( প্যারিসের বুকে প্রিয় লেখকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘোরার গল্পের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব। প্রথম পর্বটা পড়া যাবে এইখানে।)
আরো খানিক পরে আমাদের পরিচিত পর্যটককে দেখা যায় তার ছোট্ট সবুজাভ ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে লুক্সেমবার্গ উদ্যান থেকে বেরিয়ে সিন নদীর দিকে হাঁটা দিতে। বিকেলের আলোতে রাস্তায় এখন লোকজন বেড়েছে, তার মাঝে অধিকাংশকেই ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি বলে বোধ হয়। ফলে হাঁটতে সুহানের চমৎকার লাগে। একটু কল্পনা করলে নিজেকে সে এমনকি আবিষ্কার করতে পারে ১৯৬৮ এর মে মাসে, ছাত্রজনতার সাথে পথে নেমে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে সে সরকারের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে, তেমন খোয়াবটিও বেশ করে মন্থন করা হয় খানিক। তবে এই কল্পনা প্রবণতার ফলটা সুহান হাতেনাতে পায়। একটা তিন রাস্তার মাথায় এসে সে ভুল পথে খানিক দূরে চলে যায় গন্তব্য হতে, সন্দেহ হওয়ায় তাকে পুনরায় ঠিক লাইনে ফিরতে হয় সেই গুগল ম্যাপ দেখেই।
আরো একটা জিনিস তার চোখে পড়ে তখন, রাস্তার নামটা। সাঁ মিশেল বুলেভার্দ। গ্যাবো মার্কেজ কি এখানেই জীবনে প্রথম আর শেষবারের মতো দেখেছিলেন না আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে? ষাটের দশকের শেষ দিকে বৃষ্টিভেজা সেই বসন্ত দিনে, সুহান পড়েছে, হেমিংওয়ের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো অল্প দূরের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অজস্র ছাত্র, ঠিক আজকের মতোই। আচ্ছা, মার্সেল ব্যাটাও কি এই সরবোনেরই ছাত্র নাকি? ইশ, গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটা ছোকরাকে জিজ্ঞেস করা হলো না! ঈর্ষার সাথে সাথে পর্যটকের একটু আক্ষেপও লাগে।
তবে আক্ষেপটা বেশি জমতে পারে না। কারণ আর কিছু নয়, সুহানের চোখ এবার চলে গেছে রাস্তার বামদিকে দাঁড়িয়ে থাকা গিলবার্ট জোসেফ নামের বইয়ের দোকানটার দিকে। তিনতলা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বই বিপণীটাকে শুধু বিশালত্বের কারণেই গ্রাহ্য করতে হয়। সাথে যোগ হয়েছে ছাড়ের বিজ্ঞাপণ। দোকানের সামনে, ফুটপাথের ওপরে ছাড় দেয়া বইগুলো বিছিয়ে রাখা হয়েছে কয়েকটা টেবিল জুড়ে। কৈশোরের একটা বড় অংশ নীলক্ষেতের দোকানে পুরোনো বই অনুসন্ধানের স্মৃতির ধাক্কায় সুহান তাই নিজের অজান্তেই টেবিলগুলোয় ঝুঁকে পড়ে সস্তায় কোনো রত্ন খুঁজে পাবার আশা নিয়ে।
কিন্তু নাহ, তেমন কিছু পাওয়া যায় না টেবিলের ওপর। সে কি একবার দোকানটায় ঢুঁ মেরে দেখবে? খানিক ভেবে সুহান এবার গিলবার্ট জোসেফের ভেতরেই ঢুকে যায়।
তিনতলা দোকান। নিচতলায় জায়গা বেশি নয়। যা আছে, তার অনেকটাই আবার খেয়ে নিয়েছে গানের ভিনাইল রেকর্ডের স্তূপ। এ কি দোকানের স্থায়ী বিন্যাস, না সাময়িক? কে জানে! মাথা না ঘামিয়ে সুহান উঠে যায় দোতলায়। এখানে বইয়ের পরিমাণ ভালোই। তবে অধিকাংশই নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যসূচীর মন যোগাতে বলে মনে হলো। কোনটাই ইংরেজি ভাষায় নয়, কিন্তু দেখে বেশ বোঝা যায় যে ব্যবসায় শিক্ষা কি বিজ্ঞান শেখানোর বই। জিজ্ঞাসা করে জানা যায় যে সাহিত্যকে এরা মাথায় তুলে রেখেছে, মানে তিন তলায়। কিন্তু সেখানে গিয়েও কি খুব লাভ হয়? নাহ, ইংরেজি অনুবাদের তাকের সংগ্রহ খুব আকর্ষণীয় লাগে না। পল অস্টারের নিউইয়র্ক ট্রিলোজির একটা কমদামী সংস্করণ ভালো লাগে, তবে সেটাকে ঠিক কেনার মতো পছন্দ সুহান করে উঠতে পারে না। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বিক্রয়কর্মীটির দিকে সে তখন প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে, প্যাট্রিক মোদিয়ানো বা মিশেল উয়েলবেকের উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ নেই?
