অ্যাকুরিয়ামের অধিকাংশ মাছের গায়ের রং লালচে, কিছু আছে সোনালি বর্ণের। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এম মালিক এই বড় ঘরটিতে এলেই মাছগুলোর সাথে কিছু সময় কাটান। বিশেষ করে কাচের দেয়ালে টোকা মারতে তার খুব ভালো লাগে। হঠাৎ আলোড়নে বিব্রত হয়ে পড়া মাছগুলোর দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করার দৃশ্যটা বড় চমৎকার ঠেকে গভর্নর মালিকের কাছে। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন, গভর্নরের নিজেরই এখন মাথার ঠিক নেই।

চারপাশে বসে থাকা মন্ত্রীপরিষদের দিকে তিনি একবার চোখ বোলালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘এখন কী করা যায় আপনারাই বলুন। প্রেসিডেন্টকে টেলিগ্রাম করলাম পরশুদিন, এখনো তো সেটার কোনো জবাব এলো না। জানি যে প্রেসিডেন্ট খুব ব্যস্ত মানুষ, তবুও…’

‘ছাই ব্যস্ত!’ আব্বাস আলি খান গজগজ করলেন। ‘এদিকে ইস্টার্ন কমান্ডের বেহাল দশা, মিত্রবাহিনী নাকি ঢাকার হাতছোঁয়া দূরত্বে এসে পড়েছে। এইসময় প্রেসিডেন্টের আর কী ব্যস্ততা থাকতে পারে?… নিজে নিরাপদে আছেন তো, আমাদের জ্বালা তাই বুঝতে চাচ্ছেন না।’

‘সেভেন্থ ফ্লিট আসবে বলে শুনেছিলাম। আরো শুনেছিলাম চীনও নাকি সাহায্য পাঠাচ্ছে। কোথায় কী! জেনারেল নিয়াজীকে নাকি কাল বলা হয়েছে অন্তত আরো আটচল্লিশ ঘণ্টার আগে কোনো রকম হেল্প আসবে না।’ ওবায়দুল্লাহর কণ্ঠে তীব্র হতাশা।

‘আহা, এসব বলে এখন কোনো লাভ আছে,  বলুন?’ গভর্নর মালিক যেন নিজেকেই নিজে প্রবোধ দেন। ‘জেনারেল সাহেবও তো কম চেষ্টা করছেন না। নানা জায়গায় দৌড়ে বেড়াচ্ছেন…’

আব্বাস আলি খান টেবিল থেকে পত্রিকা তুলে ধরলেন একটা। ‘ছোট মুখে বড় কথা বললে মাফ করে দেবেন। আচ্ছা, আমাদের জেনারেল নিয়াজী এখনো কি প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারছেন না? বিদেশি  সাংবাদিককের জেনারেল কী কী বলে বেড়াচ্ছেন খেয়াল করেছেন আপনারা কেউ?’

গভর্নর মালিক পত্রিকাটা হাতে নিয়ে আব্বাস আলি খানের ইশারা মাফিক স্থানটি পড়া আরম্ভ করলেন। দিন দুই আগে এয়ারপোর্টে বিমানের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন কিছু বিদেশি  সাংবাদিক। নিয়াজী হঠাৎ তাদের সামনে পড়ে যাওয়ায় প্রচুর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাকে। পত্রিকার খবরটিতে সেরকম কিছু প্রশ্ন আর নিয়াজীর খিটখিটে প্রত্যুত্তরগুলো দেয়া আছে।

“‘জেনারেল, আপনি পালিয়ে গেছেন বলে একটা গুজব শুনেছিলাম…’

‘আপনি গুজব শুনলে আমি কী করবো। যান, যে গুজব ছড়িয়েছে তাকে ধরে নিয়ে আসুন…’

‘মিত্রবাহিনীর কথা শুনেছেন জেনারেল, তারা নাকি অবিলম্বেই ঢাকা পৌঁছে যাবে?’

‘এইসব বকোয়াজে কান দেবার সময় আমার নেই। আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসুন ওরা কোথায়।’

‘আপনার বর্তমান প্ল্যান কী? ঢাকা রক্ষা করতে পারবেন বলে মনে করেন আপনি?’

