(১)
স্মৃতিচারণ বলবো, না ইতিহাস?
যে নামেই ডাকা হোক, প্রচ্ছদ দেখেই আন্দাজ করা যায় যে গ্যারি জেনকিন্সের এই রচনায় চরিত্রের অভাব নেই। কিন্তু কারা এই স্মৃতিচারণের চরিত্র?
অনেকেই। যেমন সাও পাওলোর বড়লোক পাড়ার অ্যাস্ট্রোটার্ফের কোণে দাঁড়িয়ে ফুটবলে লাথি মারতে থাকা বাচ্চাদের দিকে চেয়ে থাকা ওই বুড়ো। আজও ব্রাজিল ওই বুড়োকে চেনে ‘দা ক্যাপিটান’ নামে।
একই শহরের গাড়ির দোকানের ওই লম্বাটে সেলসম্যানটিও এই স্মৃতিচারণের আলোচিত এক চরিত্র। সেই লোক, যার পাগলামি গোটা দেশকেই একটা মাস ধরে করে রেখেছিলো তটস্থ আর যার শিশুতোষ এক ভুলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো ব্রাজিলের হৃদস্পন্দন।
কিংবা লক্ষ করা যায় ‘দা জেনারেল’ এর দিকে, এ ডাকনামেই লোকটা পরিচিত। হোয়াও সালদানহার পাগলামিতে তাকে হটিয়ে দিয়ে যখন মারিও জাগালোকে বসানো হলো খেলার দুনিয়ার সবচেয়ে তীক্ষ্ণ কাঁটা বিশিষ্ট আসনটিতে, চুরুট ফোঁকা ঐ চেইনস্মোকারটিই হয়ে উঠেছিলেন জাগালোর পুতুল নাচের প্রধান সুতা।
আর স্বাভাবিক ভাবেই কোকাকোলা আর যিশুখ্রিস্টের পরে পৃথিবীর সবচাইতে পরিচিত নামটিও উঠে আসে এই স্মৃতিচারণে। ব্রাজিল সরকারের ক্রীড়া বিষয়ক বিশেষ দূতের দায়িত্ব পালনকরা এই ভদ্রলোকের নামের বানান প্যাট ক্রিরাল্ড করেছিলেন বড় সুন্দর ভাবে। ‘ইটস সিম্পল। জি- ও- ডি!’
খেলাধূলায় একটু আগ্রহী হলে বুঝে ফেলার কথা, যে বর্ণিত চারজনের মানুষের মাঝে মূল যোগসূত্রটা এখানে ফুটবল। আর যদি বলি এই চারমূর্তির নাম যথাক্রমে কার্লোস আলবার্তো, ফেলিক্স, গারসন আর পেলে; তাহলে সম্ভবত যে কোনো ফুটবল ভক্তের বুঝে ফেলার কথা এদের আরও একটা বিশেষায়িত পরিচয়। হ্যাঁ, এদের চারজনই ছিলেন ১৯৭০ এর বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের ফুটবলার। গ্যারি জেনকিন্সের ‘দা বিউটিফুল টিমঃ ইন সার্চ অফ পেলে এন্ড আদার ১৯৭০ ব্রাজিলিয়ানস’ নামের স্মৃতিচারণ বা ইতিহাস মূলক সংকলনটা আসলে ১৯৭০ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের সেই ব্রাজিল দলকে কেন্দ্র করেই লেখা।
(২)
কত বছর কেটে গেলো মাঝখানে। কিন্তু যেমনটা ১৯৫৪ এর পুসকাসের হাঙ্গেরি শেষ পর্যন্ত আশা পুরোতে না পারা এক দল, যেমন ইয়োহান ক্রুইফ ব্যর্থ হয়েছিলেন ১৯৭৪’ এ, যেমনটা ওই ব্রাজিলেরই জিকো সক্রেটিসের হতাশ করেছেন ১৯৮২’ তে, তেমন করে ফুটবলের সুন্দরতম ফুলগুলো ফুটিয়ে কাপ না জেতার হতাশায় ভুগতে হয়নি ৭০’ এর ব্রাজিলকে। ফুটবল রোমান্টিকদের স্মৃতিতে তাই আজ অ্যাতোদিন পরেও অমলিন ওই দলটি।
কিন্তু সহজ ছিলো না অমন সর্বজয়ী দলটি গড়া। বরং জেনকিন্স জানাচ্ছেন, ১৯৬৬ এর পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়েই ব্রাজিল প্রস্তুত হয়েছে পরের চার বছর ধরে। মনে রাখা দরকার, ইউরোপিয় শক্তিনির্ভর ফুটবল ঘরানার কাছে গোহারা হেরে ব্রাজিল বিদায় নিয়েছিলো ১৯৬৬’এর বিশ্বকাপ থেকে, কিন্তু তবুও তারা জেতার জন্য লাতিন ফুটবলের ছলাকলা বিসর্জন দিতে রাজি হয়নি ১৯৭০’এ।
