সিম্‌তিয়ের দ্যু মোঁপার্নাস (Cimetière du Montparnasse)-কে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় সেটার অনাড়ম্বর ফটকটার দিকে সুহান একটু সম্ভ্রম নিয়ে তাকায় ঠিক, তবে তা মুহুর্তের জন্যেই। বিশাল এই সমাধিক্ষেত্রটা সে ঘুরে দেখতে চায় কখনো। কিন্তু তাড়াহুড়োয় নয়; দীর্ঘ সময় নিয়ে, একটু একটু করে শিশুসুলভ আনন্দে সে আবিষ্কার করতে চায় কোথায় শুয়ে আছেন জাঁ পল সাত্রে, সিমন দ্য বোভোয়ার কিংবা হুলিও কোয়ার্তাজার। আজকের পরিকল্পনায় যেহেতু সিম্‌তিয়ের দ্যু মোঁপার্নাসের জায়গা নেই, এদিকে আর তাকিয়ে তবে ফায়দা কী? চোয়াল শক্ত করে সুহান তাই এগিয়ে যায়, লা ক্লোজরি দে লিলা (La Closerie Des Lilas) জায়গাটা সামনের চৌরাস্তার আশপাশেই কোথাও হবে, কাউকে জিজ্ঞেস করলেই খুঁজে পাবার কথা।

গুগল ম্যাপ জিনিসটা যথেষ্ট কার্যকরী হলেও ভিনদেশে রাস্তা জানতে কাউকে প্রশ্ন করাটাই সুহানের বেশি পছন্দ। স্থানীয়দের সাথে আলাপ না করলে আসলে ভ্রমণের আনন্দটা ঠিক জমে না। রাস্তাঘাটে কাউকে প্রশ্ন করলে দুটো কথার বিনিময় হয়, পরোপকারীটি আলাপী হলে বিনিময়ের পরিমাণ দশ-পনেরো কথাতেও উন্নীত হবার সম্ভাবনা আছে। ভাব বিনিময়ের ন্যুনতম সুযোগ ছাড়তে সুহান তাই অনিচ্ছুক।

কিন্তু ‘লা ক্লোজরি দে লিলা’, অথবা বাক্যপ্রিয় কোনো পরোপকারী মানুষ; সামনের চৌরাস্তায় পৌঁছে গেলে কোনোটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। ভরদুপুরে এই মোড়টায় মানুষ বেশ কম, যারা আছে, তারাও হন হন করে হেঁটে চলেছে ইয়ারফোন কানে। দোকানগুলোর ভেতরে অবশ্য ভালোই মানুষ, চওড়া রাস্তা দিয়েও গাড়ি ছুটে যাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে। কিন্তু এদের মাঝে তাকে এখন পথ বাতলাবে কে?

খানিক অনুসন্ধানের পর খুঁজে পাওয়া যায় তেমন একজনকে। মোড় থেকে অল্প দূরের একটা পথচারীদের বেঞ্চিতে বসে ভদ্রমহিলা অলস ভঙ্গিতে সিগারেট টানছেন, দেখে তাকে ফরাসী বলেই বোধ হয়। সুহান অবশ্য ভুল উচ্চারণের কোনো রিস্ক নেয় না, সম্ভাষণের পরে রীতিমতো নোটবুকেই রেস্টুরেন্টের নামটা লিখে দিয়ে সে জানতে চায় যে জায়গাটা কোনদিকে। নোটবুকের দিকে এক পলক দেখে নিয়েই ভদ্রমহিলা অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত তুলে নির্দেশ করেন ডানদিকে, হালকা চোট পাওয়া উচ্চারণের ইংরেজিতে জানান যে সুহানকে যেতে হবে রাস্তার অপর পাশে। আন্তরিক ধন্যবাদ দিয়ে পর্যটক এবার এগোতে থাকে নির্দেশনা অনুসারে, পেছনে পরোপকারী ভদ্রমহিলা পুনরায় হেলান দিয়ে বসেন বেঞ্চিতে, তার বেগুনি কার্ডিগানে পড়ে রোদ পিছলে পিছলে যায়।

