(১)
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ডুবে গিয়ে অল্পবিস্তর যারা চোখ রেখেছেন কবির ব্যক্তিগত জীবনেও, লাবণ্য দাশ তাদের কাছেও পরিচিত এক নাম। নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে এমন এক বিপন্ন বিস্ময়ের অনুসন্ধান জীবনানন্দ করে গেছেন, সমকালের চেয়ে পরবর্তী কালেই মানুষ সেটার সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে অধিক। সময় কেটেছে, এবং জীবনানন্দের ছায়া হয়ে উঠেছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। অগণিত বাংলাভাষী পাঠক, আজও তারা হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হেঁটে চলার ক্লান্তি আবিষ্কার করে যাচ্ছে জীবনানন্দের কবিতায়। নিশ্চিত জানি, ‘কবি’ শব্দটা শুনলেই যে করোটির ভেতরে কোথাও অনুরণন তোলে জীবনানন্দ দাশের নামটা, সে ব্যাপারটা কেবলই আমার ব্যক্তিগত নয়।
অথচ গণমানুষের হৃদয়ে কবিপত্নী লাবণ্য দাশ রীতিমতো এক অসংবেদনশীলতার পিরামিড। জাগতিক বিষয় ভুলে সংসার উদাসীন থাকার যে রোমান্টিক বুদবুদ কবির চারপাশে বুনতে ভালোবাসে ভক্ত দল, জীবনানন্দকে সেটার উদাহরণ হিসেবে টানলে পরীক্ষার পাতায় দশে সাড়ে নয় পাওয়াটাও সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করা জীবনানন্দের বিপরীতে তার স্ত্রী লাবণ্যের কুঁচো চিংড়ি কেনার দৈনন্দিন জীবন হয়ে উঠেছে পাঠকের চক্ষুশূল।
দাম্পত্য সম্পর্কের নানা অতৃপ্তির প্রসঙ্গ বেশ নিয়মিত ভাবেই উঠে এসেছে জীবনানন্দের গল্পে আর উপন্যাসে। সেগুলো যে প্রকৃতপক্ষে কবির অসুখী দাম্পত্য জীবনেরই প্রতিফলন, তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গেছে নানা জায়গায়। বিশেষ করে ‘মাল্যবান’ উপন্যাস যে একেবারে তার জীবন থেকেই চোথা মেরে লেখা, চায়ের আড্ডায় এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে লোকে টেবিলে চাপড় পর্যন্ত মেরেছে বহুবার। সেই উপন্যাসের নাম চরিত্র মাল্যবান (রামায়ণে ধৈর্য্যের প্রতীক হিসেবে বর্ণিত এক পাহাড়ের নাম) বলতে গেলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ, আর তার স্ত্রী উৎপলা ভয়াবহ শীতল, রুক্ষ এক নারী। তো জীবনানন্দের সাথে যেহেতু মিলে যায় মাল্যবানের জীবন, অতএব উৎপলা হবেন তারই স্ত্রী লাবণ্য দাশ; সে আন্দাজ করা কি পাঠকের জন্য কঠিন নাকি? তদুপরি, আরো একটা তথ্যও ঘুরে বেড়ায় নানা জায়গায়। কবির মৃত্যুর পর তার রচনাবলী সম্পাদনার সময় শঙ্খ ঘোষকে নাকি ‘মাল্যবান’ প্রকাশে আপত্তিও জানিয়েছিলেন লাবণ্য।
এইসব জেনে বুঝে, আমরা বেসেছি যারা জীবনানন্দের কবিতারে ভালো, লাবণ্য দাশ তাদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন একটি কাঠগড়ার চৌহদ্দিতে। সংসার জীবনে কবিকে দু’দণ্ড শান্তি না দেয়ার অপরাধে তাই লাবণ্যকে দীর্ঘকাল ধরে বিদ্ধ করে আসছে গণমানুষের ভ্রুকুটি।