মেয়েটি বেশ বিব্রত হয়ে পড়ে এ জিজ্ঞাসায়। হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাবার পর মিনিট কয়েক পর সে পুনরায় উদয় হয়। পালটা প্রশ্নে সে এবার জানায় যে ঠিক এ মুহুর্তে তাদের সংগ্রহে তেমন কিছু নেই বটে, তবে চাইলে তারা দুয়েকদিনের মাঝেই বইগুলো আনিয়ে নিতে পারবে, মঁশিয়ে কি অমন কিছু চান?
নাহ, রোদে পোড়া পর্যটকের তেমন ইচ্ছা নেই। মেয়েটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুহান তাই পুনরায় তিনতলা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে নেমে আসে রাস্তায়, বাইরে এখন বিকেল পাঁচটা পেরোনো মিষ্টি রোদ। চিরকালের মতোই কানে ইয়ারফোন গুঁজে, কিংবা বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে দিতে, কিংবা নিঃসঙ্গ ভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে মানুষ। তাদের দেখতে দেখতে সুহানের পদচারণাও আস্তে আস্তে গতি পায়। গিলবার্ট জোসেফে অপরিকল্পিত হানা দেয়ার পরে তার এবারের পরিকল্পিত গন্তব্যও একটা বইয়ের দোকান। সত্যি বলতে, সেই দোকানটা সম্ভবত গত অর্ধ শতাব্দীতে হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বই বিপণী। দূরত্বটাও খুব বেশি নয় এখান থেকে, এই সাঁ মিশেল বুলেভার্দ যেখানে থেমে গেছে সাঁ মিশেল সেতুর সাথে, তার ডানদিকে গজ পঞ্চাশেক গেলেই দেখা যায় দোকানটা, শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি।
অথচ সাঁ মিশেল সেতুর সামনে এসে সিন নদীর ওপারে নটরডেম গির্জা এবং এপাশের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো দেখে সুহানের ইচ্ছেটা আবার পালটায়। বিকালের অর্ধেকটাই বাকি এখনো, শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি’তে এখনই না গেলেও তো চলে। সিন নদীর পারের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো একটু দেখে নটরডেমের সামনে বসে খানিক হাওয়া খেলে কি আর খুব ক্ষতি হবে? নাহ, অমন কোনো লোকসানের পরিসংখ্যান সুহানের অজানা। ফলে সিন নদীর পারের সুবিখ্যাত পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোর সামনে খানিক পরেই পদচারণা করতে দেখা যায় ছোট্ট সবুজাভ ব্যাগ কাঁধে ঝোলানো জনৈক পর্যটককে, কম দামে ভালো কিছু পাবার আশায় লোকটা এক ধার থেকে বই দেখে বেড়ায়।