মোড়ের কাছাকাছি আসতেই সতর্ক চোখে ধরা পড়ে রেস্টুরেন্টটা, চওড়া ফুটপাথের ওধারে প্রবেশপথ বাদে তার বাকি দেহটুকু ঘিরে রেখেছে সুবিন্যাস্ত সবুজ সব ঝোপঝাড়। সাদার মাঝে গাঢ় নীল রঙে শোভা পাচ্ছে নামটা, লা ক্লোজরি দে লিলা। রাস্তা পেরিয়ে সুহান একবার ফের দ্যাখে সাদা রঙের দালানটা, সেটার বাইরের চত্বরে বিছিয়ে রাখা বড় বড় ছাতা, সেটায় লাঞ্চ সারতে আসা ভোজনবিলাসীদের জন্য পেতে রাখা টেবিলগুলো; তারপর সে সন্তপর্ণে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

লালমুখো সাহেব আর রোদচশমায় চোখ আড়াল করা মেমসাহেবদের ভিড়ে ভেতরটা থৈ থৈ করে। সুহান একবার চেষ্টা করলো ভেতরে কোথাও বসা যায় কি না, কিন্তু সেখানে জাঁকজমকের চোখ রাঙানিতে ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুতই সে সরে আসে। বাইরের চত্বরের একদম কোণার দিকে একটা চেয়ার খুঁজে নিয়ে সে বরং চোখ ফেলে বাইরের রাস্তার সাথে দেয়াল তৈরি করা গাছগুলোর গায়ে ফুটে থাকা লাইলাকদের দিকে। কিন্তু শালার ফুলের দিকে বেশিক্ষণ দৃষ্টি বরাদ্দ করা এখানে কঠিন; চামচের টুংটাং, কর্পোরেট ঠাঁটবাঁটে সজ্জিত সাদা পুরুষ ও রঙিন নারীদের নিচু স্বরে আলাপ আর ছুটি কাটাতে আসা পয়সাওয়ালা ভোগী বৃদ্ধদের হাসিতে জায়গাটা শান্তি দ্যায় না। এদিকে আবার এগিয়ে এসেছে সাদা শার্টের ওপরে নীলচে কটি চাপানো ওয়েইটারও, রোদে পোড়া এশিয়ান মুখটির দিকে তাকিয়ে তার আগ্রহ কি উবে গেলো খানিক? কে জানে, ভালো মতো দেখার আগেই ভদ্রতার খাতিরে সুহানকে একটা মেন্যু ধরিয়ে ওয়েইটার ব্যাটা সটকে পড়ে।

খাবার তালিকায় একবার চোখ বুলিয়েই ভেতো বাঙালি পর্যটক লাঞ্চ করবার আগ্রহ হারায়। একটু নাম কামিয়েছে বলে আজেবাজে সব খাবারেও শালারা আকাশছোঁয়া দাম বসিয়ে রেখেছে। ঘুরতে এসে এই চামার শালাদের এখানে টাকাপয়সা নষ্ট করার মানে আছে? সুহান একটু বিরক্ত হয়। তবে এখানে এসে খালিমুখে ফিরতেও সে চায় না আসলে, ফলে আইসক্রিম জাতীয় একটা কিছু দিতে বলে সুহান চোখ বুলায় তার বহুদিনের চেনা এই চত্বরে।