লাবণ্য দাশের লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ নামের ছোটো যে স্মৃতিচারণাটা আছে, খুব একটা দাগ সেটা কাটে না পাঠকের মনে। অনেকদিন আগে পড়া বলে বিস্তারিত স্মরণ নেই এখন, কিন্তু মনে আছে, জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা বর্ণনার অধিক কিছু ছিলো না সেই বইটায়। এবং স্বরও ছিলো যথেষ্ট নিরুত্তাপ। চেনা, কিন্তু হৃদয়ের কেউ নয়, এমন কৃতী কারো প্রয়াণে ‘তাকে যেমন দেখেছি’ গোছের যে অজস্র স্মৃতিকথা রচিত হয়ে এসেছে চিরকাল; তার অধিক কিছু মনে হয়নি লাবণ্যের স্মৃতিচারণটাকে। ফলে কবির অসুখী দাম্পত্য জীবনের আরো একটি স্মারক বলেই সেটিকে গ্রহণ করেছিলাম তখন।
দীর্ঘদিন পর, লাবণ্য দাশকে আবারও মনে পড়লো তলস্তয়ের উপন্যাসিকা ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ পড়ার পর। বলা ভালো, লাবণ্যকে আসলে মনে করালেন তলস্তয়ের স্ত্রী, সোফিয়া তলস্তয়।
(২)
কিন্তু সোফিয়া প্রসঙ্গে যাবার আগে একটু তাকিয়ে নেয়া দরকার ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’র কাহিনির দিকে।
রাশিয়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝ দিয়ে ছুটে চলা এক ট্রেনে বসা বাতিকগ্রস্থ জমিদারের কাহিনি আমাদের শোনালেন তলস্তয় এই উপন্যাসিকায়। দাম্পত্য ভালোবাসার আয়ূ অল্প কিছুদিন মাত্র, এমন একটা তত্ত্ব শুনিয়ে সহযাত্রীকে আকর্ষিত করে উপন্যাসের নায়ক ভাসিয়া পজদনিশেভ শুরু করে তার ব্যক্তিজীবনের কাহিনি শোনাতে।
অন্য দশটা তরুণ অভিজাত রুশ ছোকরার মতোই পজদনিশেভ বিয়ের আগে বেশ্যালয়ে গেছে প্রচুর। বিয়ের পর ‘ভালো’ হয়ে যাবে, এমনটাই তার ইচ্ছা ছিলো, এবং হঠাৎ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে (বলা ভালো, কামনায় গলে গিয়ে) সে এক সাধারণ মেয়েকে বিয়েও করে ফেলে। কিন্তু তারপর থেকেই যখন একের পর এক মতের অমিল ঘটে, তখন পজদনিশেভ বোঝে প্রেম নেই তাদের মাঝে। কামনার কারণে কখনো কখনো বিরতি এলেও ঝগড়াটাই জুড়ে থাকে দুজনের মাঝে সবটাই। একের পর এক সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মেয়েটিও হয়ে ওটে খিটখিটে।
ত্রিশ পেরিয়ে যখন মেয়েটির যৌবন আরেকবার ঝলসায়, গল্পে তখন এসে হাজির হয় আরেক জমিদার নন্দন ক্রখাচেভস্কি। স্ত্রী সাথে এই শৌখিন ভায়োলিন বাদকের খাতিরে পজদনিশেভের বুকে জমে তীব্র ঈর্ষা। এবং গল্পের শেষ পর্যায়ে বুকে ছুরি ঢুকিয়ে স্ত্রী’কে হত্যা করে লোকটা।
সংক্ষেপে এটুকুই ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’র গল্প। কিন্তু, লক্ষ করি পড়তে গিয়ে, তলস্তয়ের অন্যান্য উপন্যাসের সাথে কোথাও যেন পার্থক্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে এই লেখাটার।
তলস্তয়কে পড়তে গেলে কী ঘটে আমাদের মনে? বোধ করি, ঋষি সুলভ একটা সমাহিত ভাব নেমে আসে চারপাশে। নিজের চেয়ে উচ্চতর কিছু, যা মানুষের নাগালের বাইরেই থাকে চিরকাল, লেখকের অগাধ আস্থায় সেটার প্রতি সম্ভ্রম জাগে পাঠকের। তলস্তয় যখন চরিত্রের মুখ দিয়ে বলেন নিজের ভাবনা প্রবীণ কোনো বটের মতো লোকটার বিরুদ্ধতার কোনো ইচ্ছাই মনে জাগে না পাঠকের।