প্রায় চারশো বছর ধরে রাস্তাপাশের এই বই কেনার দোকানগুলো হয়ে উঠেছে প্যারিসবাসী ও ট্যুরিস্টদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় স্থান। এক কালে সব ধরনের বই-পত্রিকার প্রাপ্তিস্থান হলেও সময়ের সাথে সাথে এখন দোকানগুলো মূলত পুরোনো বই নিয়েই আছে। সিন নদীর উভয় পাশে সবুজ রঙের বাক্সে পুরোনো বই, ম্যাগাজিন, পোস্টার, মানচিত্রের সাথে বেশ কিছু হাতে বানানো স্যুভেনির সাজিয়ে নিয়মিতই বসে থাকে দোকান মালিকেরা।
আমাদের পর্যটক অবশ্য মিনিট বিশেক সময় কাটিয়েও কেনার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। প্রায় সমস্ত সেকেন্ডহ্যান্ড বই এখানে ফরাসী ভাষার, ওই রসে বঞ্চিত বলে সুহানের পক্ষে কিছু বাছাই করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিছু পোস্টার দেখে তার লোভ হচ্ছিলো, কিন্তু সেগুলোর আকার আর নেবার ঝক্কি বিবেচনায় নিতেই ইচ্ছেটা উবে যায়। চোখ কাড়ে যে কাউকে হাতছানি দেয়ার মতো রঙচঙে ম্যাগাজিনগুলো। এদের প্রচ্ছদগুলোয় কী আছে? অড্রে হেপবার্ন থেকে ম্যারিয়ন কোটিলার্ড, কি আলবেয়ার কাম্যু থেকে এডওয়ার্ড স্নোডেনেরা। এদের বাইরে দোকানগুলোয় আর কারা আছে? বিবিধ পোস্টার আর প্রচ্ছদে চেনা যায় টিনটিন আর লিটল প্রিন্সকে। তাদের কাউকেই নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দ না পেয়ে সুহান তাই সাঙ্গ করে পুরোনো বইয়ের দোকান দেখার পালা। পোঁ সাঁ মিশেল নামের ছোট্ট সেতুটার যে প্রান্তে নটরডেমের সুবিখ্যাত গির্জা, সেদিকটায় গিয়ে সে একটা বসবার জায়গা খুঁজে বের করে তারপর। সুহান তখন ক্যাথেড্রাল চত্বরটাও দ্যাখে, আবার সেতুর অন্যপ্রান্তেও চোখ বুলায়।
সিন নদীর মাঝে ছোট একটা দ্বীপের মতো অংশ, দু দিকেই সেটা সেতু দিয়ে যুক্ত মূল প্যারিসের সাথে, তার মাঝে স্যুটপ্যান্ট ছাড়াই গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিংবদন্তীর নটরডেম গির্জা। গত সন্ধ্যাটাও সুহান কাটিয়েছিলো নটরডেম চত্বরেই, খানিক সময় কাটিয়ে তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলো প্যান্থিয়নের দিকে। প্রথম দেখার রোমাঞ্চ নেই, ফলে আজকে পরিচিত জায়গাটার চারপাশ দেখা যায় মনোযোগ দিয়ে। তবে চারপাশে লোকের ভিড়ে খানিক সতর্ক থাকতে হয়। নাহ, ভিক্টর হুগোর উপন্যাসের সেই কুঁজো কোয়াসিমোদোর ভয়ে নয়, আধুনিক প্যারিসের পর্যটক অধ্যুষিত জায়গাগুলোয় রাজত্ব করা টাউট বাটপারের ভয়ে।