117240227_941929489621040_6015739546205401984_n (1)
সবাইকেই স্পষ্ট দেখা যায়। ওই তো, আড্ডা দিচ্ছেন বোঁদলেয়ার আর পল ভ্যালেরি। প্রথমজনের আশ্চর্য মেঘমালার কবিতা প্রথমে বুদ্ধদেব বসু আর তারপর সুনীল গাঙ্গুলীর হাত হয়ে বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে একদিন, বাবার লাইব্রেরির বই হতে সেই প্রথম বোঁদলেয়ারের সাথে পরিচয় হবে সুহানের; আর দ্বিতীয়জনের কবিতার তুর্কি অনুবাদ করবেন গিয়েন্দুজ পামুক, ইস্তানবুলের এক পারিবারিক লাইব্রেরিতে গিয়েন্দুজের সেই অনুবাদের হাত ধরে তার পুত্র অরহানও প্রথমবারের মতো ভ্যালেরির সাথে পরিচিত হবেন। এই দুই কবির পেছনে ওরা কে? একজনকে সহজেই চেনা যায়, সাত্রে। অন্যজনকে নিয়ে ঠিক নিশ্চিত হওয়া যায় না, স্যামুয়েল বেকেট হতে পারেন, আবার অস্কার ওয়াইল্ডও হতে পারেন। এমনিতে কবিতা শোনার লোভে এ জায়গায় এরা হানা দ্যান মঙ্গলবার, তবে রুটিন ভেঙে আজ সোমবারেই ঢুঁ মেরেছেন বলে সুহানের খানিক আশ্চর্য লাগে। নাট্যকারদের দিক থেকে সরে আরেকটু কোণার দিকে গেলেই আছেন ঔপন্যাসিকরা। হেনরি মিলারকে পাশ কাটিয়ে দৃষ্টি প্রথমে চলে যায় অতিপরিচিত ফিটজেরাল্ড দম্পতির দিকেই। জেল্ডা আজ প্রচুর টেনেছেন, এলোমেলো চুলের জেল্ডাকে ধরে রেখেছেন নিজেও টাল হয়ে থাকা স্কট ফিটজেরাল্ড। মাত্রই ভদ্রলোক শেষ করেছেন ‘দা গ্রেট গ্যাটসবি’র পাণ্ডুলিপি, কাল পরশুর মাঝেই এই রেস্টুরেন্টেই তিনি সেটা মতামতের জন্য পড়তে দেবেন বন্ধু হেম’কে। তবে আজকে নয়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে হেম ওরফে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মেজাজটা খারাপ। সুহানের একাগ্র দৃষ্টিপাত অগ্রাহ্য করেই লোকটা গোমড়া মুখে কিছু একটা লিখে যাচ্ছে তার ডায়েরির পাতায়। কে জানে, মানুষটার মৃত্যুর পর হয়তো ওই ডায়েরিটাই হয়ে উঠবে ‘এ ম্যুভেবল ফিস্ট’এর পাণ্ডুলিপি!

আইসক্রিম খাওয়া শেষ হতে হতে চত্বরে গ্যাঞ্জাম অ্যামন বাড়ে যে হেমিংওয়ে, বোঁদলেয়ারেরা পালিয়ে যান। বেলা দুইটার ভিড় কেটে ক্রমাগত বাড়তে থাকে মানুষ। পরিচিত কাউকে খুঁজে না পেয়ে সুহানও এখন আর রেস্টুরেন্টের এই জনপ্রিয়তা অনুমোদন করতে পারে না, শালার মানুষের ভিড়ে গোটা দুনিয়াটাই আজকাল গাউসিয়া মার্কেট হয়ে গেছে! বিল মিটিয়ে সুহান তাই বেরিয়ে আসে বাইরের ফুটপাথে, পথচারীদের জন্য ছড়িয়ে রাখা বেঞ্চিদের একটায় বসে নিয়ে সে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে দুপুরবেলার প্যারিস। সেই প্যারিস, যে শহরের বুকে সে আজ নেমে এসেছে প্রিয় লেখক আর উপন্যাসের চরিত্রদের পদাঙ্ক আক্ষরিক ভাবেই অনুসরণ করবার সংকল্প নিয়ে।

