উপন্যাসের প্রথম বাক্যটা লেখাই নাকি সবচেয়ে কঠিন। সম্ভাব্য পাঠককে বাস্তবের জগত থেকে শব্দ আর কল্পনার জগতটায় সরিয়ে নিয়ে যেতে যে টোপগুলো লেখক ছাড়েন, উপন্যাসের শুরুটা নাকি তার মাঝে সবচাইতে গুরত্বপুর্ণ। ক্যামন ধরনের যাত্রায় নামতে যাচ্ছে পাঠক, প্রথম বাক্যে থাকা লাগে সেটার একটা ইঙ্গিত, থাকতে হয় লেখকের ভাষা কি ভঙ্গির সাক্ষর, আর সাথে অবশ্যই প্রয়োজন পাঠককে আকর্ষণ করবার ক্ষমতা।
আর সেরা উপন্যাসগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, যে উলটো দিক থেকেও ব্যাপারটা সত্য। মানে পাঠকও যদি প্রথম বাক্য থেকেই আটকা পড়ে যায় লেখকের সাথে, তবে সেই উপন্যাস তার মনে একটু গভীরতর দাগই কাটে। বহুদিন পরেও তখন তার মনে ঘুরেফিরে আসে উপন্যাসের শুরুটা।
আজকের লেখাটায় রইলো ৩০টা উপন্যাসের প্রথম বাক্য (ভাবের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে কিছু উদাহরণে অবশ্য দ্বিতীয় বাক্যটাও আছে)। অধিকাংশ উপন্যাস ভিন ভাষার, শেষ কয়েকটা উদাহরণ টুকে নেয়া বাংলা উপন্যাস থেকে।
- বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই সুদূর বিকেল, যেদিন বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বরফ চেনাতে।
(ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউড / গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ) - “আমাকে ডাকবেন ইশমাইল বলে।”
(মবি ডিক / হারমান মেলভিল) - দুনিয়ার সবাই এই সত্যটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, পয়সা’ওয়ালা অকৃতদার যুবক মানেই সে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছে।
(প্রাইড এন্ড প্রেজুডিস / জেন অস্টেন) - সুখী পরিবারগুলো সব একই রকম, অসুখী পরিবারগুলো নিজের মতো করে অসুখী।
(আন্না কারেনিনা / লিও তলস্তয়) - এপ্রিল মাসের দিনটা ছিলো উজ্জ্বল, হিমেল; আর ঘড়ির কাঁটায় তখন তেরো। (১৯৮৪/ জর্জ অরওয়েল)
- তার চেয়ে ভালো সময় আর হয় না, তার চেয়ে খারাপ সময়ও আর আসেনি, সেকাল ছিলো জ্ঞানের, সেকাল ছিলো নির্বুদ্ধিতার, সেকাল ছিলো পরিপূর্ণ বিশ্বাসের, সেকাল ছিলো অবিশ্বাসের, সময়টা ছিলো আলোকোজ্জ্বল, সময়টা ছিলো অন্ধকারাচ্ছন্ন, সময়টা ছিলো আশায় ভরা বসন্তের, সময়টা ছিলো নৈরাশ্যে ভরে থাকা শীতের।
(এ টেল অফ টু সিটিজ / চার্লস ডিকেন্স) - ‘টম সয়্যারের অভিযান’ নামের বইটা পড়া না থাকলে আপনি আমাকে চেনেন না, তবে তাতে কিছু যায় আসে না।
(হাকলবেরি ফিনের অভিযান / মার্ক টোয়েন) - যদি আপনি সত্যিই শুনতে চান, তাহলে সম্ভবতঃ সবার আগে আপনি জানতে চাইবেন আমি কোথায় জন্মেছি, আমার বালের শৈশবটা ক্যামন ছিলো, আমার জন্মের আগে বাপ-মা কীভাবে একজন আরেকজনের সাথে ক্যাচাল করতো- এইরকম ডেভিড কপারফিল্ড জাতীয় বালছাল; সত্যি বলতে, এগুলা বলার কোনো ইচ্ছা আমার নাই।
(দা ক্যাচার ইন দা রাই / জে ডি স্যালিঙ্গার) - কেউ নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে কোনো অপবাদ দিয়ে থাকবে, কারণ সত্যি কোনো অপরাধ না করেই এক সকালে জোসেফ কে গ্রেপ্তার হলো।
(দা ট্রায়াল / ফ্রাঞ্জ কাফকা) - শুরুটা হয়েছিলো রঙ নাম্বার দিয়ে, গভীর রাতে ফোনটা তিনবার বাজলো, আর ওপাশের কন্ঠটা – তাকে নয়- অন্য একজনকে চাইলো।
(সিটি অফ গ্লাস / পল অস্টার) - বেশিদিন আগের কথা নয়, লা মানচার কোথাও- জায়গাটার নাম আমি মনে করতে চাই না- বাস করতেন এক ভদ্রলোক, যার ছিলো দেয়ালে সাজিয়ে রাখা একটি বল্লম, একটি প্রাচীন ঢাল, অস্থিচর্মসার এক ঘোড়া আর দৌড় করানোর জন্য এক গ্রেহাউন্ড কুত্তা।
(ডন কিহোতে / মিগুয়েল ডি সারভান্তেস) - মা আজকে মারা গেছেন। অথবা, হয়তো গতকাল, আমি জানি না।
