ইসমাইল কাদারের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায় বছর দুয়েক আগে, প্যারিস রিভিউকে তার সাক্ষাৎকারটা পড়ে। খুব বেশি মানুষ কথা বলে না আলবেনিয়ান ভাষায়; কিন্তু অমন একটা ভাষাতেই লিখে ইউরোপের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন কাদারে; সে তথ্যের চেয়েও বেশি আগ্রহ জাগে লোকটার ভাবনার বৈচিত্র্য দেখে। আমাদের অতি পরিচিত গ্রিক পুরাণের চরিত্র আর ঘটনাগুলো দিয়ে লোকটা এমন ভাবে আধুনিক যুগকে ব্যক্ত করেন ওই সাক্ষাৎকারে, পড়তে বেশ মজা লাগে আমার। গুগলের শরণাপন্ন হয়ে বেশ কিছু পড়াশোনাও করি তাকে নিয়ে। এবং নিশ্চিত হই, যে লোকটাকে পড়া দরকার।

এরপর বহু দিন পেরিয়ে হাতে এসেছে কাদারের বেশ কয়েকটা উপন্যাস, শেষ পর্যন্ত বসা হয় তাকে নিয়ে। শুরুটা হয় ‘দা জেনারেল অফ দা ডেড আর্মি’ দিয়েই। ইসমাইল কাদারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস এটি, এবং প্রথম কাজটিই তাকে ইউরোপে যথেষ্ট বিখ্যাত করে তোলে ঔপন্যাসিক হিসেবে।

উপন্যাসের শুরু হয় চমকপ্রদ এক প্রেক্ষাপটে। ষাটের দশকের কোনো এক সময় ইতালিয়ান এক জেনারেল সদলবলে যাত্রা করছেন আলবেনিয়ায়। উদ্দেশ্য, প্রায় বিশ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারানো সৈনিকদের দেহাবশেষ নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা। অদ্ভুত এই অভিযানে জেনারেলকে সঙ্গ দেবেন ইতালিয়ান এক পাদ্রী, আলবেনিয়ান একজন খনন বিশেষজ্ঞ আর ভাড়াটে শ্রমিকের দল।

অথচ পুরোনো দিনের ভৌতিক কাহিনীতে কুখ্যাত পোড়োবাড়িতে ঢুকলে নায়কের যেমন হয়, কাদারের বর্ণনায় বৃষ্টি আর শীতল বাতাসের আধুনিক যুগের আলবেনিয়ায় পা রাখা মাত্র জেনারেলও অনুভব করেন ঠিক তেমনটাই। অজস্র পাহাড় আর পাহাড়ি নদীবহুল ছোট্টো দেশটার রুক্ষ ভূগোল শুরু থেকেই ক্যামন যেন আধিভৌতিক, পরাবাস্তব এক আবহ নিয়ে হাজির হয় জেনারেলের সামনে। সাথে থাকা পাঠকও নিরন্তর অনুভব করে একটা অস্বস্তি। মন্ত্রণালয়ের দেয়া তালিকা অনুসরণ করে জেনারেল তার দলবল নিয়ে ঘুরতে থাকেন মফস্বল থেকে মফস্বল আর গ্রাম থেকে গ্রামে; কঙ্কালে ভরে উঠতে থাকে তার সাথে থাকা ভ্যানগুলো, গড়ে উঠতে থাকে মৃতদের আস্ত এক সেনাবাহিনী।

বিশ্বযুদ্ধে হারুপাট্টির দলে থাকা ইতালির সৈনিকেরা পরাজিত হয়েছিলো এই আলবেনিয়ায়। বিশ বছর আগের সেই যুদ্ধে পরাজয়টা আমাদের জেনারেল যেন এখনো মেনে নিতে পারেননি, অবিরাম যাত্রায় দুপাশের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি তাই কেবলই ঠিক করতে থাকেন কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধকৌশল। অন্যদিকে স্থানীয় লোকেদের হৃদয়েও আঁচড় কেটে যাচ্ছে ইতিহাস। যে সৈনিকদের পরম মমতায় ফিরিয়ে নিতে চাইছেন জেনারেল, বিগত যুদ্ধে তারাই নির্বিচারে হত্যা করেছিলো আলবেনিয়ার অজস্র পুরুষ, বিক্ষত করেছিলো বহু মেয়েদের। তা সেইসব ঘৃণ্য শত্রুদের আজ রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভিনদেশি এক জেনারেল, আলবেনিয়ার মানুষ এই ব্যাপার কীভাবে মেনে নেয়?

