(১)
লেখকদের সাক্ষাৎকার, সাহিত্য আলোচনা বা দুনিয়ার কোন প্রান্তে কী চলছে বইয়ের জগতে, সেটা জানতে প্রায়ই অন্তর্জালে ঘোরাঘুরি করি। The New York Review Of Books আর Paris Review, খরচাপাতি করে এ দুই পত্রিকার গ্রাহকও হয়েছি এক সুহৃদের সাথে ভাগাভাগিতে। বর্ণিত দুটো ওয়েবসাইটের কাজের ধরনটা একই রকম। এদের বহু লেখা পাঠকের জন্য উন্মুক্ত; কিন্তু একটু বেশি ভালো, ওজনদার আর দরকারি যে লেখাগুলো, সেগুলো পড়তে হলে পয়সা লাগে।
অন্তর্জালে লেখালেখির আরো একটা ধরন আছে, যেটা করে The Guardian বা Literary Hub-এর মতো ওয়েবসাইটগুলো। এদের সমস্ত লেখাই উন্মুক্ত। জ্ঞান/তথ্যের কোনো সীমানা টানা অনুচিত বিবেচনা করেই এই ওয়েবসাইটগুলো নিজেদের লেখা সকলের কাছে উন্মুক্ত রাখছে; বিনিময়ে তারা নিচ্ছে পাঠকের কাছ থেকে স্বেচ্ছা অনুদান, বা প্রণোদনা।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক শেষে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে লেখকদের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট থাকার চর্চাটা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে, তবে বাংলাদেশে এখনো এই অভ্যাসটার তেমন চল নেই। পত্রিকা আর বিবিধ ওয়েবপোর্টালে নিয়মিত লেখা দিতে হয় বলে, লেখকের জন্য এখানে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট চালানোটা দুরুহও খুব। তবু বছর দুয়েকের কিছু বেশি সময় ধরে, আমার ব্যক্তিগত এই সাইটে আমি চেষ্টা করছি দেশ বিদেশের বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা করতে, ভিনদেশি প্রবন্ধ/সাক্ষাৎকারের বঙ্গানুবাদ করতে, কিংবা আলাপ করতে পছন্দের সিনেমা বা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে।
উপন্যাস লেখার দীর্ঘ যাত্রার ফাঁকে এই ধরনের লেখাগুলো আমি নিয়মিতই লিখি। কখনো ভাবনা গুছিয়ে রাখতে, কখনো কোনো বিষয়ে নিজের ভালোলাগা অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে।
যখনই লিখেছি, চেষ্টা করেছি নিজের সামর্থ্যের পুরোটাই দিতে। অনলাইনের অধিকাংশ লেখা স্বতঃস্ফূর্ত বলেই বহু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে। চেষ্টা করেছি, আজও করি, সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে লিখিত আলোচনা/বক্তব্যটাকে কিছুদিনের জন্য প্রাসঙ্গিক রাখতে। নিজস্ব সাইটের ফলে যা সুবিধা হয়েছে; ফেসবুক, ব্লগ বা অন্যত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে না লিখে, আমার লেখাগুলোকে নির্দিষ্ট একটা আশ্রয় দেয়া গেছে। ইতোমধ্যে প্রায় সত্তরটার মতো লেখা জমেছে সেখানে, টুকটাক আরো অনেক লেখা পড়ে আছে সম্পাদনার জন্যেও। আড়াই বছর ধরে আমি কেবল এখানেই লিখছি, সম্ভব হলে লিখতাম আরো আড়াইশো বছর।
(২)
কিন্তু এসব নানা স্বাদের বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখককে বিনিয়োগ করতে হয়েছে যথেষ্ট সময় আর শ্রম। ভিনদেশি বহু লেখকই (বা ইউটিউবার কিংবা ভ্লগাররা’ও) নিজ নিজ ওয়েবসাইটে Support Me বা Buy Me A Coffee জাতীয় আহবান ঝুলিয়ে রাখেন, আর পাঠকেরা সেখানে প্রণোদনা দিয়ে লেখককে সাহায্য করেন লিখে যেতে। সামাজিক প্রথার ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশে এই রীতি এখনো প্রচলিত নয় ঠিকই, কিন্তু যে পথে সবাই হাঁটেন, সেখানে কি ফুল ফোটে?