(দা স্ট্রেঞ্জার/ আলবেয়ার কাম্যু) - আমি একজন অসুস্থ মানুষ… তীব্র হিংসুটে এক লোক।
(নোটস ফ্রম দা আন্ডারগ্রাউন্ড / ফিওদর দস্তয়েভস্কি) - প্রথমে তারা গুলি করলো শ্বেতাঙ্গ মেয়েটাকে।
(প্যারাডাইস / টনি মরিসন) - যেদিন তারা তাকে খুন করতে যাচ্ছিলো, সান্তিয়াগো নাসার সেদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষা করছিলো নৌকাযোগে পাদ্রী আসবেন বলে। (ক্রনিকল অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড / গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ)
- পুড়িয়ে ফেলাতেই ছিলো আনন্দ।
(ফারেনহাইট ৪৫১/ রে ব্রাডবেরি) - রবিবারের সকালটা যখন মাত্র দুপুর, লুকাস বুশ্যাম্পকে নিয়ে শেরিফ তখন জেলখানায় পৌঁছলো; যদিও গোটা শহরের (বলতে গেলে গোটা জেলাটারই) মানুষ গতরাত থেকেই জানে যে লুকাস এক শ্বেতাঙ্গকে খুন করেছে।
(ইন্ট্রুডার ইন দা ডাস্ট / উইলিয়াম ফকনার) - ‘পুনর্জন্ম চাইলে,’ আসমান থেকে ভেসে এলো টলোমলো পায়ের জিবরিল ফেরেশতার সুরালো গলা, ‘প্রথমে তোমাকে মরতে হবে!’
(দা স্যাটানিক ভার্সেস / সালমান রুশদী) - শোনো, মৃত মানুষ কখনো কথা বলা থামায় না।
(এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ সেভেন কিলিংস / মারলন জেমস) - পুরুষদের যা যা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সাগরের দিকে, জেনেছি, তাদের মাঝে সবচেয়ে সাধারণ দুষ্টগ্রহটি হলো, নারী।
(মিডল প্যাসেজ / চার্লস জনসন) - খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।
(পুতুলনাচের ইতিকথা/ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) - সাত বছর বধূজীবন যাপন করিবার পর, বাইশ বছর বয়েসে শীতলের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শ্যামা প্রথমবার মা হইলো।
(জননী/ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়) - শুধু দস্তুরমত একটা বিস্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমতো এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।
(কবি/ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়) - দুই নম্বর ওয়ার্ডের অশ্বথ গাছটির উপরের শাখাটিতে গোধুলীর ম্লান আলো চিকচিক করিতেছে।
(জাগরী/ সতীনাথ ভাদুড়ি) - হয়ে গেছে- ওটা হয়ে গেছে-এখন আর কিছু বলার নেই। আমি, মালতী মুখোপাধ্যায়, একজনের স্ত্রী আর একজনের মা, আমি ওটা করেছি।
(রাত ভ’রে বৃষ্টি / বুদ্ধদেব বসু) - আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুটি রিসার্চ সেন্টারের করিডোরে আমাকে গুলি করেছিলো।
(কপোট্রনিক সুখ দুঃখ / মুহম্মদ জাফর ইকবাল) - পায়ের পাতা কাদায় একটু খানি গেঁথে যেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গলার রগ টানটান করে যতটা পারে উঁচুতে তাকিয়ে গাঢ় ছাই রঙ্গের মেঘ তাড়াতে তমিজের বাপ কালো কুচকুচে হাত দুটো নাড়ছিলো, ওই জায়গাটা ভালো করে খেয়াল করা দরকার।
(খোয়াবনামা/ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) - আমি লোকটা আসলে একটা খচ্চর; যদিও, আমার বাপ লোকটা মোটের উপর ভালোই ছিলেন।
(আমার যত গ্লানি / রশীদ করিম) - দায়রা জজ ফাঁসির হুকুম দিলে আসামী শফিউজ্জামানের একজন কালো আর একজন শাদা মানুষকে মনে পড়ে গিয়েছিলো।
(অলীক মানুষ / সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ) - উনিশশো পঁচাশি সনে একদিন লক্ষীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়।
(জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা / শহীদুল জহির)[৭ জুলাই, ২০২০]
Leave a Reply