লোভী লোকের পক্ষে গল্প লেখা সম্ভব নয়, এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন মাহমুদুল হক। বিতর্কের বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করলে উক্ত দাবির উভয় পক্ষেই বোধহয় বলবার মতো বক্তার অভাব হবে না। সেদিকে না গিয়ে যদি নজর করি মায়াবী গদ্যকার মাহমুদুল হকের বক্তব্যের আরেকটু ভেতরে, তাহলে কিন্তু তার কথাটার একটা অর্থ দাঁড়ায়, যে গল্প লেখার জগতেও লোভী লোকেরা ঘোরাফেরা করে।

সত্যি বলতে, হাটে-বাজারে-ময়দানে-দপ্তরে ঘোরাফেরা করা মতলববাজদের মতোই, সাহিত্য জগতেও অনেকে পা রাখেন বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে। একটু মনোযোগী পাঠক মাত্রই জানেন, যে সাহিত্য জগতে বিচরণ করা মানুষদের অনেকের ধ্যানজ্ঞানেই লেখাটা খুব বেশি প্রাধান্য পায় না।

তো এই যে, সাহিত্য জগতে নানা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘোরাফেরা করা প্রক্সি-লেখকরা, তার মাঝ থেকে কী করে আলাদা হয়ে ওঠেন বড় লেখকেরা? স্রোতে ভেসে না গিয়ে কী করে অনন্য হয়ে ওঠেন তারা?

ছোট্ট এই আলোচনায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর মার্গারেট অ্যাটউডের লেখা থেকে আমরা সে প্রশ্নটার একটা জবাব খুঁজতে চাইবো।

প্রথমেই নজর দেই ইলিয়াসের ডায়েরির দিকেঃ

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ ইং
আমাদের এখানে লোকজন মিডল ক্লাস ভুক্ত হবার সুবিধাগুলো পেতে শুরু করেছিলো ১৯৬০ সালের দিক থেকে। এখনো সুবিধা পাওয়া চলছেই। এই অবস্থায় এইসব লোক, এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কেন? এখানে লোয়ার মিডল ক্লাস সুবিধাভোগী, এবং তাদের প্রবণতা নিজেদের টপক্লাস-এর লোকদের সঙ্গে আইডেন্টিফাই করা। এখানে লেখকদের ব্যাপারেও এই কথা খাটে। ১০-১২টা মাঝারি ধরনের গল্প লিখে এখানে প্রতিষ্ঠিত লেখক হওয়া যায়। বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় কাগজ থেকে ইন্টারভিউ নিতে লোক আসে। লিখলেই লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়? এ স্বীকৃতি পেয়ে লাভ কি? বাংলা গদ্য ঠিকমতো লিখতে পারে না, এমন লোক কথাসাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের সঙ্গে আমাকে আলাদা করে চিহ্নিত করবে? না, করবে না। তাদের ভাবখানা এইঃ আমরাও আছি, তুমি ভালো লিখছো, তুমিও আমাদের সোসাইটিতে এসো। বাকশাল ব্যাপারে সাঙ্ঘাতিক একা হয়ে পড়েছিলাম, এইসব রুচিহীন ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেখি, এখানেও আমি একা।

সূত্রঃ শাহাদুজ্জামান (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা), আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরি

খেয়াল করা যায়, সহযাত্রীদের কাছ থেকে ইলিয়াস প্রত্যাশা করেছেন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু সুবিধাভোগীরা যে সেটার প্রতিবাদ করছে না, তা নিয়ে বিরক্ত তিনি। আবার মধ্যমেধায় সন্তুষ্টদের প্রতিও তীব্র বিরক্তি তার। নামী কাগজে সাক্ষাৎকার প্রকাশ কিংবা দশজনের কাছ থেকে লেখক স্বীকৃতি দিয়ে যে সাহিত্য সাধনার মূল লক্ষ্য অর্জিত হয় না, ইলিয়াস তা প্রকাশ করেছেন তার স্বভাবসুলভ কৌতুকমাখা ক্রোধ দিয়ে। দিনলিপির মাঝে তাই গদ্য দিয়ে নিজেকে আলাদা করবার তীব্র আকুতি। 

পাঠক জানেন, পরবর্তী দুই দশকে নিজের উপন্যাসকে যে পর্যায়ে তুলে নিয়েছিলেন ইলিয়াস, সেখানে তিনি অনন্য ও একাকী। ডায়েরির পাতা থেকেও আমরা অনুধাবন করতে পারি, অন্য দশজন গড়পড়তা লেখকের মাঝে বসেও চিন্তাধারায় ইলিয়াস কী একাকীই না ছিলেন!