লোক সমাগম বেশি বলেই প্রচুর স্ট্রিট আর্টিস্ট (বাংলায় বোধহয় এদের পথশিল্পীই বলা যায়!) সমাবেশ গঠন করে বেড়াচ্ছে চারদিকে। পেছন দিকে টেনে ঝুঁটি বেঁধে আধো ভাঙা গলায় অপরিচিত এক ভাষায় চমৎকার সব গান গায় জনৈক প্রায়-বুড়ো-হয়ে-যাওয়া-মাঝবয়েসী। তার দুয়েকটা গান শুনে মুগ্ধ হবার ভান করে এক ছোকরা এগিয়ে গিয়ে গায়কের গিটারটি একটু চেয়ে নেয় এবং ট্যাংট্যাং বাজিয়ে নিজের বান্ধবীকে মুগ্ধ করার প্রয়াস পায়। সুহান বসে বসে তা দ্যাখে। বিষাদমাখা বেহালা বাজাচ্ছিলো এক ভিখিরির মতো জীর্ণ পোষাকের পথশিল্পী। চকচকে স্যুটের পুরুষ আর গাঢ় লাল পোষাকের নারীর একটি জোড়া তাকে অন্য একটা সুর বাজানোর অনুরোধ করে ঠিক সিনেমার মতোই নাচ শুরু করে সেই বেহালার তালে, লোকের আকর্ষণ এবং খুচরো পয়সা এরাও ভালো কামায়। সুহান এ দৃশ্যও দ্যাখে। তবে তার মূল মনোযোগ পড়ে রয় রোলার স্কেট পড়ে ছুটে আসা এক চ্যাংড়া আরবের দড়াবাজিতে। দৌড়ে এসে উঁচু লাফে একটা বাধা পেরোয় লিকলিকে ছেলেটা, প্রতিটা লাফের পরে সে একটু করে বাড়িয়ে তোলে প্রতিবন্ধকতার উচ্চতা। শেষ পর্যন্ত সেই উচ্চতা এসে দাঁড়ায় প্রায় দুই মিটারের কাছাকাছি। শক্ত পিচঢালা রাস্তায় কোনো রকম ম্যাট বিছানোর বালাই না রেখেই বব মার্লেকে মনে করানো এই দড়াবাজিকর শেষ পর্যন্ত যখন স্কেট করে এসে পেরিয়ে যায় সেই উচ্চতা, সাঁ মিশেল সেতুতে দাঁড়ানোপ্রায় প্রত্যেকটি দর্শক তখন হাততালিতে ফেটে পড়ে। শুরু হয় তার পেতে দেওয়া টুপিতে ভাঙতি পয়সার ইলশেগুঁড়ি। সুহান নিজেও খুচরো কিছু পয়সা নৈবেদ্য দেয় ওই নাম না জানা শিল্পীকে। তারপর নটরডেমের দিকে আরো একবার দৃষ্টিপাত করে সে হাঁটা দেয় শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানির দিকে।
চলতে চলতে ভাবে, ক্যানো প্যারিস হয়ে উঠেছে শিল্পীদের, ক্যানো এই শহরের প্রতি তাদের এমন ভালোবাসা? কিংবা, কোনো শহরের প্রতি মানুষের আসলে ভালোবাসা জন্মায় কখন?
পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের কাছে নিজ শহরের অর্থ তার বসতবাড়ির ঠিকানা, সেটার কিছু দোকানপাট আর রাস্তা, জীবিকা বা অন্যান্য প্রয়োজনে যেগুলোকে সে ব্যবহার করে নিত্য। তার বাইরে হয়তো শহরটা তার কাছে ধরা দেয় প্রিয়জনদের আবাস, এবং কয়েকটা ব্যক্তিগত স্মৃতি বিজড়িত স্থানের সমষ্টি হয়ে। তার বাইরে মহাকালের বুকে শহরের যে ধারাবাহিকতা, শহরের অস্তিত্বের যে খণ্ড অংশ জুড়ে থাকে প্রতিটি একাকী ব্যক্তির মাঝেও; অধিকাংশ শহরবাসী তা নিয়ে ভাবিত থাকে না কখনোই।
আধুনিক শহরের যে ধারণা, খুব বেশি পুরোনো নয় সেটার ইতিহাস। এবং খেয়াল রাখা দরকার যে আধুনিক মানুষ বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের জন্মও হয়েছে ওই শহরের জন্মের পরেই। শহর বড় হলো, অর্থনৈতিক আদল পালটে গেলো রাষ্ট্রের, তৈরি হলো অজস্র রকম মানুষ। তো নিজের জন্মের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতেই বোধহয়, সংবেদনশীল মানুষেরা, নানাভাবে নিজেদের কাজের মাঝে স্থাপন করেছে শহরকে। এবং উপন্যাসের পৃষ্ঠায়, গানের কথায় কি সিনেমার বুকে কোনো চেনা শহরকে যখন খুঁজে পায় মানুষ; নিজেকে সে তখন মহাকালের বুকে স্থাপন করতে পারে ব্যক্তিগত গন্ডীর বাইরে গিয়ে। শ্রোতা যদি ইংরেজ হয়, বিটলসের গান ‘পেনি লেইন’ শুনতে গিয়ে সে তখন আধুনিক লিভারপুলকেও আবিষ্কার করে অন্য রুপে; পাঠক যদি বাঙালি হয়, তবে ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ পড়তে গিয়ে উপলদ্ধি করে যে আজকের ঢাকা শহরে একদিন পা দাপিয়েছে তারই মতো অজস্র অনুল্লেখ্য মানুষ; এবং ছায়াছবির দর্শক, সে দুনিয়ার যে দেশের বাসিন্দাই হোক; রোম শহরে পা রেখে তার অস্তিত্ব নিজের কাছে আরো আনন্দময় হয়ে ওঠে ‘রোমান হলিডে’ সিনেমায় দেখা কোনো দৃশ্যের কথা স্মরণ করে। বেড়াতে গিয়ে বেকার স্ট্রিট কি গ্রিনউইচ ভিলেজ বিল্ডিং এর সামনে লোকে যে সেলফি তোলে তার কারণ ওই শহর বা রাস্তার মোড়ের প্রতি তার নিখাদ ভালোবাসা নয়, কারণ আসলে শার্লক হোমসের পাঠক কি ‘ফ্রেন্ডস’ সিরিয়ালের দর্শক হলে ছোট পরিসরে সে নিজের পরিচয়কে মেলাতে পারে অন্য দশটা মানুষের সাথে, আর বড় পরিসরে নিজেকে করে তুলতে পারে অমর কোনো গোয়েন্দা গল্প বা সিটকমের ঐতিহ্যবাহী পরম্পরার অংশ।
শহরের সাথে মানুষের সম্পর্ক তাই ঠিক ঠিক করে শিল্পমাধ্যম। গান, গল্প, সিনেমা।
আর প্যারিস শহরের চেয়ে বড় আশ্রয় শিল্পীদের কাছে পৃথিবী নামক গ্রহে আর কোথায়?