১৯৭০ এর অনন্য সাধারণ সেই দলটার বিশ্বকাপজয়ী কোচ হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন কে? মারিও জাগালো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দলটার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন হোয়াও সালদানহা। সেই কোচ, তিন বছর ধরে একটা স্কোয়াড গড়ার পরে যিনি চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবে ঘুরতে গেলেন ইউরোপ, আর বিশ্বকাপের মাস ছয়েক আগে দেশে ফিরে জানালেন যে ইউরোপের ছকে বাঁধা গা-জোয়ারি ফুটবলের বিপরীতে দাঁড়াতে হলে ডিফেন্স আরো শক্ত করতে হবে ব্রাজিলকে, আর দলে যোগ করতে হবে আরও লম্বাচওড়া সব খেলোয়াড়।
সালদানহার পাগলামির সেখানেই শেষ নয়। ডানপন্থী স্বৈরশাসক জেনারেল মেদিচি ১৯৭০’এ মাত্র এসেছেন ক্ষমতায়, সেই জেনারেলের পছন্দের খেলোয়াড় দারিওকে উপেক্ষা করে ক্যানো তিনি দল নামিয়েছেন; এক সাংবাদিকের কাছে সেই প্রশ্ন শুনে সালদানদা চোখ গরম করে উত্তর দিয়েছিলেনঃ
জেনারেল কীভাবে ক্যাবিনেট সাজান, সেটা কি আমি ঠিক করে দেই?
তবে সম্ভবত বিশ্বকাপের ঠিক আগে এক গা গরমের ম্যাচে এমনকি পেলেকেও স্কোয়াড থেকে বাদ দেবার হুমকি দেয়াটা সালদানহার জন্যেও বড় বেশি ক্ষ্যাপামি হয়ে গেছিলো। তার জায়গায় তখন আনা হয় শান্তশিষ্ট মারিও জাগালোকে, ইতোমধ্যেই খেলোয়াড় হিসেবে যার বিশ্বকাপ জেতা হয়েছে দুইবার।
এবার যেন দলটা আবার গুছিয়ে উঠতে লাগলো দ্রুত। পেলে, গারসন, জোয়ারজিনহো আর রিভেলিনোকে কেন্দ্র করে প্রস্তুত করা হলো কর্ম পরিকল্পনা। আর রক্ষণভাগ সামলানোর সাথে সাথে অধিনায়কের দায়িত্বটা পড়লো কার্লোস আলবার্তোর কাঁধে; সেই কার্লোস আলবার্তো, মেক্সিকোর অ্যাজটেকা স্টেডিয়ামে ইতালিকে হারানোর পরে যেই মানুষটি জুলে রিমে ট্রফিকে শেষবারের মতো উঁচিয়ে ধরেছিলেন বিশ্বমঞ্চে।
(৩)
ট্যাক্টিকাল ফুটবলের চূড়ান্ত সৌন্দর্য্যের এক ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জেতা ছাড়াও, ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে ব্রাজিল জিতেছিলো চেকোস্লোভাকিয়া আর রুমানিয়ার বিপক্ষেও। এরপর কোয়ার্টারে পেরু আর সেমিতে পুরোনো শত্রু, ১৯৫০’এ মারাকানাকে স্তব্ধ করে দেওয়া উরুগুয়েকে হারিয়ে ব্রাজিল পৌঁছে যায় ফাইনালে, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো ইতালি। ৪-১ ব্যবধানে জেতার সাথে সাথে, ব্রাজিল সেদিন ইতিহাসে যেন সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দিয়েছিলো তাদের সুন্দরতম ফুটবলের মানটাও।