এবার তাকানো যাক কানাডীয় লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউডের দিকে। লেখালেখি শুরুর দিনগুলো নিয়ে তার নিচের স্মৃতিচারণটা লক্ষণীয়ঃ

… আবিষ্কার করলাম যে কানাডাতেও কবিদের অস্তিত্ব আছে, তারা ছোট ছোট নানা দলে বিভক্ত। ‘বিশ্বজনীন’ বা ‘দেশজ’, এমন সব আদর্শগত বিরোধও তাদের মাঝে দেখলাম। তারা নিজে মানতো না যে তারা অমন কোনো শিবিরের সদস্য, এবং তারপর তারা একে অন্যকে আক্রমণ করতো অন্য দলের বলে; তারপর তারা আক্রমণ করতো সমালোচকদের, যাদের অধিকাংশই আসলে তাদের সমসাময়িক কবি। তারা একে অন্যকে টিটকারি দিতো, একে অন্যের বইয়ের ব্লার্ব আর সমালোচনা লিখে দিতো, বন্ধুদের পিঠ চাপড়াতো আর শত্রুদের করতো ধরাশায়ী। ঠিক অষ্টাদশ শতাব্দীর সাহিত্যিকদের মতোই, লেখা নিয়ে তারা পুরুতগিরি করতো আর উচ্চারণ করতো ইশতেহার। জীবনকে তারা কণ্টকময় করে তুলেছিলো, সেখানে তারা রক্তাক্ত হতো।

… কানকথা, গণমাধ্যম আর সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিল্লাফাল্লা যা করার, কবিরাই তা করতো বেশি। গল্পকার আর ঔপন্যাসিকরা তখনো কবিদের মতো দল পাকাতে আর হল্লা করতে শুরু করেনি। কানাডীয় ঔপন্যাসিকদের সংখ্যা ছিলো তখন কম, একে অন্যেকে তারা চিনতো কম, এবং তাদের বেশিরভাগই চলে গিয়েছিলো প্রবাসে, কারণ তাদের ধারণা ছিলো কানাডার মতো দেশে শিল্পচর্চা করে তারা ঠিক জুত করতে পারবে না। পরবর্তীতে ষাট আর সত্তরের দশকে পরিচিত হয়ে উঠবে, এমন বেশ কিছু নাম  (মার্গারেট লরেন্স, মরডেকাই রিশলার, অ্যালিস মুনরো, মারিয়ান এঙ্গেল, গ্রায়েম গিবসন, মাইকেল ওন্ডাটজে, টিমোথি ফিন্ডলে, রুডি ওয়াইবে) তখনো স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।

… সে সময়ের কফি হাউজে মারা আড্ডাগুলো ছিলো নানা দিক দিয়েই উল্লেখ্য। তাদের একটা বিষয় ছিলো নির্বিচারে সবার সাথে মাত্রাতিরিক্ত মাখামাখি। নবীন কি প্রবীণ, পুরুষ কি মহিলা, প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত, প্রতিষ্ঠিত বা আনকোরা, তুমুল সমাজতান্ত্রিক বা গোবেচারা সাধারণ কেউ; মেলামেশার ক্ষেত্রে চেক কাপড়ে ঢাকা আর মোমদানি শোভিত টেবিলগুলোয় সবাই ছিলো সমান। আরেকটা বিষয়- কীভাবে বলবো ব্যাপারটাকে – যেটা আমার নজরে আসে, তা হলো এই জমায়েতগুলোর মাঝে সবাই- যার মাঝে প্রকাশিত লেখকরা আছেন, নামজাদা লেখকরাও আছেন-ঠিক প্রত্যাশিত মানের নন। কেউ কেউ খুব ভালো লেখেন, কিন্তু মাঝে মাঝে। কেউ কেউ সমস্ত আসরে একই কবিতা পড়েন, কেউ কেউ বিশাল ঢঙ্গী, আর বাকিদের ক্ষেত্রে বোঝা যায় যে তাদের মূল ধান্দা হচ্ছে মেয়ে, কিংবা পুরুষ, পটানো। চিন্তা হয়, তাহলে কি এমন হতে পারে যে উইঢিবির মাঝের দরজাটা দিয়ে এই কাব্যময়তা ভরে থাকা জগতটায় প্রবেশাধিকার লাভ করাটা কোনো কিছুর নিশ্চয়তা দেয় না? তাই যদি হয় তবে ভালো লেখার সত্যিকারের অনুমোদনটা কোথায়? কীভাবে কেউ জানবে যে সে একটা মানে পৌঁছেছে কি না, আর সেই মানটাই বা কী? যদি এই মানুষগুলোর কেউ কেউ নিজের প্রতিভা নিয়ে একটা বিভ্রান্তির মাঝে থাকে- এবং স্পষ্টতই তারা বিভ্রান্ত- তাহলে এটাও কি সম্ভব না, যে আমি নিজেও সেরকম একটা ভুলের মাঝেই আছি? 