কিন্তু চেনা সেই অনুভূতিকে আমি খুঁজে পাই না ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ পড়তে গিয়ে। উপন্যাসের পাতায় পাতায় স্ত্রী আর পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে পজদনিশেভের পর্যবেক্ষণগুলো ক্যামন যেন স্মরণ করায় একালের ইউটিউবের বাংলা ওয়াজ। সঙ্গম যে বর্জনীয়, তেমন কথাও শুনি। তা হলে কি মানব সমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে না? তা হবে, কিন্তু বিজ্ঞানে এবং ধর্মগ্রন্থেও যে বলা আছে মানুষের বিলোপ ঘটবেই একদিন; এমন এক যুক্তিতে শ্রোতাকে যৌনতাহীন পৃথিবীর উৎকর্ষতার দিকে ইঙ্গিত দ্যায় পজদনিশেভ। পাঠকের খটকা তাই বেড়েই চলে।
আর সেই খটকা মনে নিয়ে যখন খানিক ঘেঁটে দেখি ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ সম্পর্কে, আবিষ্কার করি, এই অভিযোগ কেবল আমার মহামারী বন্দী মস্তিষ্কের কল্পনায় সৃষ্ট নয়। যৌন সম্পর্ক নিয়ে ভুগিচুগি বকার দায়ে এমিল জোলা থেকে শুরু করে থিওডর রুজভেল্ট পর্যন্ত এই লেখার কারণে ধুয়ে দিয়েছেন তলস্তয়কে। ১৮৮৯’তে প্রকাশের পরের বছরেই তলস্তয়ের এই উপন্যাসিকা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর রাশিয়ায়।
তা, চিঠি লিখে জারের কাছে সেই উপন্যাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার আবেদন করেন কে? তলস্তয়ের স্ত্রী সোফিয়া। এবং পাঠকের আগ্রহ বহুগুণে বাড়ে, যখন জানা যায় যে লেখালেখির কাজ ওখানেই না থামিয়ে, লাবণ্য দাশের মতো সোফিয়াও লিখে গেছেন কৌতূহল জাগানো একটি বই।
সে বই নিয়ে কথা বলবার আগে যোগ করা দরকার, যে ‘মাল্যবান’ উপন্যাসকে জীবনানন্দের জীবনের আয়না বিবেচনা করার মতোই, ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ও যে তলস্তয়ের জীবন থেকে নেওয়া; তা নিয়ে বহু পাঠকের সংশয় দীর্ঘদিন ধরেই নিরঙ্কুশ। উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পরে তলস্তয়ের পারিবারিক জীবন নিয়ে গোটা রাশিয়ার লোকই নাকি হতাশায় অ্যাকেবারে ভেঙে পড়ে। উপন্যাসে বর্ণিত স্ত্রী’টি যে কোনোক্রমেই তিনি নন, এটা বোঝাতেই নাকি সোফিয়া চিঠি লিখেছিলেন জারকে।
কিন্তু গণশত্রুতে পরিণত হয়ে লাবণ্য যখন কলম ধরে করেছেন কেবল আত্মরক্ষা, সোফিয়া তখন হেঁটেছেন একেবারে উল্টোদিকে। লেখা দিয়ে তিনি আক্রমণ করেছেন তলস্তয়কেই।
(৩)
জীবনানন্দের লুকিয়ে রাখার পাণ্ডুলিপির মতোই, মস্কোর তলস্তয় মিউজিয়ামের আর্কাইভ থেকে এক শতাব্দী পরে বেরিয়ে এসেছে সোফিয়া তলস্তয়ের বেশ কিছু লেখা। সেগুলোর সংকলন করেছেন মাইকেল আর কাটজ। তার ইংরেজি অনুবাদে ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা ভ্যারিয়েশনস’ নামের এই সংকলনে তলস্তয়ের পুত্র, কন্যার বেশ কিছু লেখার সাথে যুক্ত হয়েছে সোফিয়া তলস্তয়ের এক জোড়া উপন্যাসিকা, একটির নাম ‘সং উইদাউট ওয়ার্ডস’ (যেখানে বিবাহিত জীবনে অসুখী এক মহিলা প্রেমে পড়ে যায় এক সুরকারের, আর শেষে হারায় মানসিক ভারসাম্য); আর অন্যটির নাম ‘হু’জ ফল্ট?’ (যেখানে বিকারগ্রস্ত এক স্বামী ঈর্ষাকাতর হয়ে খুন করে তার নিরাপরাধ স্ত্রী’কে)।
এবং ‘হু’জ ফল্ট?’ উপন্যাসের পাঠকেরা দ্যাখে, কি নিদারুণ ভাবে তলস্তয়ের ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’র বিপরীত ভাষ্য তৈরি করেছেন সোফিয়া!