‘আমার নাম টাইগার নিয়াজী। আমার শেষ সৈন্যটি জীবিত থাকা পর্যন্ত আমি হাল ছাড়বো না। আমার বুকের ওপর ট্যাঙ্ক না চালিয়ে কেউ ঢাকা দখল করতে পারবে না…’”

উপস্থিত মন্ত্রীরা বুঝতে পারলো না, খবরটি পড়ে গভর্নর মালিক লম্বা একটা শ্বাস ফেলেছেন। জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধকৌশল মার খেয়ে গেছে। নিয়াজী এমন কৌশল ঠিক করেছিলেন, যাতে সীমান্তের প্রতিটা বড় শহরকে দূর্গের মতো অভেদ্য করে তোলা হয়েছিলো। কিন্তু মিত্রবাহিনী সেই সব দূর্গ জয়ের চেষ্টা না করে পাশ কাটিয়ে এসেছে। কিছু গোলন্দাজকে রেখে আসা হয়েছে অপেক্ষমান পাকিস্তানি মিলিটারিকে ব্যস্ত রাখতে। সেইসব গোলন্দাজদের কামান বর্ষণের আধিক্যে পাক বাহিনী ভেবেছে যৌথবাহিনী সোজাসুজিই এগোনোর চেষ্টা করছে। এই ভেবে তারা মূল সড়কগুলো আগলেই বসে ছিলো কয়েকদিন, বিমান বাহিনী আগেই অচল হয়ে গেছে বলে মিত্রবাহিনীর এই কৌশল বোঝার অন্য রাস্তাও অবশ্য তাদের ছিলো না।

এদিকে ভারতের সেনাপ্রধাণ মানেকশ ক্রমাগত রেডিওতে তাগাদা দিচ্ছে, পাকিস্তানি কমান্ডারেরা যাতে আত্মসমর্পণ করে। সারেন্ডার করা সৈনিকদের সাথে জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক ব্যবহারের প্রতিশ্রুতিও পাওয়া যাচ্ছে। গভর্নর মালিক বুঝতে পারছেন না, পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চলে যাবেন কি না। ঐ এলাকাকে আবার নিউট্রাল জোন ঘোষণা করা হয়েছে।

নওয়াজেশ আহমেদ মুখ খুললেন কিছু একটা বলবার জন্যে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই…

হঠাৎ বিস্ফোরণে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো সভাকক্ষের ছাদ। হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরো একবার বিস্ফোরণ ঘটলো আশেপাশেই। এরপর আরো একবার। চারবার, পাঁচবার, ছয়বার।

বিমানের জোরালো গর্জনে সবার আগে ওবায়দুল্লাহই বুঝতে পারলো ঘটনা কী। ‘ইন্ডিয়ান প্লেন অ্যাটাক করেছে স্যার! দৌড়ান, সময় থাকতে পালান!’

ভারতীয় মিগগুলো আবার ফিরে আসার আগেই প্রাণপণে দৌড়ালেন গভর্নর ও তার মন্ত্রীপরিষদ। দৌড়ে বাগান পেরিয়ে তারা আশ্রয় নিলেন গভর্নর হাউজের সামনের বাঙ্কারে। সেই বাঙ্কারে তখন জীবন বাঁচাতে মাথা গুঁজেছেন দি অবজারভারের গ্যাভিন ইয়ং সহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক।

‘স্যার, চলেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই চলে যাই!’ কাতর স্বরে অনুরোধ করলো কোনো এক মন্ত্রী।

‘কিন্তু সরকারি পদে থাকা অবস্থায় তো আপনারা নিউট্রাল জোনে ঢুকতে পারবেন না।’ গ্যাভিন ইয়ং বলেন।

‘দুত্তোরি!’ চুয়াত্তর বছরের গভর্নর মালিক চেঁচিয়ে উঠলেন স্থান-কাল ভুলে। ‘চেয়ারের নিকুচি করি, আগে জান বাঁচানো ফরয!’

এই বলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টেনে নিলেন হাতের কাছে পাওয়া এক টুকরো কাগজ। আশেপাশের উৎসুক সাংবাদিকদের কাছ থেকে একটা কলম নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতের লেখায় সেখানেই লিখে ফেললেন নিজের এবং তার মন্ত্রীদের সম্মিলিত পদত্যাগপত্র।

গভর্নর হাউজের বিশাল সভাকক্ষের অ্যাকুরিয়ামের লাল কিংবা সোনালি রঙের মাছগুলো যখন জলহীনতায় ছটফট করছে খোলা ছাদের নীচে, ধার নেয়া একটি বলপয়েন্ট সে সময় সাক্ষী হয়ে গেলো মিত্রবাহিনীর অনন্যসাধারণ একটি বিজয়ের।

ইতোমধ্যে আরো একটি কলম তালিকাবদ্ধ করেছে বেশ কিছু মানুষের নাম।

সে তালিকায় নাম ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক গিয়াসুদ্দীন আহমদের।

মোহসিন হলের এই হাউজ টিউটরের কাছে ইসলামী ছাত্রসংঘের কিছু ছাত্র অনুরোধ নিয়ে এসে বলবে, ‘স্যার, হলের পানির পাম্প নষ্ট, কাজ করে না। মিস্ত্রীরা কারফিউর মাঝে আসতে চায় না, একটা ব্যবস্থা নিতে হয় যে স্যার!’