১৯৭০ এর সেই ব্রাজিলের ঘোর তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে আজীবন, গ্যারি জেনকিন্স তাই তার স্মৃতিচারণ রচনার স্বার্থে সাতাশ বছর পর ছুটে গেছেন ব্রাজিলে। সাও পাওলো থেকে রিও ডি জেনিরো, বেলো হরিজন্টে টোস্টাও’এর বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে চার্চের সেবায় ব্যস্ত ক্লোদোয়ালদোর কাছে ঘুরেছেন চরকির মতো। পেলে বা কার্লোস আলবার্তো বাদেও বইতে আছে আরো বেশ কজনের কথাও। রিভেলিনো, জেয়ারজিনহো, পিয়াজ্জা যেমন। জীবিত যতজন সদস্য সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন, গ্যারি পৌঁছে গেছেন তাদের কাছেই। আর তুলে এনেছেন ইতিহাসের মহানায়কদের জবানীতে সেই বিশেষ বিশ্বকাপের স্মৃতিগুলো।
পড়তে পড়তে তাই পাঠকের আক্ষেপ হয়, ক্যারিশমা আর ড্রিবলিং-এর যাদু দেখানোর সেইসব সোনালি দিন এখন আর ফুটবলে নেই ভেবে। হ্যাঁ, এখনো ফুটবল এক যাদুর নাম। কিন্তু যখন ছিলো না আজকের মতো অংক কষে খেলার ছক আর নিয়মের বাড়াবাড়ি, তখন কি তবে ফুটবল আরো প্রাণের খেলা ছিলো না মানুষের?
(৪)
আমাজনের মতোই রহস্যময় ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতি। বিশাল বিস্তৃত ভূগোল দেশটাকে করে তুলেছে, পৃথিবী কাঁপানো ফুটবলার তৈরির এক অনিঃশেষ কারখানা। জেনকিন্সের বইতে সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি উঠে আসে ব্রাজিলের রঙচঙে, আলোকিত, উদ্দাম ফুটবল সংস্কৃতির অনেকটাই। হালকা পাতলা ইতিহাসও আসে। বিশেষ করে গুম আর খুন দিয়ে ব্রাজিলকে তটস্থ করে রাখা জেনারেল মেদিচি ১৯৭০ এর বিশ্বকাপ বিজয়টাকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন জন অসন্তোষ ঢেকে রাখতে, তার একটা বেশ ভালো বর্ণনাই মেলে জেনকিন্সের বয়ানে; সেটুকু পড়ে বোঝা যায়, গণমাধ্যমকে স্বৈরশাসকেরা যুগে যুগে একইভাবে কাজে লাগান নিজেদের প্রোপাগান্ডা প্রচারের স্বার্থে।
এছাড়া আসে ফুটবলের ভেতরের দুর্নীতি। গরীব ঘরের ছেলে, ফুটবলে ভালো, সেটাকেই তবে পুঁজি করে এগোও; অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটি ফুটবলারের গল্পই এমন। কিন্তু সেই রাস্তা সহজ নয়। আর আধুনিক যুগে (বিশেষ করে টিভি পর্দার মাধ্যমে খেলাটা বিশ্বজুড়ে বড় একটা বাণিজ্য হয়ে ওঠায়) এখানে টাকার ছড়াছড়িও বেড়ে গেছে অনেক। ফলে খেলোয়াড়, এজেন্ট, দল, ফুটবল বোর্ড; লাতিন আমেরিকার ফুটবলের প্রতিটি পর্যায়েই টাকাপয়সা আর ক্ষমতার জন্য ক্যামন লোলুপ লড়াই চলে; গ্যারি জেনকিন্স সেটা নিচুস্বরে বলে গেছেন পাঠককে।
সব মিলিয়ে, ফুটবল সাহিত্যের কোনো অবশ্যপাঠ্য ক্লাসিক হয়তো নয়, কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবল সংস্কৃতি আর ফুটবল ইতিহাসকে জানতে একটা ভালো শুরু করাতে পারে জেনকিন্সের বইটা। সুন্দরতম ফুটবলের বিজ্ঞাপণ হয়ে থাকা ১৯৭০ এর ব্রাজিল দলকে জানার সাথে সাথে খেলাটাকে নিয়ে ব্রাজিলিয়ানরা কীভাবে ভাবে, কিংবা বিশ্বকাপের মৌসুমে ক্যামন রুপ নেয় তাদের মনোজগৎ; গ্যারি জেনকিন্সের ‘দা বিউটিফুল টিম’ শুধু সেই কারণেই পড়া যেতে পারে।
Leave a Reply