(১)
গত সপ্তায় পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবলে জিতে পাওয়া রঙ্গিন রুমালটা পকেটে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যদি দেখেন ফুটবলের মাঠে আপনার কতকালের চেনা বন্ধুর বাড়ির সবাইকে পিটিয়ে হত্যা করছে আপনারই পরিচিত সব মানুষ, ক্যামন লাগবে তখন মনের ভেতরে? অথবা আপনার বাড়ির সামনেই নেহায়েত গোবেচারা এক পথচারীর মাথা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ইট দিয়ে থেতলে দেবে যখন আপনার অনেকদিনের চেনা কেউ? আট বছর বয়েসের আপনার ক্যামন লাগবে তখন?

নিজের সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র কারণে অজস্র বাঙালি পাঠকের চেনা নাম মীজানুর রহমানের কৃষ্ণ ষোলোই নামের স্মৃতিচারণ আমাদের দাঁড় করায় এ প্রশ্নগুলোর মুখে। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনী মশিউল আলমের সম্পাদনায় ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ প্রকাশ করেছে ‘মীজানুর রহমান রচনাসমগ্র’, কমলালয়া কলকাতা আর ঢাকা পুরাণ-এর মতো আরো দুটো স্মৃতিকথার সাথে সেখানে জায়গা পেয়েছে কৃষ্ণ ষোলোই’ও।

কলকাতায় সংঘটিত মহাদাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী মীজানুরের জবানে আমরা পাই ১৯৪৬ সালের সেই আগস্ট মাসের রক্তাক্ত কয়েকটি দিনের বর্ণনা। মীজানুরের বয়স তখন আট, স্কুলের খাতায় তিনি তবু লিখে রেখেছিলেন ‘গৃহযুদ্ধে আমি কী দেখিলাম’ শিরোনামের এক স্মৃতিকথা। হ্যাঁ, স্কুল পড়ুয়া মীজানুরের কাছে সেই দাঙ্গা ছিলো ভাইয়ে-ভাইয়ে গৃহযুদ্ধের মতোই। সেই লেখাকেই পরিমার্জন করে পরিণত বয়েসের মীজানুর প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে টীকা/ব্যাখ্যা সংযোজন করে লিখে ফেললেন ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ নামের যে স্মৃতিকথা, আজ আমাদের আলোচ্য সেটাই।

(২)
উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিবরণ যখনই পড়ি কোথাও, কিংবা যখন ১৯৪৭ এর প্রসঙ্গে যখনই শুনি দাঙ্গা বা ওরকম কোনো সহিংসতার কথা, তখনই ‘আহা, আগে তো আমরা হিন্দু মুসলমান চিরকাল হাতে হাত ধরে বসবাস করতাম, অথচ কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেলো!’ ঘরানার একটা বয়ান আমাদের পড়তে হয়। অথচ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নানা লক্ষণ যে আমাদের চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়, স্মৃতিচারণকারীরা সেটা প্রায়ই অগ্রাহ্য করেন।

সাতচল্লিশের অভিজ্ঞতা আট বছরের মীজানুরকে সারাটা জীবনই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, ফলে পরিণত বয়েসে স্মৃতিকথা লিখতে বসে তিনি ওই ভুলটা করেননি। সুনীতি, গগণ, অজিত, আবদুল, লেনিন সকলকে সাথে করে হেয়ার স্কুল আর প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে গলায় গলায় ভাবের কথা তিনি বলেছেন ঠিকই; কিন্তু সাথে সাথে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন যে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে ঘোষণার পরেই কীভাবে যেন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছিলো দিকে দিকে। মীজানুরের আবাস গড়পার এলাকার স্থানীয় আখড়াতেও শুরু হলো যে শিবাজী ভজন, সে ব্যাপারটা তখনই তার মনে ক্যামন কুডাক দিয়েছিলো। লঙ্গরখানাগুলোতে নিজ সম্প্রদায়ের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য অসহায়, পরিচয়-না-জানা-শিশুগুলোকে কেউ কেউ যে নাম বদলে রেজিস্ট্রি করাতেন, এ জাতীয় ব্যাপারগুলোও মীজানুর তাই উল্লেখ করেছেন আমাদের চারপাশে ঘুমিয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতার নিদর্শন হিসেবে।

মুসলিম লীগ ক্যানো ঘোষণা করেছিলো প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস? জওহরলাল নেহেরুর ১০ জুলাইয়ের বিবৃতিটাকেই কারণ বলে মনে করেন মীজানুরঃ

কংগ্রেস কেবল গণপরিষদে যোগ দিতে রাজি হয়েছে এবং নিজেদের অভিরুচি অনুযায়ী ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে পরিবর্তন বা রদবদলের ক্ষমতা তার আছে।