জানা যায়, এ উপন্যাসের নায়িকা আন্না ভালোবাসে লিখতে, ছবি আঁকতে। প্রিন্স প্রোজোরস্কির সাথে বিয়ে স্থির হলে সে ভাবে, যে নামী বংশের ওই ভদ্রলোকটির সাহচর্যে আরো বিকশিত হবে তার চারুবৃত্তিগুলো। কিন্তু বিয়ের ঠিক পূর্বেই যখন আন্না জানতে পারে যে প্রিন্স প্রজোরস্কি প্রাক-বিবাহ শারিরীক সম্পর্কে রীতিমতো খেলোয়াড়, ভেঙে পড়ে তখন তার মনোজগৎ। প্রিন্সের প্রতি শারিরীক একরকম বিবমিষা বোধ করতে থাকে আন্না, আর বিয়ের দিনটি থেকেই দূরে সরে যেতে থাকে স্বামী আর স্ত্রী’র জগৎ।
একাধিক সন্তান জন্মদানের পর স্বামীর আগ্রহ হারিয়ে গেলে আন্না নিজেকে ব্যস্ত করে সামাজিকতায় আর সখ্যতা গড়ে তোলে স্বামীর এক বন্ধু বেখমতভের সাথে (জানা যাচ্ছে, এই চরিত্রটি তলস্তয়ের এক বন্ধুর আদলেই গড়া, যার সাথে দর্শন বিষয়ে আলোচনা করতেন সোফিয়া)। এবং গল্পের শেষে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্ত্রী’র মাথায় পেপারওয়েট ছুঁড়ে মেরে তাকে হত্যা করে প্রিন্স।
দীর্ঘদিন ধরে সোফিয়াকে তলস্তয় পরিবারে গণ্য করা হয়েছে রীতিমতো শত্রু হিসেবেই। নশ্বর এক মহিলা, কাউন্ট তলস্তয়ের মহাপুরুষ হয়ে ওঠার পথে যে কেবলই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে; রাশানদের কাছে সোফিয়ার এমন একটা ভাবমূর্তিও তার তৈরি হয়েছে সময়ের সাথে। বলা বাহুল্য, সেই জনবিদ্বেষ প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে তলস্তয় ভক্তদের বিবিধ বিচ্ছিন্ন বয়ান। জীবনানন্দের যেমন ছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ, তলস্তয়ের ক্ষেত্রে তেমন ছিলেন ভ্লাদিমির চেরকভ; সোফিয়ার ওই অসংবেদনশীল ভাবমূর্তি তৈরিতে কাজ করেছিলো চেরকভের ব্যক্তিগত বিদ্বেষও। শিল্পীদের ভক্ত থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা ভুলে যাই ভক্তরা সময় কাটান কেবল শিল্পীর সাথে। অন্যদিকে শিল্পীর জীবনসঙ্গীকে যেহেতু ভক্তেরা দেখতে পান শিল্পীর চোখ দিয়েই, তার গল্পটা আর জানা হয়না কারোরই্; ফলে দুজনের দাম্পত্যের আরো গভীরে প্রবেশ না করেই ভক্তরা একটা মতবাদ খাড়া করে রাখেন।
চেরকভদের ওসব বয়ান তৈরি হয়েছে তাই পরে, কিন্তু তলস্তয়ের ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ প্রকাশিত হবার বলতে গেলে সাথে সাথেই সোফিয়া বসে গেছেন সেটার জবাব দিতে। লেখার চাইতে জবাব দেয়াটাই যে তার জন্য মুখ্য ছিলো, সেটার প্রমাণ মেলে ডায়েরির পাতায় উপন্যাসটার জন্য তিনি যে সব সম্ভাব্য নাম বিবেচনা করছিলেন, সেগুলোর দিকে তাকালেই।
- Is She Guilty?