তাকিয়ে তাকিয়ে রাস্তা দেখতে কিন্তু ভালোই লাগে। রেস্টুরেন্টের সামনে কোনো বড় গাড়ি এসে থামে তো সুদৃশ্য পোষাকের কর্মচারী এগিয়ে দরজা খুলে দ্যায় কায়দা করে, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে হোমড়াচোমড়া কোনো স্যুট-প্যান্ট। বকশিশ আর গাড়ির চাবি দিয়ে ব্যাটা সরে পড়লে অনুগ্রহপ্রাপ্ত কর্মচারী নিজেই গ্রহণ করে গাড়ি সরানোর উদ্যোগ। এসব দেখতে ভালো না লাগলে তাকিয়ে দেখা যায় প্রায় রাস্তার সমান চওড়া ফুটপাথটা, জায়গায় জায়গায় লোকে সাইকেল দাঁড় করিয়ে রেখেছে, জুন মাসের রোদকে খণ্ডখণ্ড করে দ্যায় নাম-না-জানা কোনো গাছ, ঝরা পাতারা বাদামী হয়ে গুটিয়ে আছে পথের এদিকসেদিক। অল্প দূরের ব্যস্ত একটা চৌরাস্তায় পথচারীরা সতর্ক ভাবে রাস্তা পেরোয়, তাদের দিকে সেই ১৮৫৩ সাল থেকে ভাস্কর্য হয়ে চোখ রাখে নেপোলিয়ানের চামচা কোনো এক সেনা কর্মকর্তা। কয়েকবার চোখে চোখ পড়ে গেলেও অমিশুক মূর্তিটি আগ বাড়িয়ে কথা বলার কোনো উদ্যোগ নেয় না বলে সুহানের খানিক খারাপ লাগে। খারাপ লাগাটা বাড়তে থাকলে মিনিট বিশেক পরে সে উঠে দাঁড়ায়, এবং জোরসে পা চালায়। তার এবারের গন্তব্য জার্‌দাঁ দ্যু ল্যুক্‌সবুঁর (Jardin du Luxembourg)।

পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না এবার। চৌরাস্তাটা থেকে বামে সামান্য একটু হেঁটে গেলেই জার্‌দাঁ দ্যু মার্কোপোলো (Jardin du Marcopolo) বলে ছোটো একটা বাগান, সেটার মাঝে ফুটবল নিয়ে নানা কেরদানি করতে ব্যস্ত জনাকতক কিশোরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলেই পৌঁছে যাওয়া যায় জার্‌দাঁ দ্যু ল্যুক্‌সবুঁর বা লুক্সেমবার্গ উদ্যানে।

ঢুকেই চোখে আরাম লাগে। মেট্রোপলিস প্যারিসকে জায়গায় জায়গায় অগোছালো বলে মনে হলেও তার ভেতরের বাগানগুলোতে আবার সবুজের চর্চায় এরা অ্যাতোটুকু খাদ রাখেনি। স্যুটের মতোই নিখুঁত ছাঁটে তৈরি করা ঝোপ, পথের দুধারে বাহারি গাছের সারি; সব মিলিয়ে প্রথম দেখায় সিনেমায় দেখানো স্বর্গদৃশ্যের মতোই লাগে! ইতস্তত খানিক হেঁটে বেড়ানোর পর বসবার জন্য ফেলে রাখা অজস্র চেয়ারের একটা দখল করে সুহান তখন খুঁজে নেয় ছায়া, একবিংশ শতাব্দীর সর্বদা হাইপার-অ্যাকটিভ মস্তিষ্ককে রেহাই দিয়ে এবার সে কেবল চোখটাকে খোলা রাখে।

