পড়া হলো লেখালেখি নিয়ে ইতালো কালভিনের বেশ কিছু বক্তব্যের সংকলন ‘সিক্স মেমোজ ফর দা নেক্সট মিলেনিয়াম’। ১৯৮৪-৮৫ এর দিকে The Charles Eliot Norton Lectures সিরিজের অংশ হিসেবে এই বক্তব্যগুলো প্রস্তুত করেছিলেন কালভিনো।

আগামী শতাব্দীর (অর্থাৎ এই একবিংশ শতাব্দীর) সাহিত্যের সম্ভাব্য গতিপ্রকৃতি নিয়ে কয়েকটা প্রবন্ধ জায়গা পেয়েছে আলোচ্য সংকলনে। শোনা যায়, এই বিষয়ে মোট আটটি প্রবন্ধ লেখার পরিকল্পনা ছিলো কালভিনোর, কিন্তু অকাল প্রয়াণের কারণে কাজটি সম্পূর্ণ করা আর হয়ে ওঠেনি তার। ফলে, নামে ‘সিক্স মেমোজ’ হলেও অত্র শতাব্দীর সাহিত্যচর্চার পাঁচটি মাত্রা নিয়েই আলাপ করা হয়েছে এখানে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, কালভিনোর মতে, একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যচর্চায় থাকা উচিৎ নিচের বৈশিষ্ট্যগুলোঃ

১) নির্ভার থাকা (LIGHTNESS)
কালভিনোর মতে একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের প্রথম গুণটি হলো এই নির্ভার থাকা, অর্থাৎ অপ্রয়োজনে সেটাকে ভারাক্রান্ত না করা।

২) গতিশীলতা (QUICKNESS)
আধুনিক লেখায় গতির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলছেন কালভিনো। গল্পের যতই শাখাপ্রশাখা তৈরি হোক, কিংবা যতই পুনরাবৃত্তি থাকুক সেখানে, সময়কে টানটান রাখতেই হবে লেখককে।

৩) যথার্থতা (EXACTITUDE)
কালভিনো বলছেন, সাহিত্যের কেবল একটা অংশই ভাষায় প্রকাশযোগ্য, অন্য অংশটা বিমূর্ত, সেটাকে ভাষা দিয়ে ধারণ করা যায় না। এই দুইয়ের মাঝে একটা ভারসাম্য দরকার।

৪) দৃশ্যমানতা (VISIBILITY)
কালভিনোর মতে, একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের একটা বড় পরীক্ষা সেটাকে ‘দৃশ্যমান’ করে তোলা। কালভিনো দেখছেন যে আধুনিক মানুষ ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে চোখ বন্ধ করে কোনো কিছু কল্পনা করবার শক্তি। মনের ভেতরে শুধু ছবি দাঁড় করিয়ে মানবশিশু যে প্রক্রিয়ায় কাহিনি বানায় (কমিক্স পড়া একটা ভালো উদাহরণ), আধুনিক মানুষের সেই অভ্যাস ক্রমশ বিলীন হচ্ছে। ফলে এই যুগের সাহিত্যের ‘দৃশ্যে’ রুপান্তরিত হবার ক্ষমতা রাখাটা দরকার, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে।   

৫) বহুত্ব (MULTIPLICITY)
একমাত্রিক, একটা অর্থ বহন করে যে সাহিত্য, কালভিনো বলছেন সেটা স্বল্পস্থায়ী হতে বাধ্য। তিনি চেয়েছেন সাহিত্য যেন বহু অর্থ বহন করে, জীবনের সামগ্রিকতা ধারণা করে। কালভিনোর মতে এ ধরনের সাহিত্যের আদর্শ উদাহরণ বোর্হেস, যিনি সাহিত্যের প্রচলিত ছক ভেঙে লেখার সীমানাটাকেই বহুমাত্রিক করে তুলেছিলেন।

তো এই হলো অতি সংক্ষেপে আলোচ্য সংকলনে কালভিনোর বক্তব্য। বলাই বাহুল্য, উপরে যেভাবে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেবার মতো বুলেট পয়েন্ট আকারে বলার চেষ্টা করেছি, কালভিনোর বয়ানে ব্যাপারটা মোটেই তেমন ছিলো না, ফলে তার প্রজ্ঞার পরিচয় পেতে হলে মূল সংকলনের কাছেই ফেরাটা শ্রেয়। তাছাড়া, বিশ্বসাহিত্যের একাগ্র পাঠক কালভিনো তার বক্তব্যে একের পর এক সব উদাহরন টেনেছেন নানা সাহিত্য কর্ম থেকে, সেটার আকর্ষণও কম নয়।

পুরো বই জুড়েই দারুণ সব পর্যবেক্ষণে পাঠককে সচকিত করেন কালভিনো। সর্বদাই যে সেগুলোর সাথে একমত হওয়া যায়, তা নয়। তবে বহু ক্ষেত্রেই মনে হয় যে নিজের উপলদ্ধির, বক্তব্যের একটা ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় কালভিনো বাচন থেকে। আজকের আলোচনাটা শেষ করবো সাহিত্য আর ভাষা প্রসঙ্গে কালভিনোর অমন কিছু উদ্ধৃতি তুলে দিয়েই।

সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার প্রসঙ্গেঃ

শত শত বছর ধরে আমরা দেখেছি সাহিত্যের ময়দানে দুটো বিপরীতমুখী প্রবণতাকে। এক ধরনের সাহিত্য চেয়েছে ভাষাকে একটা ভারহীন বস্তুর মতো ব্যবহার করতে, যা অন্যান্য সমস্ত কিছুর ওপরে ভেসে থাকবে মেঘের মতো। কিংবা বলা যায়, সেটা চেয়েছে ধূলোর কোনো পাতলা আস্তরণে বর্ণনাকে ঢেকে রাখতে। কিংবা আরো ভালো করে বলা যায়, সেটা চেয়েছে একটা স্পন্দিত চৌম্বক ক্ষেত্রের ভেতরের সবকিছুকে ঢেকে রাখতে। আর অন্য ধরনের সাহিত্য চেয়েছে ভাষাকে একটা ওজন, ঘনত্ব দিতে; যেন সেটা বস্তু, দেহ বা অনুভূতির মতো কিছুকে ব্যাখ্যা করতে গেলেও একটা নিরেট আকার পায়।

অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের সাথে সাহিত্যের পার্থক্য প্রসঙ্গেঃ

যন্ত্র সভ্যতার এই কালে, অসম্ভব দ্রুত আর সর্বগামী গণমাধ্যম যখন সব ধরনের যোগাযোগের ব্যাপারটাকে করে তুলতে চাইছে একই ছাঁচের সমশ্রেনীভুক্ত; সাহিত্যের কাজ তখন লিখিত ভাষার সত্যিকার বাঁকবদল ঘটিয়ে ভিন্ন সব জিনিসের মাঝে সংযোগ স্থাপন করা, ভিন্ন বলেই তাদের ব্যবধানটা ঘুচিয়ে না দিয়ে সেটাকে আরো প্রকট করে তোলা।

প্রতিদিনের ভাষাকে নতুন করতে সাহিত্যের ভূমিকা প্রসঙ্গেঃ

… সাহিত্য হলো সেই প্রতিশ্রুত ভূমি, যেখানে ভাষা তার সত্যিকারের গন্তব্য খুঁজে পায়।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, মানুষ আজ এমন এক মহামারিতে আক্রান্ত, যেটা ক্ষুণ্ণ করেছে তার সবচাইতে স্বতন্ত্র ক্ষমতাকে, শব্দের ব্যবহার। আমাদের ভাষাচর্চা ভুগছে মারাত্মক এক রোগে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমাদের অভিব্যক্তিগুলো হয়ে উঠছে খুবই সরল আর বর্গীভূত। ক্ষতি হচ্ছে জ্ঞানসাধনার, হালকা হয়ে যাচ্ছে আমাদের অকপট কথাগুলো, কমে যাচ্ছে শব্দের পারষ্পরিক ঠোক্করে নতুন কিছু উদ্ভাবনের সম্ভাবনা…

আমি এখানে সেই মহামারির সম্ভাব্য উৎসগুলো নিয়ে কথা বলতে চাই না, আমি বরং আলাপ করতে চাই সুস্বাস্থ্যের সম্ভাবনা নিয়ে। সাহিত্য, এবং সম্ভবত কেবল সাহিত্যই পারে, ভাষার ওই দুরারোগ্য ব্যাধির বিপরীতে দাঁড়াতে।

উচ্চাভিলাষী সাহিত্যিক প্রকল্প প্রসঙ্গেঃ

অন্যান্য বহু ক্ষেত্রেই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পেরা অননুমোদনীয়, কিন্তু সাহিত্যে তা নয়। সাহিত্য ততক্ষণই জীবিত, যতক্ষণ আমরা কল্পনারও বাইরের কোনো অসীম লক্ষ্য নিজেদের সামনে নির্ধারণ করছি। অন্যেরা যা করার কথা চিন্তাও করবে না, কবি কি লেখকেরা তাদের সামনে সেই অচিন্ত্যনীয়কে গন্তব্য স্থির করবেন যতদিন, সাহিত্য ততদিনই লাইনে থাকবে।

আটপৌরে ব্যাখাগুলো সুনির্দিষ্ট শাখার এবং বিশেষায়িত না হলে বিজ্ঞান যেমন সেগুলোকে অবিশ্বাস করে, তেমনই, সাহিত্যের বড় পরীক্ষাটা হলো জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে একত্রে কাজে লাগিয়ে সুতো বোনা, ভিন্ন ভিন্ন সূত্র হতে পৃথিবীর একটা বহুমুখী আর বহু অর্থবোধক সংস্করণ তৈরি করা।

[৫ নভেম্বর, ২০২০]