নেহরুর এই বিবৃতিতে পাল্টা বাণী ছাড়েন জিন্নাহ’ওঃ 

কংগ্রেস সভাপতি ঘোষণা করছেন যে গণপরিষদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনায় বদল আনবে। এর অর্থ, সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের কৃপার পাত্রে পরিণত হবে।

মীজানুর তাই জুলাই মাস থেকেই দেখতে পান, যে তার চারপাশের পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে। যতই মুসলিম লীগের আহুত দিবসটা থাকুক ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিরোধটা ক্যানো যেন হিন্দু মুসলমানেই গড়াতে থাকে, এগিয়ে আসতে থাকে ১৬ আগস্ট।

(৩)
১৬ তারিখের ভোর সাড়ে ছয়টাতেই একদম গা থমথমে নীরব এক কলকাতার রাস্তায় পা রাখলেন মীজানুর। কৌতূহলে বা দাঙ্গা করতে নয়, মানিকতলা থেকে পত্রিকা নিয়ে আসতে। ঘটনার সাথে এভাবে প্রথম প্রহরেই জড়িয়ে পড়লেন তিনি।

বড় রাস্তায় ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে দাঙ্গা। কীভাবে? না, এক গোয়ালা দুধ বিক্রি করতে আসছিলো, তো মুসলিম পিকেটাররা তাকে জোর বকেছে হরতাল পালন করে ঘরে ফিরে যেতে, আর তর্কের এক পর্যায়ে দিয়েছে মার। শ্রেণিদ্বন্দ্বে যত অছ্যুতই হক না ক্যানো ওই গোয়ালা, ব্যাপারটাকে সাম্প্রদায়িক ভাবেই দেখেছে এলাকার হিন্দুরা এবং শুরু করেছে মুসলমান পিকেটারদের উদ্দেশ্যে ঢিল মারা। পাদটীকায় বিভিন্ন সূত্র দিয়ে মীজানুর উল্লেখ করেছেন, যে মানিকতলার এই সামান্য ঘটনা থেকেই কলকাতার মূল দাঙ্গা শুরু হওয়াটা সম্ভব।

119062381_800158554086621_263425212245669376_n-1

কিন্তু সে গল্প পরের, এখন বালক মীজানুর ভিড়ের সাথে মিশে এগিয়ে চলেন, আশপাশের হিন্দু বাড়ির ছাদগুলো থেকে চলতে থাকে মুসলিম পিকেটারদের উদ্দেশ্যে অবিরাম ইট বর্ষণ। জবাবে মুসলমানেরা কখনো ভাঙে রাস্তায় পার্ক করা হিন্দু লোকের ফোর্ড গাড়ি, কিংবা লুট করে মিষ্টির দোকান। জনতার স্রোতে এগোতে এগোতে মীজানুর নিজেও পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান।

বাড়ি ফিরেও তার মন উচাটন। রাস্তায় সে দেখে এসেছে গড়ের মাঠে বিকালে ভাষণ দেবে মুসলিম লীগের নেতারা, বালক মীজানুর সেখানেও যেতে চায়। কিন্তু বাসায় বড় কেউ নেই, বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায়। এমন সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় তার চেনা রঙওয়ালার হাতে দেহাতি এক মুসলিমকে খুন হতে দেখেন মীজানুর।

সেই শুরু, পরের কয়েকদিনে এমন আরো অনেক হত্যা-দৃশ্য দেখতে হবে তাকে এবং ইতিহাসের পাঠককে।

দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চাচার সাথে বেরিয়ে পড়েন দুই ভাই। পথে মীজানুর দেখেন তার হিন্দু সহপাঠীর ঠাকুরমাকে খুন হতে, দেখেন যে কংগ্রেসের এক মুসলিম নেতা জনতার ক্রোধের শিকার হতে। এমন বহু ভয়ানক দৃশ্য দেখে শেষে গড়ের মাঠে সোহরাওয়ার্দীর বক্তৃতা শুনে কাছেই একটা হাসপাতালে ভর্তি থাকা বাবাকে দেখতে গিয়ে আটকা পড়েন মীজানুররা, পরের কয়েকটা দিন তাদের কাটাতে হয় সেখানেই।

পুরো ১৬ই আগস্টের দিনে দাঙ্গা প্রতিরোধে পুলিশের কোনো ভূমিকা দেখেননি মীজানুর। বেশ কিছুদিন পরে দুপক্ষের সংঘর্ষ থিতিয়ে এলে গুর্খা সেনা নামানো হয়েছিলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।