- Murdered
- Long Since Murdered
- Gradual Murder
- How She Was Murdered
- How Husbands Murder Their Wives
শেষ পর্যন্ত ‘হু’জ ফল্ট?’ টাই থাকলো, কিন্তু আমরা বেশ বুঝতে পারি, যে নিজের বিবাহিত জীবনে ধীরে ধীরে খুন হওয়ার অনুভূতিটাই বেশ চেপে ধরেছিলো সোফিয়াকে। তলস্তয়ের সাথে বেড়ে চলছিলো তার মানসিক দূরত্ব। বিশেষ করে ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ প্রকাশের কিছুদিন পরে যখন তাদের ছোট ছেলে মারা যায়, সোফিয়া তখন ভালোই ভেঙে পড়েন।
ওই সংকটের সময় সোফিয়া সাহায্য পান তলস্তয়ের বন্ধু সুরকার তানিভের। কিন্তু সঙ্গীতকে কেন্দ্র করে দুজনের মাঝে যখন খাতির জমে ওঠে, তলস্তয় কিন্তু ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নিতে পারেননি। তিনি বাড়িতে আসতে বারণ করে দ্যান তানিভকে। পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ‘সং উইদাউট ওয়ার্ডস’ কিন্তু লেখা হয়েছে এমন একটা পটভূমিতেই!
তলস্তয়ের ওসব দ্বিচারিতা পাঠকের কাছে উন্মুক্ত হয়েছে ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ প্রকাশের সোয়াশো বছর পরে, যখন পাঠকের কাছে পৌঁছেছে সোফিয়ার লেখা। এবং তখন আবার নতুন করে চোখ খুলেছে অনেকে। আবিষ্কার করেছে, যৌনতাকে বর্জনীয় বলা তলস্তয় তার স্ত্রী’কে সন্তানসম্ভবা করেছিলেন ষোলোবার। তার মতো করে আদর্শ ক্রিশ্চানের পরিমিত জীবন যাপন করতে পারছে না বলে যে তলস্তয় বহুবার বকেছেন যে সোফিয়াকে, সেই সোফিয়ার ঘাড়েই তিনি চাপিয়েছেন তার বিশাল জমিদারি চালানোর দায়ভার।
‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’র বিশেষ একটা দৃশ্যের দিকে চোখ যায়। লক্ষ করি, যে তলস্তয় সুরকে বলছেন কামনার সবচাইতে বিশুদ্ধ রুপ। ভাবি, কামনা বা সঙ্গীতের প্রতি তলস্তয়ের বিতৃষ্ণার কারণ কি এটাই, যে সেটার আকাঙ্খাকে তিনি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি? এ ধারণা যদি সত্য হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সুরকার বন্ধু তানিভকে নিজের জমিদারি থেকে বিদায় করার ঘটনাটা যেন হয়ে থাকে অসহায় তলস্তয়ের দুর্বিনীত হয়ে ওঠার প্রতীকী চিত্র।
তলস্তয়ের মৃত্যুর পরে সোফিয়া কিন্তু তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে শান্তি খুঁজেছিলেন সুরের মাঝেই। সুরের প্রতি তার সেই ভালোবাসা জন্মেছিলো তানিভের সান্নিধ্যে এসে, ঠিক যেভাবে সাহিত্যের প্রতি একদিন তার ভালোবাসা জন্মেছিলো তলস্তয়ের সান্নিধ্যে এসে।
(৪)
‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’ পাঠের পর সোফিয়া তলস্তয়ের পাল্টা উপন্যাসের খবরটা পেয়ে বহুদিন পরে লাবণ্য দাশকে মনে পড়ে আমার। সেই লাবণ্য দাশ, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে হেঁটে চলা সংবেদনশীল স্বামীকে যিনি চিরকাল টেনে নামিয়েছেন বাস্তবতার রুঢ় পথে; সেই লাবণ্য দাশ, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বামী হিসেবে জীবনানন্দের অক্ষমতা তীব্রভাবে প্রচারের।
তারপর খেয়াল করতে বসি সোফিয়া তলস্তয়কে আবার। সেই সোফিয়া, শেষ জীবনে স্বামী তলস্তয় দূরে সরে গিয়ে যাকে করে তুলেছিলেন নিঃসঙ্গ; সেই সোফিয়া, মহাপুরুষ তলস্তয় যখন নেপোলিয়ানের ঘোড়ায় চড়ে জয় করছেন রাশিয়া, তখন ষোলোবার গর্ভধারণ করে অন্দরমহল থেকে যিনি সামলাচ্ছেন জমিদারি।
ভিন্ন সময়, ভিন্ন ভূগোল, ভিন্ন মানসের দুজন মানুষ। সাদৃশ্য কেবল একটাই; স্বামীকে যথেষ্ট সাংসারিক সুখ দিতে না পারায় পাঠকদের কাঠগড়ায় তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন আসামী হয়ে।
আবার কলম যখন ধরেছেন দুজন, বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে সেখানেও। বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়ে যাওয়া জীবনানন্দ, যিনি কিছুই রেখে যাননি স্ত্রী’র জন্য, মৃত্যুর পর তার ক্রমশ উঁচু হতে থাকা কীর্তির তলে মিইয়ে যাচ্ছেন লাবণ্য দাশ, স্মৃতিচারণায় স্বামীকে তিনি তুলে ধরছেন পাবলিকের চাহিদা অনুযায়ীই অনেকটা। অন্যদিকে সোফিয়া তলস্তয়, ‘দা ক্রয়েটজার সোনাটা’য় বর্ণিত দাম্পত্যকে তিনি নিচ্ছেন ব্যক্তিগত এক আঘাত হিসেবেই আর সেটার বিপরীতে স্বামীর জীবদ্দশাতেই তিনি লিখে ফেলছেন এমন উপন্যাস, যেখানে প্রবীণ বটের মতো তলস্তয়কে দেখাচ্ছে নিতান্ত নশ্বর এক মানুষ।
অক্ষরের মাঝ দিয়ে জীবনের অনেকটা কছাকাছি চলে আসা জীবনানন্দ দাশ আর লিও তলস্তয়ের পাশে তাদের স্ত্রী’দের রচনা বসালে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে আবিষ্কার করি, সংসার এক দীর্ঘ শীতরাত হয়ে ছিলো তাদের সকলের জন্যই। মোটরকারের দুনিয়ার বাইরে আরো এক জগৎ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকা জীবনানন্দ কিংবা তলস্তয়ের জন্যে বড় কঠিন ছিলো সহজ লোকের মতো চলতে পারাটা, তা বুঝি। কিন্তু এটাও অনুভব করি, নক্ষত্রের নিচে গভীরভাবে অচল স্বামীদের দিনের পর দিন মাটির পৃথিবীতে বয়ে নিতে গিয়ে অসংবেদনের দায় কাঁধে চাপে যে লাবণ্য কিংবা সোফিয়ার, তাদের রক্তের অন্তর্গত ক্লান্তিটিও কম নয় কিছু মাত্র।
সোফিয়া তলস্তয়ের ‘কে দোষী?’ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে তাই আমাদের হারাতে হয় দিশা। সন্ধ্যার নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন পথে যাবো?
[২০ জুন, ২০২০]
Leave a Reply