… এর বেশি আমি আর বলতে চাই না। সেই ১৯৬১ সালে, ২১ বছর বয়েসে নখ কামড়াতে কামড়াতে আমি মাত্র বুঝতে শুরু করলাম, যে আমি কীসের মাঝে এসে পড়েছি…

সূত্রঃ মার্গারেট অ্যাটউড, নেগোশিয়েটিং উইথ দা ডেড 

কৌতুকের সাথে লক্ষ করি, যে বাংলা ভাষায় নয় শুধু, কবিদের লড়াই ভূগোল আর কালের গণ্ডী পেরিয়ে বিরাজ করেছে (এবং সন্দেহ হয়, আজও বিরাজ করছে) কানাডাতেও। না পড়েই কারো লেখায় নির্দিষ্ট কোনো ঘরানা খুঁজে পাওয়া, কথায় কথায় একে-তাকে বাতিল করে দেওয়া, উদ্দেশ্যমূলক প্রশংসা বা সমালোচনা; এগুলো তো আজও চলছে পৃথিবীর সর্বত্র। অ্যাটউড নিজে কবিদের মাঝে জিনিসটা বেশি লক্ষ করলেও গদ্যকারেরাও যে ওই অভ্যাস চর্চায় খুব বেশি পিছিয়ে আছেন, তা নিশ্চিত করে কিছুতেই বলা যায় না।

তেতো একটা সত্যও উচ্চারণ করেন অ্যাটউড, যে লেখালেখি অনেকের কাছে ঢং করবার বা নিজেকে ভিন্ন দেখানোর একটা রাস্তা মাত্র; অনেকের কাছে সেটা কেবল কামনা চরিতার্থ করবার জন্য সঙ্গী খোঁজার পথ। তারুণ্যে পৌঁছানো মাত্র কবিতা লেখার যে ব্যারাম ভর করে অনেকের মাঝে, যাদের প্রায় শতভাগই থেমে যায় কিছুদিন পরেই; সে ব্যাপারটার সাথে মিলিয়ে দেখলেই এ জাতীয় কবি-লেখকদের লেখালেখির উদ্দেশ্যটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়।

কিন্তু, লক্ষ করি শ্রদ্ধার সাথে, মার্গারেট অ্যাটউড তার চারপাশের লোকেদের সাথে নিজেকে যুক্ত পারছেন না ঠিক। লেখালেখির জগতের মানুষগুলোর কেবল সংস্পর্শে এসেই অন্যদের মতো তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, শ্রেষ্ঠ কিছু লেখার বাসনা, অন্য একটা মানে পৌঁছবার তাড়না। ২১ বছর বয়েসেই অ্যাটউড বুঝে গেছেন, লেখকের ভূমিকায় প্রক্সি মারা ওসব লোকের মাঝে বসে, রক্তের ভেতর খেলা করা কোনো বিপন্ন বিস্ময়ের খোঁচায় তিনি আলাদা হয়ে পড়ছেন।

ভূগোল ছাড়া দুজনের বয়েসের মাঝে দূরত্ব বেশি ছিলো না। লেখার ধাঁচও ঠিক এক নয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর মার্গারেট অ্যাটউডের। তবু প্রথমজনের ডায়েরি আর দ্বিতীয়জনের স্মৃতিচারণ পড়ে আবিষ্কার করা যায় একটা সাদৃশ্য, শিল্পীর অতৃপ্তি। স্বীকৃতি নয়, সাফল্য নয়; তাদের আকুতি আরো শ্রেষ্ঠ কোনো লেখা কি গদ্যমান অর্জনের জন্য। সেই আকুতি তাদের বাধ্য করেছে সমকালীনদের চাইতে আলাদা হয়ে নিজের রাস্তা গড়ে তুলতে। একা হতে হতে, তারা হয়ে গেছেন অনন্য।

[১৭ জুলাই, ২০২০]