তিনটা সিনেমা দেখার টুকরো অভিজ্ঞতা একত্রে করে এই লেখা। এদের মাঝে সাধারণ যোগসূত্র আবিষ্কার করতে চাইলে উঠে আসবে ইতিহাসের প্রসঙ্গটা। দেশ আর কালের ভিন্নতা নিয়েও তিনটা সিনেমাই সত্য কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত।
দা টু পোপস [২০১৯,পরিচালকঃ ফার্নান্দো মেরিলেস]
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ধর্ম একটা হলেও, একই ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও বিরোধ কম হয় না কখনোই। নানা মুনির মত, ধর্মের ক্ষেত্রেও বিবিধ রুপ নেয়। কিন্তু ক্যামন হয়, যদি পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত ধর্মগুরুদের মাঝেই মতের অমিল হয় আকাশ-পাতাল? ‘সিটি অফ গড’ খ্যাত পরিচালক ফার্নান্দো মেরিলেসের ‘দা টু পোপস’ সিনেমাটা দর্শকের ভাবনাকে দোলালো সেই চিন্তার সুতো ধরেই।
দ্বিতীয় জন পলের মৃত্যুর পরে ২০০৫ সালে ভ্যাটিকানে যখন বসে পরবর্তী পোপ নির্বাচন অনুষ্ঠান, জোসেফ রাটজিঙ্গারের সাথে সেখানেই প্রথম মোলাকাত হয় মারিও বার্গোলিও’র। জার্মান কার্ডিনাল জোসেফ স্বভাবে খুঁতখুঁতে, প্রখর তার রাজনীতিজ্ঞান, ধর্মগুরুর সাথে মানানসই গাম্ভীর্য তাকে ঘিরে রাখে সর্বদা। অন্যদিকে আর্জেন্টাইন আর্চবিশপ মারিও স্বভাবে ফুরফুরে, ফুটবল খেলা থাকলে টিভি থেকে তার চোখ সরে না, গুণগুণিয়ে তিনি বিটল্স থেকে শুরু করে অ্যাবা’র গানের কলি ভাঁজেন, ভালোবাসেন নাচতে। একশো আশি ডিগ্রি উলটো এই দুজনকে কাছাকাছি এনে দিলো পোপ নির্বাচনের ফলাফল। জোসেফ রাটজিঙ্গার পোপ নির্বাচিত হলেন ঠিকই, তবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেলেন মারিও।
সাত বছর পরের ঘটনা, ইতোমধ্যে ষোড়শ বেনেডিক্ট (পোপ হিসেবে রাটজিঙ্গারের গ্রহণ করা নাম) বেশ সমালোচিত হয়ে পড়েছেন তার রক্ষণশীলতার জন্য। এবং পোপের ব্যক্তিগত সহকারির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে ভ্যাটিকান যখন টালমাটাল, আরো একবার তখন মারিও বার্গেলিও’র সাথে দেখা হয়ে গেলো তার। নিজের পদত্যাগপত্র পোপের কাছে স্বহস্তে জমা দিতেই মারিও এবার রোম গেছেন।
মূল সিনেমাও শুরু হয় ওখানেই। আমরা দেখি ঈশ্বর নিয়ে, বদলে যাওয়া পৃথিবী নিয়ে, ধর্মের সংস্কার নিয়ে দুই ধর্মগুরুর আলাপ। বৈপ্লবিক কোনো তত্ত্ব উপস্থাপন করেন না জোসেফ বা মারিও’র কেউ, কিন্তু মনে হতে থাকে, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন দ্বন্দ্বটার একটা সভ্য রুপ যেন দেখতে পাচ্ছি আমরা। ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ কীভাবে পালটে যায় মানুষ ভেদে, ক্যামন হওয়া উচিৎ আজকের পৃথিবীতে ধর্মের ভূমিকা; এই নিয়ে কথা বলতে থাকেন দুজন ধর্মগুরু। আমাদের মনে হতে থাকে, আত্মঘাতী বোমার পৃথিবীতে চিরকালই ধর্মের মীমাংসা এভাবেই হয়ে গেলে কী চমৎকারই না হতো!