নিয়ম না শিল্পীদের জন্যই যেন এ শহরটা। সম্ভাষণ এখানে আবেগে ভরপুর, প্রেম এখানে প্রকাশ্য, ফূর্তি এখানে সর্বত্র আর বহুজাতিক এখানে দৈনন্দিন। খালি চোখেই দেখা যায় যে নিয়মের প্রতি ফরাসীদের অনাস্থা আশপাশের অন্য যে কোনো ইউরোপিয়ান জাতের চেয়ে বেশি। লালবাতিতেও পথচারী দিব্যি নেমে যাচ্ছে রাস্তায়, টিকেট ফাঁকি দিয়ে মেট্রো চাপছে আরবেরা, চার্চের সামনে ঝুলছে পকেটমার হতে সাবধান হবার সতর্কবাণী। উডি অ্যালেনের মিডনাইটে আইফেল টাওয়ারের নিচে চোরাই শ্যাম্পেন বেচতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারত উপমহাদেশের কেউ,পারীর এই অর্ধেকটা তো অন্নদাশঙ্করও কল্পনা করতে পারেননি। পশ্চিম ইউরোপের সাথে বেমানান ও যত্রতত্র পড়ে থাকা সিগারেটের খোসা দেখে তাই বোধ হয়, যে নিয়মের দাপটে থরথর একবিংশ শতাব্দীতেও প্যারিস আজো রয়ে গেছে অনিয়মে,ঠিক যেভাবে যুগে যুগে সে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে খেয়ালি শিল্পীদের; দালি, পিকাসো,ফকনার,হেমিংওয়ে, মার্কেজ থেকে শুরু করে সতীনাথ ভাদুড়ি বা নভেরা আহমেদ। আজও দেখা যায় এ শহর একইভাবে উন্মুক্ত হয়ে আছে মিলান কুন্ডেরা থেকে শুরু করে মোঁপার্নাসের রাস্তায় গান গেয়ে যাওয়া মেয়েটির জন্য। আজও ওসব খামখেয়ালির জন্য নটরডেম ক্যাথিড্রালের ঘন্টাবাদক কোয়াসিমোদো প্যারিসের হয়ে হাঁক দেয়, ‘অভয়াশ্রয়! অভয়াশ্রয়!’ বলে। প্যারিসকে ভালো না বেসে শিল্পীরা তাই যাবে কোথায়? শিল্পের অনুরাগীর কাছেও তাই প্যারিসের আবেদন অন্য যে কোন শহরের চাইতে বেশি…
শহর নিয়ে এলোমেলো এই ভাবনার চটকাটা কেটে যায় যখন সুহান এসে দাঁড়ায় সেই চিরচেনা দোকানের সামনে। শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি, তার আজকের জন্য নির্ধারিত শেষ দ্রষ্টব্য।
গাঢ় সবুজের মাঝে সোনালি বর্ণে দোকানের নামখানা দেখেই খানিকের জন্য তীব্র একটা আনন্দ হয় তার। এই আনন্দ নিজের অস্তিত্বকে নিজের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ করবার মিথ্যা মোহের আনন্দ; হেমিংওয়ে আর জেমস জয়েসের আনাগোণা ছিলো যেখানে, সেই বইবিপণীতে পা ফেলবার স্থূল শিশুতোষ আনন্দ। তবে, সেই শিশুটিকে থাপ্পড় মেরে দমিয়ে দিয়ে ভেতরের ইতিহাসবেত্তাটিকে বের করে আনার পর পর্যটকের মোহটা কাটে। আরে এই শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি যে হেমিংওয়ে কি জয়েসের সেই বইঘর নয়, সে কি আর সুহান জানে না? সেই দোকানের মালিকানায় তো ছিলেন সিলভিয়া বিচ, বাদামি চোখের সেই উদারমনা মহিলা, যিনি বাকিতেই বই গছিয়ে দিতেন তার নিয়মিত পাঠকদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্যারিস শহর জার্মানদের দখলে চলে যাবার পর সিলভিয়া সেই যে দোকানটা বন্ধ করলেন, এরপর যে তা আর খুললো না, এ তথ্যও তো সুহানের জানা! বর্তমানে যে বইবিপণীর সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা আসলে খোলা হয় যুদ্ধ শেষের কয়েক বছর পর। সিলভিয়ার প্রতি সম্মান জানাতেই কিছুদিন পর নাম পালটে এই দোকানটিও আত্মপ্রকাশ করে শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানি নামে। নাম ছাড়া কিংবদন্তীর সেই বইবিপণীর সাথে একালের দোকানটির কোনো সাদৃশ্য নেই।
