ার দরকার কী? আগে তুর্গেনিভকে হারাও (আমরা দুজনেই সেটা ভালোমতো করেছি, ভুল না করলে ওর ১১৫ স্কোরের বিপরীতে আমরা করেছি ২০৫)। এরপরে মোঁপাসাকে সাইজ করো (কঠিন মাল, তিন রাউন্ড পর্যন্ত সমানে সমানে লড়বে সে), তারপর চেষ্টা করো স্তাঁদালকে হারাতে। কিন্তু দয়া করে সমকালের বিরক্তিকর চরিত্রগুলোর সাথে লড়াইয়ে নেমো না (কোনো নাম বলবো না)। সবচেয়ে সম্মানিত লেখক ফ্লবেরকেও তুমি, আমি দুজনেই হারাতে পারি…
[১৯৪৭ সালে উইলিয়াম ফকনারকে লেখা চিঠি; পৃষ্ঠা ৬২৪, নির্বাচিত চিঠি ]
(০৪)
জানতাম না যে ফকনারের অবস্থা এমন খারাপ, জেনে খুব ভালো লাগলো যে তুমি ওর পাশে আছো। অন্য যে কারো চাইতে সে প্রতিভাবান, এবং তার খালি দরকার এমন একটা মানসিক স্থিতি, যাতে করে সে ওই প্রতিভার ব্যাপারটা বুঝতে না পারে। অর্ধেক স্বাধীন আর অর্ধেক দাসত্বের মাঝে যেমন কোনো জাতি টিকতে পারে না, অর্ধেক সুস্থতা আর অর্ধেক উছৃঙ্খলতার মাঝেও তেমন কোনো লেখক লিখতে পারে না। কিন্তু ওই লোকটা সুস্থ হলেই লিখতে বসে, আর লিখে যায়; লিখতে লিখতে একসময় সে আর লেখাটা শেষ করতে পারে না। ভালো হতো যদি একটা ঘোড়ার মতো আমি লোকটাকে কিনতে পারতাম, তাহলে রেসের ঘোড়ার মতো তাকে ঠিকঠাক শিখিয়ে পড়িয়ে লেখালেখির ঘোড়া বানাতাম। শরৎ বা বসন্তের মতোই সুন্দর লাগে তার লেখা, তেমনই সহজ, তেমনই জটিল।
[১৯৪৫ সালে ম্যালকম কাউলিকে লেখা চিঠি; পৃষ্ঠা ৬০৩-৪, নির্বাচিত চিঠি]
(০৫)
‘দস্তয়েভস্কির কথা ভাবলে অবাক লাগে।’ আমি বললাম। ‘একটা লোকে কীভাবে এমন বিচ্ছিরি লিখেও, এমন অসম্ভব রকম বিচ্ছিরি লিখেও; কীভাবে এমন গভীরভাবে কাউকে ভাবাতে পারে?’
[ পৃষ্ঠা ১৩৭, আ ম্যুভেবল ফিস্ট ]
(০৬)
স্তাঁদাল একজন মহৎ লেখক, যার একটা মাত্র বই ভালো, ‘দা রেড এন্ড দা ব্ল্যাক’। ‘চার্টারহাউজ অফ পারমা’র কিছু অংশ ভালো (দুর্দান্ত), কিন্তু বেশিরভাগই সাধারণ, আর বাকিটুকু আবর্জনা।
[১৯৩২ সালে পল রোমানকে লেখা চিঠি; পৃষ্ঠা ৩৬৬, নির্বাচিত চিঠি ]
(০৭)
প্রজাপতির পাখায় ধূলো পড়ার মতোই প্রকৃতি-প্রদত্ত ছিলো [স্কট] ফিটজেরাল্ডের প্রতিভার ব্যাপারটা। প্রজাপতির মতোই সেও ব্যাপারটা কখনো অনুভব করেনি; কখনো বোঝেনি ওই প্রতিভাটা কখন আঘাত পেয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে যখন সে নিজের আঘাত পাওয়া পাখা নিয়ে, সেটার গঠন নিয়ে ভেবেছে; তখন সে আর উড়তে পারেনি কারণ ওড়ার প্রতি ভালোবাসাটাই আর অবশিষ্ট ছিলো না তার, তখন তার কেবলই মনে পড়েছে যে একদিন ওড়ার ব্যাপারটা কত সহজ ছিলো।
[ পৃষ্ঠা ১৪৭, আ ম্যুভেবল ফিস্ট ]
(০৮)
এখানে আমি সারাদিনই পড়ছি। তুর্গেনিভ আমার কাছে সর্বকালের সেরা লেখক। সেরা বইগুলো না লিখেও সে সেরা; অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তুমি কি তার লেখা ‘র্যাটল অফ হুইলস’ নামের ছোটগল্পটা পড়েছো? ওটা আছে ‘দা স্পোর্টসম্যানস স্কেচেস’ এর দ্বিতীয় ভলিউমে। ‘ওয়ার এন্ড পিস’ যে বই হিসেবে শ্রেষ্ট, আমি তা জানি, কিন্তু ভাবো একবার যে তুর্গেনিভ লিখলে সে বইটা ক্যামন হতো!
চেকভ মোট ছয়টার মতো ভালো গল্প লিখেছে, কিন্তু এমনিতে সে লেখক হিসেবে আনাড়ি। তলস্তয় তো একজন প্রেরিত পুরুষ। মোঁপাসা একজন পেশাদার লেখক, বালজাক একজন পেশাদার লেখক। কিন্তু তুর্গেনিভ ছিলেন শিল্পী।
[১৯২৫ সালে আর্চিবল্ড ম্যাকলিশকে লেখা চিঠি; পৃষ্ঠা ১৭৯, নির্বাচিত চিঠি]
[ডিসেম্বর, ২০২০]
Leave a Reply