দাঙ্গায় জড়িতদের সম্পর্কে বেশ কৌতূহলজনক একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন মীজানুর। হিন্দুদের মাঝে যারা সক্রিয়ভাবে এসব সহিংসতায় অংশ নিয়েছেন, তাদের মাঝে স্তর আর বর্ণের বিশেষ ভেদ বিশেষ দেখেননি তিনি। মুদ্দাফরাস থেকে উচ্চবিত্ত/মধ্যবিত্ত, সকলকেই আক্রমণকারী কিংবা তাদের সহায়কের ভূমিকায় দেখা গেছে। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষেত্রে তিনি দাঙ্গা করতে দেখেছেন কলকাতার নিচুশ্রেণির খোট্টা ও কুট্টিদের। ভদ্রলোক তো বটেই, একটিমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালি কোনো মুসলমানকেও দাঙ্গায় অংশ নিতে দেখা যায়নি (মানে, মীজানুর দেখেননি)। যারা দাঙ্গা করেছে, তারা মূলত বিহার থেকে আগত দেহাতি মুসলমান। মূলত এরা সমাজের নিম্নবিত্ত অংশ, পেশায় কসাই, নাপিত, রিকশাচালক, মুটে। মধ্যবিত্ত বাঙালির চাইতে কলকাতায় বস্তিবাসী এসব মুসলমানের সংখ্যাই বেশি ছিলো বলে ভোট বিবেচনায় সোহরাওয়ার্দী এদের দিকেই অধিক মনোযোগ দিতেন। তিনিই যে এদের একটু ক্ষেপিয়ে দিয়ে থাকবেন, তেমন একটা সুরও আছে মীজানুরের বয়ানে।

(৪)
ভীষণ নৃশংস সে কয়েকটি দিনের কথা বিস্তারিত জানাবো না আর।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, হাসপাতালে যে কয়েকটি দিন আটক ছিলেন মীজানুরেরা, দেখেছেন প্রতিদিন লরি বোঝাই হয়ে এসেছে বহু লাশ। আক্রান্ত হয়েছে সব ধর্মের মানুষই। রক্ত আর নৃশংসতাতে তাদের চোখ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সেই কদিনে। জুবিলি স্কুলে মুসলমান ছাত্রদের পোড়ানোর জন্য ছাত্রাবাসে আগুন লাগাতে দেখে, কিংবা চোখের সামনেই কোনো হিন্দু বাবুকে খুন হতে দেখেও তাদের আর অবাক লাগেনি তখন।

কৃষ্ণ ষোলোই, এভাবেই বের করে এনেছে মানুষের ভেতরের কালোটা।

কিন্তু অন্যায় হবে মুদ্রার অপর পিঠের গল্পটা না বললেও। তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে যখন মীজানুরেরা ফিরে আসেন, জানতে পারেন তার মা’কে আগ্রাসী রায়টকারীদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন নিচতলার বিষ্টুকাকা। এভাবে রুখে দাঁড়ানোর মূল্যও সেই মানুষটিকে দিতে হয় পরে, নেড়েদের বাঁচানোর অপরাধে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়া হিন্দু গুণ্ডারা- প্রতিশোধ নিতেই কি না কে জানে- বিষ্টুবাবুর ছেলেকে ঘরে আটকে আগুনে পুড়িয়ে মারে পরে।

(৫)
পরের কয়েক মাসে রিলিফ ফান্ডের জন্য অর্থসংগ্রহ, কিংবা আক্রান্তদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মত ব্যক্তিগত তৎপরতার কথা জানিয়েছেন মীজানুর। কিন্তু সে বয়েসেই তিনি অনুধাবন করেন যে সুর কোথাও কেটে গেছে, স্কুল খোলার পরে তাই হিন্দু সহপাঠীরা এবার আর একত্রে বসতে চায় না মুসলমান ছেলেদের। সেনা নামলেও প্রতিটি পাড়ার ভেতরে ভেতরে চোরাগোপ্তা হামলা আরো অনেকদিনই চলে।

বাবা সুস্থ হবার পরে মীজানুরেরা নতুন এলাকায় বাসা বদলান। এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশভাগের দিনে তারা সপরিবারে ত্যাগ করেন কলকাতা। মুসলিমরা সেদিন খুব কোলাকুলি করেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথেও, কিন্তু একটা কী যেন বিষাদ তাদের ঘিরে রেখেছিলো ঠিকই। মুসলিম লীগের নেতারা কলকাতা পায়নি, তবে এত রক্ত ক্যানো ঝরলো?

বাড়ি ছাড়ার প্রাক্কালে বাড়ির দেয়ালে (যে বাড়িটি পরে কিনে নেবেন টেনিদা স্রষ্টা নারায়ণ গাঙ্গুলী) মীজানুর কেবল লিখতে পারেন, বিদায় কলকাতা!

কিন্তু,  বোঝে ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ এর পাঠক মাত্রই, শৈশবের মতোই, কলকাতাকে কখনোই মন থেকে বিদায় জানানো হয়নি সেই ছেলেটির।

[০২ আগস্ট, ২০২০]