গিয়াসুদ্দীন আহমদ নিজেই বাসার দেয়াল টপকে চলে যাবেন পাম্পটি সারাই করতে। ওই অবস্থাতেই আল বদরের সদস্যেরা ধরে নিয়ে যাবে গিয়াসুদ্দীন স্যারকে। নষ্ট পানির পাম্পটি মেরামত হবে না আর বহুদিন।

অথবা সেই তালিকায় নাম থাকা সন্তোষ ভট্টাচার্যের কথা মনে করা যায়।

ইতিহাসের অধ্যাপক সন্তোষ বাবু তখন মাত্র বসেছেন আহ্নিক নিয়ে। জানালায় কাদামাটি মাখা একটি মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ায় তাঁর বাড়ির সামনে। কোনো এক আল বদর এসে তাকে বলবে, ‘স্যার, আমাদের সঙ্গে একটু আসতে হয় যে!’

সন্তোষ স্যার নির্বিকার থেকে বলবেন, ‘বাবারা, মাত্র পূজোয় বসেছি। তোমরা একটু বসো, আমি আসছি।’

‘মালাউনের বাচ্চা! ভালো মতো বললাম, কথা কানে গেলো না!’ হুঙ্কার দিয়ে মাইক্রোবাসের ভেতরে টেনে তোলা হবে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে। প্রার্থনা রয়ে যাবে অসমাপ্ত।

ঢাকা মেডিকেলের ডা ফজলে রাব্বীও ছিলেন তালিকায়।

সিদ্ধেশ্বরীর জলপাইগুড়ি হাউজের দোতলার বারান্দায় বসে আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখবেন তিনি। কাঁধে চড়ানো ছোটমেয়েকে বলবেন, ‘দেখো দেখো আম্মু, ঐ যে প্লেন যায়! ঐ দেখো প্লেনগুলা যুদ্ধ করে!’

তখন উর্দুভাষী কয়েকজন আল বদর এসে ঘেরাও করবে জলপাইগুড়ি হাউজ, আর তিনটি দরজার তালা খুলে রক্ষাব্যুহের বাইরে বেরিয়ে আসবেন ফজলে রাব্বি। পেছনে চির অপেক্ষায় রইবে তার স্বজনেরা।

এতসব ক্ষণজন্মা মানুষের রঙ্গিন জীবনের ছেদ পড়বে সাদা পাতায় কালো কালির একটি বলপয়েন্টের খোঁচায়। রাও ফরমান আলী তার কলমে স্বহস্তে এইসব মানুষদের নাম ডায়েরিতে তুলবে বাঙালিদের মেধাশূন্য একটি ভবিষ্যতের আশায়, আর সেই তালিকা ধরে কে জানে কেন, যুদ্ধের এই হার নিশ্চিত পর্যায়ে এসেও আল বদর বাহিনী চালাবে এক নামানুষী হত্যাযজ্ঞ।

একটি বলপয়েন্ট তার গতিপথে হাতছোঁয়া দূরত্বের চূড়ান্ত বিজয়ের ছায়া দেখিয়ে দেবে সবাইকে, অথচ আরেকটি বলপয়েন্টের নির্মম অক্ষরগুলো সাক্ষাৎ করাবে গোপীবাগ রেললাইনের ওপারের এক বৃদ্ধের সাথে। বারান্দায় নিশ্চল বসে থাকা বুড়ো মানুষটি,দৈনিক পূর্বদেশের সিনিয়র সাব এডিটর গোলাম মোস্তফার বাবা মৌলবী জহিরুদ্দীন আহমদ,কোনো আগন্তুককে দেখলেই বলবেন, ‘বাবা, আমার পোলাটার কোনো খোঁজ পাইলা?’

… জীবন কী আশ্চর্য বৈপরীত্যে ভরপুর!

[ ** লেখকের  উপন্যাস ‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ থেকে]