সব রকমের মানুষ এখানে ভিড় জমিয়েছে মাত্র-বিগত-হওয়া-দুপুরে। বয়স্ক দম্পতিরা আছে, মাঝবয়েসি লোকেরা আছে, ব্যাগ কাঁধে করে ঘোরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদেরও দেখা যায়। পরিবার নিয়ে যারা এসেছে, তারা রীতিমতো চড়ুইভাতি করে সাদা চাদর বিছিয়ে। ওয়াইনের বোতল, কেক, বিস্কুট, তাস খেলার বন্দোবস্ত; সব কিছুই দেখা গেলো। অল্পবয়েসিরা মূলত হাত পা ছড়িয়ে গল্প করছে, কয়েকজন আবার সেরে নিচ্ছে প্রেম করার সময়োপযোগী দায়িত্বটাও। একদম চিৎ হয়ে শুয়ে দু’হাত মাথার নিচে রেখে শুধু আকাশটাই দেখে যাচ্ছে, এমন কয়েকজন হবু বোঁদলেয়ারকেও দেখা যায়। সুহানের চোখে এমন বহু কিছুই আটকায়, আবার গড়িয়ে পড়েও যায় অনেক কিছু। পৃথিবীর সব ধ্বনি যেন এই দুপুরে শেষ হয়ে গেছে আজ, আর কোনো উৎপাত এখন আর মানুষকে স্পর্শ করবে না।

নীরবে আধঘন্টার এই নির্জনতাটা উপভোগ করে আমাদের পর্যটক আবার উঠে হাঁটা শুরু করে। উদ্যানের মাঝখানে যে সুদৃশ্য জলাধারটা আছে, তার ইচ্ছা সেখানে গিয়ে খানিক বসবার।

117619688_743277593132522_8832531238624592567_n

লুক্সেমবার্গ প্রাসাদ নামে একটি মাঝারি সাইজের অট্টালিকার সামনে জলাধারটাকে সত্যিই চমৎকার লাগে কাছে গেলে। বাতাস খুব ফুরফুরে হয়ে বয়ে যায় এখানে। গরম নেই, কিন্তু রোদ আছে, গা না পুড়লেও সেটায় খানিক বিরক্তি তো লাগেই। তো বুদ্ধিমান সুহান হিসেব কষে তাই চেয়ার টেনে নিয়ে নিজেকে অর্ধেক লুকিয়ে ফেলে একটা ভাস্কর্যের কলামের ছায়ায়। ব্যাস, রোদ আর খুঁজে পায় না তাকে। ফলে এবার খুব নিশ্চিন্তে দেখা যায় সাদা মেঘের আকাশ, ছুটে বেড়ানো শিশু আর রঙিন পোশাকের সুন্দরী। কোনো কোনো মুহুর্তে বাতাস একটু জোরে ছুটে এলে সামনের জলাধারটি মুহুর্তের জন্য গ্রামবাংলার পুকুর হয়ে মস্তিষ্কে তার ঢেউ খেলায়।

পাশেই এক ছোকরা কী যেন একটা বই পড়ছিলো, সুহানের ছায়াসন্ধানী আরামের আয়োজন তার নজরে পড়ায় সে বেশ মুখ টিপে টিপে হাসে। চোখে চোখ পড়ে গেলে হাসিটা তার চওড়া হয়। জবাবে সুহানও মৃদু হাসলে, সেই হাসিকে আমন্ত্রণ ধরে নিয়ে ছোকরা এবার হাতের বই রেখে আড্ডায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। অল্প কদিনের দেখায় ফরাসীদের বেশ সোজাসাপ্টা আর আলাপীই মনে হয়েছে সুহানের, জার্মানদের মতো চোয়াল শক্ত রেখে তিন চার শব্দেই এরা কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রাখে না। তবে এসব পর্যবেক্ষণ নিয়ে পরে কথা বলা যায়, আপাতত এদিকে আলাপ জমানোটাই দরকার।

আস্তে আস্তে ঘন হওয়া আলাপে মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় দুজনেরই দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। ছোকরার নাম মার্সেল, অর্থনীতির ছাত্র। তার বিশ্ববিদ্যালয়টা এদিকেই কোথাও। ফলে লুক্সেমবার্গের এই উদ্যানে সে প্রায়ই আসে সময় কাটাতে, কাজ না থাকলে ঘন্টা দুয়েক বাতাস খেয়ে যায়। সুহান ইউরোপ ঘুরতে এসেছে শুনে মার্সেল বুঝদারের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকায়, সে জানে যে বছরের এ সময়টায় প্রচুর বিদেশি লোকে ঘুরতে আসে এখানে।

