মানিক, বিভূতি, তারাশঙ্কর যেমন মুখে মুখে ঘোরে বাংলা উপন্যাসের পাঠকের; সতীনাথ ভাদুড়ী সেদিকে যেন বিহার জেলার মতোই দূরে, চট করে তাকে স্মরণ করাটা কঠিন। ফলে এমন দেখেছি অনেক, যে অনেক পাড়া মাড়িয়ে আসা পাঠকেরও সতীনাথকে আবিষ্কার করতে সময় লাগে। তবে বিলম্বে হোক, বা দ্রুত; যখন পাঠক পড়েন সতীনাথকে; বিস্ময়ের এক প্রচন্ড থাবড়া খেয়ে তাকে সোজা হয়ে বসতে হয় তখন। এমন লেখকও আছেন? এভাবে, অ্যাতো নিস্পৃহ থেকে, অ্যাতো অচঞ্চল থেকে, নিজেকে এমন আড়ালে রেখেও তবে উপন্যাস লেখা যায়? সেই পাঠককে তাই প্রচণ্ড ঈর্ষা হয় আমার, যিনি সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস পাঠ করবেন প্রথমবারের মতো।

সতীনাথ ভাদুড়ীর মাহাত্ম্য নিয়ে এসব আলাপ পরে করা যাবে কখনো, আপাতত আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে চাই ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’কে। সতীনাথ তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও এই উপন্যাস তুলনারহিত। আর সব কিছু বাদ দিলেও, বিহার জেলার অন্ত্যজ এক যুবককে তুলসীদাসের রামের মতো কল্পনা করাটাই বিস্ময়কর এক ব্যাপার! অথচ সতীনাথ সেই কীর্তি স্থাপন করলেন বরাবরের মতোই তার অকম্পিত, অনাড়ম্বর ভঙ্গিতে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর ঢোঁড়াই কিন্তু বাস্তবেরই এক চরিত্র! কাল্পনিক হওয়া সত্ত্বেও পাঠকের দুনিয়ার বাস্তবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা শার্লক হোমসকে যেমন কোনান ডয়েল তৈরি করেছিলেন ডাক্তার জোসেফ বেল নামে এক ভদ্রলোকের অনুকরণে, আমাদের ঢোঁড়াইকেও তেমন সতীনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন পূর্ণিয়া জেলার এক গ্রামবাসীর মাঝে।

সতীনাথ নিজে এ প্রসঙ্গে কী বলছেন, দেখা যাকঃ

তাৎমাটুলিতে ঢোঁড়াই নামের একজন লোক সত্যিই ছিল। … এখানকার গ্রামাঞ্চলে ওই নামটা খুব চলে। তবে তার হিন্দিতে তার বানান হলো ঢোড়াই; উচ্চারণ ঢোঢ়হাই। আমি বাংলাভাষীদের ভুল বানানটা দিয়েছিলাম, ওই নামের অনুষঙ্গে নির্বিষ সাপের ইঙ্গিতটুকু আনবার জন্য…*

নামের বানানের এই পরিবর্তনের দায় স্বীকার করে নিয়ে সতীনাথ পাঠককে আরো জানান ঢোঁড়াইয়ের পেশার কথাঃ

বহু মুর্তিতে আমি ঢোঁড়াইকে দেখেছি। তাকে ভিক্ষা করতে দেখেছি, ঘর ছাইতে দেখেছি, গরুর গাড়ি চালাতে দেখেছি। ইদানিং সে হয়েছিলো রাজমিস্ত্রি-ঠিকেদার।  *

এভাবে টুকটাক নানা তথ্য আমাদের জানা হয় বাস্তবের ঢোঁড়াই সম্পর্কে। তার বাকপটুতার নাতিদীর্ঘ বিবরণ পড়ে আমরা হাসি। হাসির বেগ বিশেষ করে বাড়ে সেই জায়গাটায়, যখন মৃত এক ঘোড়াকে সরাবার জন্য তাৎমাটুলির ধাঙড়দের সাথে বায়না করে জনৈক ভদ্রলোক কাজ শেষে হ্যামিলনের সেই মেয়রের মতোই টাকা কম দিতে চান, আর ঢোঁড়াই বুদ্ধি দেয় যে ঘোড়াটাকে ফের আগের জায়গায় ফেলে আসা হোক!