অতীতের দিকে তাকিয়ে বারবার থমকে যাওয়া জেনারেল তবু এগিয়ে যান তার অভিযানে, আর উপন্যাসটা এগোয় ইতিহাস এবং আর রাজনীতির প্যাঁচে মোড়া বহু চোরাগোপ্তা অথচ তীব্র প্রশ্নকে পাঠকের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে।

এমন একটা গল্পকে পেছনে রেখে এগোনো ‘দা জেনারেল অফ দা ডেড আর্মি’-এর যে বাংলা অনুবাদটা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ এর বইমেলায়, আমাদের অনেকেরই পরিচিত ‘বইয়ের জাহাজ’ প্রকাশনী থেকে, আমি সেটাই পড়েছি। পরিচিত অনেকের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়াটা বেশ ভালো লাগার। অনুবাদক হিসেবে মোশাররফ হোসেনও ভালো কাজ দেখিয়েছেন, সামনে আরো ভালো কিছুর প্রত্যাশা তার কাছে। প্রচ্ছদ আর পেপারব্যাকের প্রোডাকশনও মানসম্পন্ন বেশ, প্রকাশনী ‘বইয়ের জাহাজ’ সামনের দিনেও এমন ভালো বই নিয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়ে গেলাম।

ফিরে আসি কাদারে প্রসঙ্গেই।

এমনকি আলোচ্য উপন্যাসের শুরুতেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় গ্রিক পুরাণের প্রতি লোকটার প্রেমের। ট্রয়ের যুদ্ধে নিহত বীরদের জন্য যথার্থ শোকপালনের ঘটনাটা বার বার টেনে আমাদের জেনারেল নিজের অভিযানকে মহৎ করবার প্রয়াস পান। কিন্তু সেটি দিয়ে, অথবা ঘোরতর রাজনৈতিক প্লট বেছে নেওয়াতেও ইসমাইল কাদারেকে চেনা যাবে বলে মনে হয় না। বরং, সম্ভবত লোকটার সাক্ষর তার উপন্যাসের ভেতরে আশাহীনতা; সেটা এমন এক অবস্থা, যাকে বিমর্ষ বা নিস্তেজ তো বলা যায়ই, লালমোহন গাঙ্গুলী হলে হয়তো ম্যাদামারাই বলে দিতেন। শৈশবে সোভিয়েতের ঝলমলে রঙিন শিশুপাঠ্য বইগুলো ভীষণ অপছন্দের ছিলো কাদারের, আলো ঝলমল সূর্যালোকে (আশার প্রতীক!) খেলতে খেলতে বাচ্চারা মহৎ সব কাজ করে বেড়াবে, চাপিয়ে দেয়া সেই সোভিয়েত স্বপ্ন তার কাছে তখন থেকেই অলীক। পাহাড়ঘেরা আলবেনিয়ায় তিনি বরং পছন্দ করতেন বৃষ্টি আর কুয়াশা, রহস্যের খাসমহল।

ইসমাইল কাদারের আরেক উপন্যাস ‘দা সিজ’ (The Siege) এর কিছুটা অংশ পড়তে পড়তে আমার তাই সন্দেহ হয়, লোকটার বাকি উপন্যাসগুলোতেও পাঠককে তাড়িয়ে ফিরবে আশাহীন ওই ঝিম লাগা আবহাওয়াই, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাজত্ব করে যেটা প্রায় জলবায়ূতে পরিণত হয়েছে।
[০৪ আগস্ট, ২০১৯]