‘তোমার হাতে ওটা কী, পড়ার বই?’ সুহানের এই প্রশ্নে মার্সেল প্রথমে হতচকিত হয়। তারপর বলে, ‘নাহ, কবিতা। আধুনিক ফরাসী কবিতার সংকলন একটা।’ একটু থেমে জানতে চায়, ‘তুমি ফরাসী কবিতা পড়েছো?’

‘পুরোনো কবিদের কিছু কবিতা অনুবাদে পড়েছি অবশ্য’, সুহান মাথা চুলকায়, ‘কিন্তু এ যুগের ফরাসী কবিতা সম্পর্কে আমি অ্যাকেবারে বকলম।’

মার্সেল এবার আগ্রহী হয়ে ওঠে। ‘পুরোনো ফরাসী সাহিত্য বুঝি পড়া আছে তোমার?’

সুহান আবারো মাথা চুলকায়। পড়া আর হলো কোথায়? সেই তো জুলভার্ন, আলেক্সান্দার দ্যুমা আর ভিক্টর হুগোর ক্লাসিকগুলো। ওর বাইরে খাবলা খাবলা এক দুই চিমটি বালজাক, সাত্রে, কাম্যু বা অন্য কিছু। সেটাকে আর যাই হোক, ফরাসী সাহিত্য পাঠ বলে চালানো যায় না।

হুগোর নামোল্লেখে অবশ্য মার্সেলকে খানিক উল্লসিত লাগে। বলে, ‘হুগোর লে মিজেরাবলে কিন্তু এই লুক্সেমবার্গ উদ্যানের বেশ চমৎকার বর্ণনা আছে। পড়েছো সেটা?’

পড়লেও সেই কথা সুহানের এখন মনে নাই। কিন্তু তাই বলে দমে যাওয়া তার স্বভাব নয়, ফরাসী এই ছোকরাকে পালটা জ্ঞানের পরিচয় দেয়াটা খুব দরকার। ফলে সে ঘোষণা দ্যায় যে লুক্সেমবার্গ উদ্যানের কথা তারও পড়া হয়েছে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ারস’-এ, কার্ডিনাল রিশেল্যুর চক্রান্ত ব্যর্থ করতে দারতানিয়ার সাথে যেখানে যোগ দিয়েছিলো অ্যাথোস, পর্থোস আর আরামিস।

‘বাহ, তাহলে তো প্যারিস তোমার ভালোই চেনাজানা!’ চশমার নিচ থেকে মার্সেলের চোখজোড়া হাসে। ‘ভালো। প্যারিসকে যারা ভালোবাসে, আমরাও তাদের ভালোবাসি!’

কথাটা সুহানের পছন্দ হয়। রঙিন পোষাকে চারপাশে হাঁটাচলা করা অজস্র পর্যটকের দিকে আনমনে খানিক চেয়ে থেকে বাক্যটা সে কয়েকবার মনে মনে আওড়ায়। তারপর মার্সেলের কাছে সে জানতে চায় ফরাসী সাহিত্যের বর্তমান হালচাল, কে কে ভালো উপন্যাস লিখছে এখন।

প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মার্সেল খানিক ভাবে।‘মিশেল উয়েলবেক-এর নামধাম তো আজকাল খুব শুনি, মনে হয় ভালোই লেখে। তারপর তোমার প্যাট্রিক মোদিয়ানো নোবেল পেলো কিছুদিন আগে। পড়েছো নাকি এদের লেখা?’