কিন্তু দোকানের সামনে বিবিধ ভঙ্গিমায় সেলফি মারানো এই মূর্খ পর্যটকেরা কি আর অ্যাতো কিছু জানে? অধিকাংশের চেহারাতেই বরং প্রকট হয়ে থাকে ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’ কি ‘বিফোর সানসেট’ এর মতো আর্টিস্টিক ও অ্যাস্থেটিক সিনেমাগুলোর অনুকরণে অত্র দোকানে ছবি তুলে ইনস্টাগ্রামে আপলোডের তাড়াহুড়ো! কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া ভারাক্রান্ত পোস্ট-ট্রুথ জমানার যুগে এসব নিয়ে কথা বলতে খুব সাহস থাকা দরকার, সেটার অভাবে সুহান তাই দ্রুত ঢুঁকে পড়ে দোকানের ভেতরটায়।
কাঠের দোকান, ভেতরে পা দিলে মচমচিয়ে শব্দ হয় কোনো কোনো জায়গায়। ছোট জায়গাটির ভেতরেও ছোটো ছোটো খোপের মতো করে তিন-চারটা কামরা বানিয়ে রাখা। দোকানের সংগ্রহ ভালো, সাথে অধিকাংশ বই ইংরেজি ভাষার বলে সুহানের ভালো লাগাটা বেড়েই চলে। একমাত্র সমস্যা হলো মানুষের আধিক্য। দেয়ালের বেশ কয়েক জায়গায় যে সাইনবোর্ডেরা ‘ছবি তোলা নিষেধ!’ বলে ধমক মারছে, তার কারণও মনে হয় মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া। তবুও, পৃথিবীতে পাঠকের সংখ্যা তো আজও কম নয়। ফলে ওইটুকু জায়গায় গাদাগাদি করে মানুষ মনোযোগ দিয়ে দ্যাখে বইয়ের সংগ্রহ। সুহানের ভারি ভালো লাগে তখন।
কাঠের একটা সরু সিঁড়ি চলে গেছে দোতলায়। ওপরে কী আছে? প্রশ্নের জবাবে একজন জানায় যে নিচতলায় কেবল কথাসাহিত্য আর নন-ফিকশন। কবিতার সংগ্রহটা ওপরে, একটা পড়ার ঘরও আছে সেখানে। শুনেই সুহান তরতরিয়ে দোতলা যাবার সিঁড়িতে পা রাখে।
সিঁড়ির এক পাশে বইয়ের তাক, সেদিকে সাজিয়ে রাখা কবিতার বইগুলোয় একটা চোখ রেখে শেষ ধাপে উঠে গেলেই একটা পড়ার ঘর। প্রথম দেখাতেই ভীষণ চেনা, ভীষণ ঘরোয়া বোধ হয় এই ঘরটাকে। দশ বাই বারো ফুটের মতো হবে, প্রায় চারদিকের দেয়ালই এখানে বুকশেলফে ঢাকা। আছে একটা শোবার বিছানা, সেটার মাথার দিকটায় জানালা। জানালার সাথেএকটা হেলান দেয়ার উপযোগী সোফা। আর ঘরের অন্য প্রান্তে, দরজার ডানে এবং বিছানার পায়ের কাছে একটা লেখার টেবিল, সেটার ওপর পুরোনো দিনের একটা টাইপরাইটার পর্যন্ত রাখা।
সুহান ছাড়া আপাতত ঘরে দর্শনার্থী দুজন, বাঙালি পর্যটকের দিকে তারা একটুও মনোযোগ দ্যায় না। ‘এ ঘরের বইগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহের অংশ, বিক্রির জন্য নয়। তবে আপনি যতক্ষণ খুশি এখানে বসে বই পড়তে পারবেন। ছবি তোলা নিষেধ।’ এমন একটি সংবিধান দেয়ালে সেঁটে রাখা হয়েছে কাগজে।
খেয়াল করলে দেখা যায়, সত্যিই এখানে বুকশেলফের বইগুলো পুরোনো, বহু ব্যবহৃত। খানিক সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আর ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করে সুহান লেখার টেবিলের ওপরে রাখা একটা বই টেনে নেয়। অক্টাভিও পাজের ‘দ্যা মাংকি গ্রামারিয়ান’। জানালার পাশের সোফাটায় আসন গেড়ে সুহান শুরু করে বইটায় চোখ বোলানো। মিনিট দশেকের মাঝে কিছুটা পড়েও ফ্যালে। কুটনীতিক হিসাবে ভারতে অবস্থানকালে পাজের স্মৃতিকথা গোছের রচনা বইটা, বড় বড় ফন্টে পড়তে খারাপ লাগে না।