কিন্ত শুধু দুষ্টবুদ্ধিতেই কি সীমাবদ্ধ থেকেছে ঢোঁড়াই? নাহ। সতীনাথের বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে, দোষও তার ছিলো এন্তার। নিচের অংশটুকু যেমন দেখা যাকঃ

… ঢোঁড়াইয়ের চরিত্রের আরেকটা দিকেরও একটু আভাস দেওয়া দরকার। সে একবার একটা দুরমুশ চুরি করে ধরা পড়েছিল। আরেকবার টাকা খেয়ে, জাতের পঞ্চায়েতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে অপরের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করেছিল। এছাড়া আরও অনেক দোষ ছিলো ঢোঁড়াইয়ের। তার সবগুলোই দারিদ্র্যজনিত নয়।  *

দোষগুণ সব মিলিয়েই তবু ঢোঁড়াই নজর কেড়েছিলো সতীনাথের। চরিত্র হিসেবে ঢোঁড়াইয়ের প্রতি লেখকের মনোযোগ যাওয়ার একটা বেশ স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে এখানেঃ

ধূর্ত অথচ অকপট, নিরক্ষর অথচ জটিল প্রশ্নের সরল সমাধানে সক্ষম; নিজে অন্যায় করে অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোন সময় রুখে দাঁড়াবার সাহস রাখে; স্বার্থপর অথচ একটা অসহায় পশুর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত; রঙ্গরসে ভরা বিচিত্র এই ঢোঁড়াইয়ের চরিত্র বহুদিন থেকে আমায় আকর্ষণ করত।  * 

কিন্তু কী করে সতীনাথের মাথায় এলো এই ঢোঁড়াইকে তুলসীদাসের রামের সমান্তরালে স্থাপন করে ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ লেখার চিন্তা? সেটার আগে আসলে জানা দরকার, নির্দিষ্ট করে ঠিক রামায়ণের দিকেই কেন নজর গেলো ভাদুড়ীজীর। সেজন্য নিচের অংশটুকু দেখিঃ

… শ্রীরামচন্দ্রের চেয়ে ছোট আদর্শে উত্তর ভারতের সাধারণ লোকের মন ভরে না। রামায়ণের দিকে আমার নজর পড়েছিল আরও কয়েকটি কারণে। আমাদের দেশের সাধারণ লোকের গভীর ধর্মপরায়ণতার সঙ্গে রামায়ণের কাঠামোতে ফেলা বই বেমানান হবে না, এই ছিলো আমার ধারণা। … ইচ্ছা ছিলো, আমার গ্রামের নিরক্ষর সাধারণ মানুষের মন কেমন ভাবে বদলাতে দেখেছি, কেমন ভাবে তারা ভুলভ্রান্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ হিসেবে নিজেদের অধিকার বুঝে নিচ্ছে, তাই নিয়ে একখান উপন্যাস লিখব। সমস্ত গ্রামীণ সমাজ তুলে ধরবার ইচ্ছা। মানুষ বদলাচ্ছে পরিবেশকে, পরিবেশ বদলাচ্ছে মানুষকে। … ভেবেছিলাম আদিকবির আড়ালে আশ্রয় নিলে, হয়তো পাঠকেরা বইয়ের পরিবেশ-প্রধানতা ক্ষমা করতে পারবেন… * 

‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর পাঠক জানেন, বর্ণিত উপন্যাসের বর্ণনায় এমন নিস্পৃহ ছিলেন সতীনাথ, যে মনে হয় যেন কোনো কৌশলই তার নেই, নিতান্ত ভাগ্যগুণে যেন তিনি পার পেয়ে গিয়েছেন সরলভাবে গল্প বলে। অথচ ব্যাপারটা যে মোটেই তা নয়, বরং রামায়ণের কাঠামোতে গল্প বলার কৌশলটা যে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই তিনি অবলম্বন করেছিলেন, সেটা স্পষ্ট হয় উপরের বর্ণনাটুকু পড়লেই।

অন্যদিকে, কাঠামোর কেন্দ্রে থাকা যে ঢোঁড়াই, তার চরিত্রকে উপন্যাসে ধরতে চেয়ে ঠিক কী ভেবেছিলেন সতীনাথ? সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায় এই অংশটুকু পড়লেঃ

আমার কাজ হলো চেনা ঢোঁড়াইকে এমনভাবে বদলানো যাতে সে সারা দেশের সাধারণ লোকের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। তাদের প্রতিবেশের পূর্ণতম সম্ভাবনাটুকু তার চরিত্রের মাঝে দিতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকে চাষবাস করে খায়। তাই গরুর গাড়িচালক ঢোঁড়াইকে যৌবনে তাৎমাটুলি থেকে সরাতে হলো চাষবাসের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার জন্য। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াবার সময় ওই শ্রেণীর লোকের চরিত্রে, যেখানে যা কিছু ভালো নজরে পড়েছিল, সেই সব সদ্গুণ দিয়ে তাৎমাটুলির ঢোঁড়াইকে সাজাতে আরম্ভ করলাম। শ্রীরামচন্দ্রকে কানা-খোঁড়া দেখানো চলে না। সে জন্যে ঢোঁড়াইয়ের স্বভাবে মারাত্নক ত্রুটিগুলো বেমালুম চেপে যেতে হলো… * 