সুহান জানায় যে মোদিয়ানোর ‘মিসিং পারসন’ উপন্যাসটা সে পড়েছে, মিশেল উয়েলবেকের লেখা তার পড়া হয়নি এখনো।

‘না পড়লেও সমস্যা নেই, তেমন কিছু মিস করো নাই!’ মার্সেল হাসতে হাসতে জানায়। ‘আমার দাদু কী বলেন জানো? বলেন যে ফরাসী সাহিত্যের মানক্রমাগত নিম্নগামী! কোথায় ভিক্টর হুগো, আর কোথায় তোমার মিশেল উয়েলবেক!’

মিশেল উয়েলবেকের হাত ধরে ফরাসী কথাসাহিত্য কতটুকু নেমেছে, সেটা বিস্তারিত বলার অবসর অবশ্য মার্সেল পায় না। একটা ফোন আসায় ছোকরা সেটা কানে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুহান মনে মনে হাসে। সমকালের সাহিত্যের প্রতি এই অভিযোগটা যে কী সার্বজনীন! সবাই মনে করে যে একালে যা হচ্ছে, তার কিছুই পাতে তোলার মতো নয়, সমকালের কিছুই যেন পারবে না কালজয়ী বা ধ্রুপদী হতে!

আসলে উপন্যাস যদি হয় অন্য কোনো সময়ের, বা অজানা কোনো ভাষার; তখন আসলে তার হাত ধরাটা পাঠকের জন্য সোজা। স্বল্প প্ররোচনাতেই উপন্যাসের জগতে সে হারিয়ে যায় তখন। অথচ নিজ ভাষায়, এবং সমকালকে বহন করা কোনো উপন্যাস পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকের মন শুরু থেকেই খিটখিটে বুড়োর মতো। সময়টাকে তার জানা, ভাষাটাকে সে নিত্য ব্যবহার করে, গায়ে তার লেপ্টে থাকে উপন্যাসে বর্ণিত সময়ের ডিএনএ। নিজের সময়ের উপন্যাসকে বিচার করতে গিয়ে মানুষ তাই নিজের জালেই আটকা পড়ে যায়। সোজা ভাষায়, ইতিহাস বা ভূগোলের সার্বজনীন কোনো চাদর মাঝখানে না থাকায়, নিজ ভাষার সমকালীন উপন্যাসকে মানুষ বিচার করে ব্যক্তিগত দৃষ্টির মশারির ফাঁক গলে। যে কারণে এমনকি দারুণ কোনো নতুন উপন্যাসের চাইতেও প্রতিষ্ঠিত কোনো গড়পড়তা উপন্যাসই পাঠকের পছন্দের তালিকায় ওপরে থাকে সাধারণত।

কিন্তু গুরুগম্ভীর এসব উপলদ্ধি দিয়ে মার্সেলকে ভজানোর সুযোগটা আর হয় না। ফোনটা বোধহয় গুরুতর ছিলো, লাইন কাটা মাত্র মঁশিয়ে মার্সেল একেবারে পড়িমড়িকরে ছুট লাগালেন তার কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে, সুহানকে ভালোমতো বিদায়টা পর্যন্ত জানানোর অবসর ছোকরার হয় না। সুহান আর করে কী? পৃথিবীর সমস্ত অবসর সাথে করে সে পা ছড়িয়ে বসে থাকে তখন। সামনের জলাধারটায় পাল তোলা খেলনা নৌকা ছেড়ে মজা নেয় কয়েকটা পিচ্চি। পর্যটকেরা দল বেঁধে সেলফি তোলে। উজ্জ্বল নীল আকাশে সাদা মেঘের কুচকাওয়াজ ফিট করা একটা চমৎকার পটে সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে লুক্সেমবার্গ প্রাসাদ। দিনটা আসলেই ভারি সুন্দর!

(চলবে, ২য় পর্বে সমাপ্য)
* ইতোপূর্বে বণিকবার্তার সিল্করুট ঈদ সংখ্যা ২০২০’ এ এই ভ্রমণগদ্যটি প্রকাশিত হয়েছে।