বইটা নামিয়ে রেখে সে জানালা দিয়ে তাকায় বাইরে। ঘড়ির কাঁটা সাত পেরিয়ে যাবার পরেও ইউরোপিয়ান গ্রীষ্মের দাপটে প্যারিস এখন বিকালের রোদে ঝলমল। খানিক দূরে সিন নদীর কালচে নীল জল ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়। আকাশে বাতাসে আনন্দ কতটুকু কে জানে, কিন্তু মন খারাপের ভাবটা চট করে আসে না। ত্রিকোণমিতির স্তম্ভ কি পিপে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙিন পোষাকের অগণিত মানুষ। তাদের সবার মাঝ থেকে সুহানের চোখে জলছাপ মেরে যায় বেগুনি রঙের ব্যান্ড দিয়ে টেনে চুল পেছনে বাধা একটি পিচ্চির কপালে তার মায়ের চুমো খাবার দৃশ্য।
বড় ইমারত বা ঐতিহাসিক কোনো স্থান নয়, কোনো জায়গা প্রকৃতপক্ষে আমাদের মনে দাগ কাটে সাধারণ সব মানবিক কিছু মুহুর্ত দিয়েই, বলে গিয়েছিলেন এই প্যারিসেই একদা বসত গাড়া তার প্রিয় ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ী। প্রিয় লেখকের সত্যবাদিতা প্রমাণে সুহানের মনের কাঠগড়ায় এখন লাইন ধরে দাঁড়ায় বেগুনি কার্ডিগানের ফরাসিনী, অর্থনীতি পড়ুয়া মার্সেল, বব মার্লেকে মনে করানো কোনো আরব। ছুটির এই বিকালটা এবার চিরকালের জন্য হয়ে ওঠে প্যারিসের।
… কয়েক মিনিট পর সুহান নিচে নেমে খোঁজ করে যে ‘দা মাংকি গ্রামারিয়ান’ এর বিক্রয়যোগ্য কোনো কপি পাওয়া যাবে কি না। শেক্সপিয়ার এন্ড কোম্পানিতে পা রাখার স্মারক হিসেবে কোনো একটা বই তো নিয়ে যাওয়া তো দরকার, নাকি? কিন্তু নাহ, ওই বইটা খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই। সুহান অতঃপর খুঁজে নেয় ফার্নান্দো পেসোয়ার ‘দা বুক অফ ডিস্কোয়ায়েট’। বহুবার পরিচিতদের কাছ থেকে এ বইয়ের প্রশংসা শুনেছে সে, সামনে যখন পড়লো তো এটাই নিয়ে নেওয়া যাক।
‘আহ, পেসোয়া! ভালো জিনিস!’ কাউন্টারের ওপাশে একহারা গড়নের ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ির ছেলেটি সুহানের বাড়িয়ে দেওয়া বইটা দেখে প্রগলভ হয়ে ওঠে। ‘কবিতায় আগ্রহ আছে? তাহলে কাল বিকেলে আমাদের এখানে চলে আসতে পারো কিন্তু, কবিতা নিয়ে একটা আলোচনা আছে!’
এটুকু বলে ছোকরা এক মুহুর্ত তাকিয়ে দ্যাখে রোদে পোড়া বাঙালিকে। তারপর মৃদু হেসে যোগ করে, ‘অহ! তুমি বোধ করি ব্যাকপ্যাকার? ঘুরে বেড়াও শুধু?’
পৃথিবীতে সকল মানুষই পর্যটক প্রকৃতপক্ষে,এ সত্য চিরকালের জেনেও সুহান উত্তর দিতে খানিক ইতস্তত করে এখন। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘নাহ, পর্যটক না! আমি লিখি।’
* ইতোপূর্বে বণিকবার্তার সিল্করুট ঈদ সংখ্যা ২০২০’ এ এই ভ্রমণগদ্যটি প্রকাশিত হয়েছে।
Leave a Reply