আরো দেখা যায়, চার্চের এই টালমাটাল সময়ে মারিও’র পদত্যাগ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান ষোড়শ বেনেডিক্ট, তিনি বরং চান তার পরবর্তী পোপ হিসেবে মারিও’র নামটাই প্রস্তাব করতে। তখন মারিও উন্মুক্ত করেন নিজের অতীত, বলেন যে কীভাবে তিনি তার যৌবনে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন আর্জেন্টাইন সামরিক জান্তার, আর শাস্তি হিসেবে পেয়েছিলেন নির্বাসন। পোপ বেনেডিক্ট’ও তখন তার উত্তরসূরি পোপের সামনে নিজেকে খুলে দ্যান, অকপটে স্বীকার করেন নিজের ব্যর্থতার কথা।
বহু পুরাতন সেই সত্যটা তখন আমরা আরো একবার জেনে যাই দুই পোপের কাছ থেকে। জেনে যাই যে কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, কিন্তু তিনিই ঈশ্বরের সবচাইতে কাছে যেতে পারেন, যিনি অনুতাপে পোড়েন, নিজেকে একা করে ফেলে প্রশ্নে বিদীর্ণ করেন আর উত্তর খুঁজে বেড়ান সর্বক্ষণ।
ইতিহাসটা সাম্প্রতিক বলেই সিনেমার শেষটা আমাদের সকলেরই জানা। ষোড়শ বেনেডিক্টের পর যে পোপ নির্বাচিত হয়েছেন আর্জেন্টাইন আর্চিবিশপ মারিও, সেও বিসিএস পরীক্ষার্থীরা ছাড়াও প্রায় সকলেই জানেন। তবুও শেষ দৃশ্যে দারুণ একটা হালকা মেজাজ এনে সিনেমাটা শেষ করতে পারার জন্য মনে মনে আবারও কৃতিত্ব দিতে হয় পরিচালককে। আর ধন্যবাদ তো লোকটা আগেই পেয়ে গেছে! ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের তরিকা নিয়ে নিছক দুজন বুড়ো মানুষের মাঝে আলাপকে যিনি এমন টানটান গতি দিতে পারেন, তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে আর উপায় কী?
ইভেন দা রেইন [২০১০, পরিচালকঃ ইচিয়ার বোলেইন]
ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিয়ে বেশ কিছু সময় পড়াশোনা করেছিলাম। নানা বয়স আর পেশার সংশ্লিষ্ট মানুষদের সাথে কথাও বলেছিলাম তখন। একটা চক্র কী করে পার্বত্য অঞ্চলের ঝিরি (পাহাড়ি ঝর্ণা) থেকে পাথর তুলে বেড়ায়, সে ব্যাপারটাও তখনই আমি জানতে পাই প্রথমবারের মতো। পয়সার ভাগ বাটোয়ারা যেহেতু আছে, লাভজনক ওই পাথর ব্যবসায় তাই জড়িত অনেক পক্ষই। অথচ পাথর তুলে ফেলায় ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝর্ণার স্রোত, আদিবাসীদের তাই পানি যোগাড়ের জন্য তখন পেরোতে হচ্ছে আরো অনেকটা দুর্গম পথ। কিন্তু তাদের চিৎকার কিছুতেই এসে পৌঁছায় না আমাদের আলো ঝলমলে ঢাকার কফিশপে।
ইচিয়ার বোলেইন এর ‘ইভেন দা রেইন’ সিনেমাটা দেখে আবার বোধ হলো, আদিবাসীদের প্রতি তথাকথিত সভ্যতার এইসব অসভ্যতা কোনো দেশের সীমানা মানে না। আর শোষণের ওই চক্র যে কালের সীমানাও ভেঙে চলেছে, সেই প্রমাণ তো সিনেমার ভেতরেই আছে!