লেখকদের কাছ থেকে ভালো কিছু পাবার স্বার্থেই তাই তাদের দিকে পাঠকের হাত বাড়ানোটা দরকার বলে বোধ করি। দিনের পর দিন স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে চালিয়ে যাওয়া লিটলম্যাগগুলো, আর বহু সম্ভাবনাময় লেখকের লেখালেখির যে ইতি ঘটে গেছে দেশে; সেটার কারণও বোধ করি লেখকের সাথে পাঠকের ওই প্রণোদনার মেলবন্ধন না ঘটা।
সৌভাগ্যক্রমে, অন্তর্জাল আমাদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে কোনো মধ্যবর্তী মাধ্যম ছাড়াই লেখক আর পাঠকের মাঝে সংযোগ স্থাপনের। বিশেষ করে জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে বিগত কয়েক মাসে মহামারির কারণে অন্তর্জালে যে নতুন ধরনের মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়েছে, সেটা মাথায় রাখলে Support Me বা Buy Me A Coffee ঘরানার ওই বৈশ্বিক চর্চাটি বাংলাদেশের চালু করার এটাই সঠিক সময় বলে মনে করি। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, বিষয়ভিত্তিক লেখালেখি, কিংবা শিক্ষামূলক লেখা কি দৃশ্য-শ্রাব্য নিয়েও যারা অন্তর্জালে প্রচুর সময় দিচ্ছেন; নিশ্চিত, প্রণোদনার এই সংস্কৃতি চালু হলে তারা কাজ করবেন আরেকটু উদ্দীপনা নিয়ে। বাংলা অন্তর্জালের সুপরিচিত ক্রীড়াভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম প্যাভিলিয়ন‘ও যে সম্প্রতি পাঠকের কাছ থেকে স্বেচ্ছা-প্রণোদনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সময়োপযোগী উদ্যোগকে এখানে তাই একটু স্বাগত জানানোই যায়।
এ সমস্ত বিবেচনায়, আর কিছু ফেসবুক গ্রুপে সমমনাদের সাথে আলোচনার সাপেক্ষে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে ইচ্ছুক পাঠকের কাছ থেকে প্রণোদনা গ্রহণের। অর্থাৎ, সাইটের কোনো লেখা যদি আনন্দ দেয় পাঠককে, কিংবা তার উপকারে আসে; তবে চাইলে তিনি প্রণোদনা দিতে পারবেন লেখককে।
আপাতত দেশি পাঠকদের জন্য বিকাশ এবং প্রবাসী পাঠকদের জন্য পেপ্যাল মাধ্যমে এই প্রণোদনা গ্রহণ করা হবে।
(৩)
ধারণা করি, আমার লেখা যারা পড়েন, তাদের একটা বড় অংশই বয়েসে তরুণ। আগ্রহী এই পাঠকদের পড়ার আনন্দ যাতে বিনষ্ট না হয়, সে জন্য আবার নিশ্চিত করি, সম্পূর্ণ উদ্যোগটিই হতে যাচ্ছে স্বেচ্ছা-প্রণোদনার ভিত্তিতে। কোনো ধরনের বিজ্ঞাপণের উৎপাত ছাড়াই প্রকাশিত সমস্ত লেখা থাকবে পাঠকের জন্য উন্মুক্ত। পূর্বের লেখাগুলো ছাড়াও প্রতিবছর নিয়মিত নতুন সব লেখা যুক্ত হতে থাকবে এই সাইটে।
আগ্রহী পাঠক যে কোনো আকারের এককালীন প্রণোদনা দিতে পারেনঃ
(ক) বিকাশের মাধ্যমেঃ 01757 357794 (Personal) নম্বরে
অথবা
(খ) পেপ্যালের মাধ্যমেঃ এই লিঙ্কে গিয়ে, অথবা সাইটের ডানদিকের কলামের উপরে Buy Me A Coffee বোতামে ক্লিক করে
ওয়েবসাইটে নতুন কোনো লেখা প্রকাশিত হলে জানিয়ে দেয়া হবে আমার ফেসবুক পেইজ (Shuhan Rizwan : Writings) -এ। আগ্রহীদের কাছে তাই অনুরোধ থাকবে লেখালেখি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যের জন্যে সেই পেজটি অনুসরণ করার।
(৪)
বুলগেরিয়ান ব্লগার মারিয়া পোপোভা প্রায় ১৩ বছর ধরে লিখছেন তার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে, সেই Brainpickings এখন আন্তর্জালের পাঠকদের কাছে সুপরিচিত এক নাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি, কাছাকাছি সময়ে বাংলা আন্তর্জালে টুকটাক লেখা শুরু করেছিলাম আমিও। এবং এখনও যে লিখে যেতে পারছি, এবং কিছু মানুষ পড়ছেন সেই সব অক্ষরকে, সেটাকেই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে মানি।
ভাষার রাজনীতিগত কারণে হয়তো আন্তর্জালের জগতে আমাদের বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিক করে তোলাটা দুরুহ, কিন্তু সাহিত্য তো সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক হয়ে ওঠে তখনই, যখন কেউ নিজের কথাটা বলতে পারে নিজের স্বরে আর ভাষায়। আর আন্তর্জাল যেহেতু প্রযুক্তিগত সুবিধা দিচ্ছে ইদানিং, বোধ করি, দুনিয়া জুড়ে নিজের কথাটা বলে ফেলা আজ হয়ে উঠেছে আরো সহজ।
আমি আশা করবো, বাংলাভাষী আরো লেখক- যারা সত্যিই লেখাকে নিয়েছেন আপন করে- এগিয়ে আসবেন পাঠকের সাথে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া করতে। পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ অনুসন্ধানের সেই যাত্রায়, বাস্তবতার উঁচু ঢেউ সামলাতে সঙ্গী হিসেবে লেখক, আশা করবো, পাশে পেয়ে যাবেন কিছু আগ্রহী পাঠককেও।
[সেপ্টেম্বর, ২০২০]
J
“যে পথে সবাই হাঁটেন, সেখানে কি ফুল ফোটে?”
চমৎকার।
আর যে পথে ফুল ফোটে সেই পথ কিন্তু খুব দুর্গম। লেখককে কেউ লিখতে বলেনা, তারপরও লেখক লিখতে বাধ্য, নিজের কাছে। জীবনের এই দুর্গম পথে আপনি উদ্যমী থাকুন এই শুভকামনা রইল।
জে
সুহান রিজওয়ান
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য 🙂