তো, এভাবেই লেখা হলো ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’। তবে দ্রুত নয়, যথেষ্ট ধীরে। প্রথম আর দ্বিতীয় চরণ রচনার মাঝের সময়টায় সতীনাথ কিছুদিনের জন্য ইউরোপ আসেন। লন্ডন, প্যারিস, জার্মানি আর অস্ট্রিয়া ঘুরে দেশে ফিরে তবে তিনি পুনরায় ব্যস্ত হন জিরানিয়ার ঢোঁড়াইকে কাগজে ধরতে। উপন্যাসটা পড়লেই বোঝা যায়, সতীনাথ এই লেখা লিখেছেন বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতা দিয়ে; দিনের পর দিন ঢোঁড়াইদের জীবনটাকে নিজ চোখে দেখে নিয়ে, কোনো প্রকল্পিত ছক মাথায় নিয়ে নয়।

মজার ব্যপার হচ্ছে, তাকে নিয়ে যে বই লেখা হচ্ছে, বাস্তবের ঢোঁড়াই’ও সে কথাটি জানতো। এ নিয়ে উৎসাহেরও তার সীমা ছিলো না। সতীনাথ বলছেনঃ

… ঢোঁড়াই নিজে খুব খুশি হয়েছিল। অবশ্য বই না পড়েই। সে প্রথম থেকে জানত যে তাকে নিয়ে বই লেখা হচ্ছে। আমার রাজনীতিক্ষেত্রের একজন সহকর্মী তাকে খবরটা দিয়েছিলেন। তখন থেকে সে বিনা প্রয়োজনে আমার কাছে এসে ছড়া, গান, রামায়ণের লাইন শুনিয়ে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করতো যে সে মূর্খ নয়। *

এখানেই শেষ নয়, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ উপন্যাস প্রকাশিত হবার পরে যখন নানা জায়গায় প্রশংসা শোনা যাচ্ছে সেটার, বাস্তবের ঢোঁড়াই তখনও একবার দেখা করতে এসেছিলো সতীনাথের সাথে। সেটারও নাতিদীর্ঘ এক বর্ণনা দিয়েছিলেন ভাদুড়ীজী।

কিন্তু সে প্রসঙ্গ হয়তো আলাপ করবো অন্যদিন, আজ শেষ করবো বাস্তবের ঢোঁড়াইকে খ্যাতিতে বহুগুণ ছাড়িয়ে যাওয়া উপন্যাসের ঢোঁড়াইকে নিয়ে সতীনাথের নিজের বক্তব্য দিয়ে। লেখক নিজে কী বলেন এই চরিত্রের সার্থকতা নিয়ে?

… শেষ পর্যন্ত ঢোঁড়াইয়ের চরিত্র যা দাঁড়াল, তাতে আমি মোটেই তৃপ্তি পাইনি। চেষ্টার ত্রুটি আমার ছিলো না, কিন্তু যে বিশালতা ও গভীরতা দিতে চেয়েছিলাম সে চরিত্রে, নিজের অক্ষমতার জন্য তা দিতে পারিনি। ঢোঁড়াইদের চরিত্র মানস সরোবরের ন্যায় বিশাল ও গভীর। সেটাকে চেয়েছিলাম এক গণ্ডুষ গল্পের মধ্যে ধরতে। পারিনি। * 

পড়লে ভারী অবাক লাগে। তর্ক সাপেক্ষে বাংলা উপন্যাসের সেরা চরিত্রটিকেও নিয়েও লেখক এমন নিস্পৃহ থাকেন কী করে?

এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পাঠকের এখন মনে পড়ে যায় সতীনাথকে ঘিরে থাকা সেই রহস্য। ভাদুড়ীজীর চিরকালীন নিরাসক্ত মনোভাব।

সেই সতীনাথ, বানিয়ে ফেনিয়ে কিছুই যিনি লিখতে চাননি, বার কাউন্সিল লাইব্রেরির কেস ফাইল থেকে মাঠে প্রান্তরে যিনি কেবলই খুঁজেছেন মানুষের ভেতরের ব্যাক্তিটিকে, ছয়টি উপন্যাসের প্রতিটিতেই যিনি নিজেকে আদ্যন্ত বদলে নিয়েছেন খোলস বদলানো সাপের চাইতেও অদ্ভুত ভাবে; একটা নিঃস্পৃহতা চিরকালই ঘিরে রেখেছে সেই সতীনাথকে। সেই বর্ম ভেদ করে যারা অবশেষে পৌঁছে যান সেই মানুষটির কাছে, চেনা হয়েও ভীষণভাবে অচেনা এক জগৎকে আবিষ্কারের অনুভূতি তাদের এমন তাড়িত করে, যে এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় না তো কোনোদিন আর। সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস যিনি পাঠ করবেন প্রথমবারের মতো, সেই পাঠককে ঈর্ষা না করে তাই উপায় কোথায়?

[অক্টোবর, ২০২০]

* সতীনাথ ভাদুড়ী, পড়ুয়ার নোট ও অন্যান্য, কলকাতাঃ মনফকিরা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১২