শেষ কথাটা ভেঙে বলতে সিনেমার গল্পটা একটু খুলে বলা দরকার।
তরুণ এক সিনেমা নির্মাতা পরিচালক সেবাস্তিয়ান আর তার প্রযোজক কস্তা দলবল নিয়ে হাজির হয় বলিভিয়ার কোচোবাম্বাতে। ক্রিস্তোফার কলম্বাস যখন নতুন পৃথিবীতে (বর্তমান কিউবা) স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপন করছেন, রাজনৈতিক লুটতরাজের উদ্দেশ্যে সেখানে ছড়িয়ে দিচ্ছেন যিশুর বাণী, তখন তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়ায় স্থানীয় আদিবাসী নেতা অটি, কী করে স্প্যানিশ লুটেরারা সেই বিদ্রোহ দমন করলো নৃশংস উপায়ে; তা নিয়েই বানানো হবে সিনেমাটা। তো, সিনেমা কিউবার হলেও, খরচ বাঁচাতে সেবাস্তিয়ানের দল এসে হাজির হয়েছে বলিভিয়ায়।
ইতিহাসে কীভাবে অন্যায় করা হয়েছে আদিবাসীদের প্রতি, তা নিয়ে ভাবলেই বুকের ভেতর তীব্র বেদনা হয় আদর্শবাদী যুবক সেবাস্তিয়ানের, মাত্র দুই ডলারে যে এখানে আদিবাসীগুলোকে সারাদিনের জন্য খাটানো যায়, সেটা চিন্তা করে তার দুঃখ আরো বাড়ে। আবার এই সিনেমা তার বহুদিনের স্বপ্ন, ফলে এটাকে চিরকালের শিল্প করে তুলতে সে আপোষহীন। সিনেমার অন্যান্য অভিনেতারাও দারুণ প্রস্তুতি নিয়ে নেমেছে। যে সব চরিত্রে তারা অভিনয় করছে, সেইসব দখলদার স্প্যানিশ সেনানায়ক বা পাদ্রীদের শোষণবাজ ও দখলদার ভূমিকাকে তারা প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া করে।
কিন্তু কাহিনি জমে ওঠে আরো, যখন সরকার ওই শহরের পানি সরবরাহের মালিকানা দিয়ে দেয় বেসরকারি এক কোম্পানিকে। ক্যালিফোর্নিয়া কি সান ফ্রান্সিসকোতে বসে সেই সব স্যুট বাবুরা ঠিক করে যে বছরে সাড়ে চারশো ডলার না গুণলে পানি সরবরাহ বন্ধ করা হবে কোচোবাম্বার পাহাড়ে পাহাড়ে, এমনকি বৃষ্টির পানি জমানোর কুয়োগুলোও বন্ধ করা হয় সৈন্য দিয়ে। এহেন গোলমালের মাঝে জড়িয়ে পড়ে সেবাস্তিয়ানরাও। কারণ তাদের সিনেমায় আদিবাসী নেতা অটির চরিত্রে অভিনয় করা ড্যানিয়েল, সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি করা লোকটা, সে এগিয়ে যায় পানির জন্য আন্দোলনে নামা লোকদের নেতৃত্ব দিতে।
পাঁচশো বছরের পুরাতন নাটকটা আরো একবার মঞ্চে নামে তখন। দখলদার স্প্যানিশ সৈনিকরা নয়, স্বর্ণের বদলে এবার আদিবাসীদের কাছ থেকে পানির অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় সরকারের আজ্ঞাবহ অস্ত্রধারী সেনাবাহিনি।
নির্মাণটা হয়তো খানিকটা নাটুকে। কিন্তু কোচোবাম্বার সত্যিকারের এক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত বলে, ওইটুকু নাটুকেপনাকে বাদই দেয়া যায়। আদিবাসীদের নিয়ে বলা গল্প যারা খোঁজেন, তারা হয়তো খানিক বেশি আগ্রহ নিয়েই দেখতে পারেন এই সিনেমাটা।
রিচার্ড জুয়েল [২০১৯, পরিচালকঃ ক্লিন্ট ইস্টউড]
স্কুলের প্রায় সমস্ত ক্লাসে বোকাসোকা গোছের কিছু সহপাঠী থাকে আমাদের, যাদের মাথাটা খুব দ্রুতগতিতে চলে না। শিক্ষকদের আওড়ানো সমস্ত কথাকেই তারা নেয় বেদবাক্য হিসেবে, ফলে ক্লাসে গল্পের বই আনার মতো ব্যাপারগুলোকেও তারা মনে করে ভয়ানক গর্হিত অপরাধ। সেইসব বোকাটে সহপাঠীদের যথেচ্ছ খোঁচানোর অপরাধটা আমরা সবাই করেছি স্কুলজীবনে, আমি জানি। ফিরে তাকালে দুঃখিত না হয়ে পারি না, মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে শিশুরা খুব নিষ্ঠুর হতে পারে।
ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত ‘রিচার্ড জুয়েল’ চলচ্চিত্রের নাম চরিত্রটাকে দেখে আমার মনে পড়েছে স্কুলের সেই আজীবনের শ্লথগতির বাচ্চাগুলোকে। রিচার্ড হতে চায় একজন আদর্শ পুলিশ। আইনের প্রতি মোটাসোটা লোকটার শ্রদ্ধা এমন বেশি, যে বাড়াবাড়ির দায়ে সে শেরিফের ডেপুটির পদ থেকে প্রত্যাহার হয়ে ক্যাম্পাস পুলিশ পর্যন্ত হয়, কিন্তু সেখানেও সে ছোটখাটো অপরাধের কারণে সকলকে ত্যক্ত করে ছাড়ে। মায়ের সাথে থাকা অকৃতদার রিচার্ড জুয়েল আবারো ফিরতে চায় আইনরক্ষকের পদে, ফলে ১৯৯৬ সালের আটলান্টা অলিম্পিকে যখন সে নিরাপত্তা সহযোগী হবার সুযোগ পায়, দায়িত্বটা পালনে সে কোনো ফাঁক রাখতে চায় না।
ঘটনাটা ঘটে সেখানেই। দৈবক্রমে মালিকানাহীন একটা ব্যাগের ভেতরে বোমা আবিষ্কার করে রিচার্ড সাবধান করে সকলকে, আর প্রাণরক্ষা করে বহু মানুষের। গণমাধ্যমের কল্যাণে রাতারাতি তখন জনমানুষের নায়ক হয়ে ওঠে রিচার্ড জুয়েল।
কিন্তু কাহিনির কেবল শুরু এখানে। জাংকফুড লোভী মানুষটার অতীত রেকর্ড ঘেঁটে FBI ধারণা করে যে নিঃসঙ্গ, সামাজিক জীবনে ব্যর্থ বোমাবাজদের যে প্রোফাইলটা আছে; তার সাথে বেশ মিলে যায় রিচার্ডের জীবন। FBI’য়ের এই ধারণাটা আবার ফাঁস হয়ে যায় ক্যাথি স্ক্রাগস নামের এক ধুরন্ধর মহিলা সাংবাদিকের কাছে; স্কুপের লোভে সে নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই পরদিন পত্রিকায় রিচার্ড জুয়েলকে তুলে ধরে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে।
পূর্ব পরিচিত আইনজীবী ওয়াটসন ব্রায়ান্ট’কে সাথে করে শুরু হয় রিচার্ড জুয়েলের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সংগ্রাম। প্রতিপক্ষ তার একাধিক; উৎসুক জনতা, লোভী সংবাদ মাধ্যম আর নিজেদের মুখ বাঁচানোর জন্য ব্যস্ত FBI গোয়েন্দারা।
একটু ধীরগতির বলেই হোক, আর অতটা নাটকীয় উপাদান নেই বলেই হোক, ক্লিন্ট ইস্টউডের অন্যান্য সিনেমার তুলনায় বেশ নীরস লাগে ‘রিচার্ড জুয়েল’কে। আবার সিনেমার শেষে যা-ই ঘটুক, বোমাবাজির ঘটনায় রিচার্ডের ভূমিকা সম্পর্কে একটু দ্বিধা মনে হয় পরিচালক নিজেই ঝুলিয়ে রাখেন।
কিন্তু সে কারণে নয়, ‘রিচার্ড জুয়েল’ আরো একবার ইতিহাস থেকে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেয়, গণমাধ্যমের দ্বারা তথ্যের সামান্য পরিবর্তন হলে কী তুমুল বদলে যেতে পারে ব্যক্তি মানুষের জীবন। অনলাইনের কী বোর্ডে সদাসতর্ক ল্যান্সনায়েক হয়ে বসে থাকা আমাদের এই পোস্ট-ট্রুথ যুগে, কতশত রিচার্ড জুয়েলকে আমরা প্রতিদিন ঠেলে দিচ্ছে মানসিক বিপর্যয়ের দিকে, সেই পরিসংখ্যান কি কখনো প্রকাশ পাবে?
সহপাঠীদের খুঁচিয়ে যাওয়া শিশুদের তাই নিষ্ঠুরতার দায় এককভাবে চাপানোটা তাই ভুল। মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে, যতই ভুলই সে হোক না ক্যানো, জাতিগত ভাবেই মানুষের মতো নিষ্ঠুর আর কেউ নেই।
[জুলাই ২০২০]
Leave a Reply