এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোকে নিয়ে আগেও লিখেছিলাম। দুর্দান্ত এক লেখক লোকটা। শব্দের ব্যবহারে তার চেয়ে পরিমিত গদ্যলেখক দেখিনি আর। ক্ষমতাসীনদের লেখা ইতিহাসকে ভেঙে চুরে গ্যালিয়ানো এমনভাবে তুলে ধরেন প্রাকৃতজনের বয়ান, সেটাকে কবিতা বললেই যেন মানায় বেশি।

গ্যালিয়ানোর আলোচিত বই মিররসঃ স্টোরিস অফ অলমোস্ট এভরিওয়ান থেকে নির্বাচিত কয়েকটা ভুক্তি এখানে অনুবাদের চেষ্টা করলাম। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, গ্যালিয়ানোর লেখার সৌন্দর্য্য আর কাব্যিকতার অনুবাদ আমার ল্যাংড়া কী-বোর্ডের সাধ্যতীত।

মার্কো পোলো
নিজের ভ্রমণকাহিনি শ্রুতিলিখনের সময়ে তিনি ছিলেন জেনোয়ার কারাগারে। কারাগারের অন্য বন্দীরা তার বলা সমস্ত গল্পই বিশ্বাস করতো। সাতাশ বছর ধরে প্রাচ্যের পথে পথে হেঁটে বেড়ানো মার্কো পোলোর অভিযানের কাহিনি শুনতে শুনতে প্রতিটি বন্দীই যেন ঘুরে আসতো কারাগারের বাইরে।

তিন বছর পরে, তিনি ভেনিস থেকে নিজের বই প্রকাশ করলেন। ‘প্রকাশ’ বলছি ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে প্রিন্টিং প্রেস আসতে তখনো দেরি। হাতে লেখা কয়েকটা কপি ঘুরে বেড়ালো পরিচিত মন্ডলে। অল্প যে কিছু পাঠক মার্কো পোলো পেয়েছিলেন, তাদের কেউ সেই বইয়ের একটা অক্ষরও বিশ্বাস করেনি।

লোকটা নিশ্চিত নেশার ঘোরে খোয়াব দেখেছে! যারা একটু ভদ্র-সভ্য, তারা বললো যে লোকটার বোধহয় মাথায় ঝামেলা আছে।

কাস্পিয়ান সাগরের পারে, আরারাত পর্বতের রাস্তায় এই পাগলা লোকটা নাকি তেলকে জ্বলতে দেখেছে, এরপর চীনের পাহাড়ে সে দেখেছে পাথর থেকে ধোঁয়া উড়তে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, লোকটা নাকি কাগজের টাকায় মঙ্গোল সম্রাটের প্রতীক দেখেছে, দেখেছে হাজারো মানুষকে বয়ে নেয়া জাহাজ। সুমাত্রা দ্বীপের ইউনিকর্ন আর আগুন না ধরা কাপড়ের গপ্পো শুনে লোকে মার্কো পোলোর কথা কিছুই বিশ্বাস করে না।

শত বছর পরে সব বেরিয়ে এলো।

জ্বলে ওঠা তেলটা ছিলো পেট্রোলিয়াম।
ধোঁয়া ওড়ানো পাথরটা ছিলো কয়লা।
চীনের মানুষ কাগুজে টাকা ব্যবহার করছে পাঁচশো বছর ধরে।
আর তাদের জাহাজগুলো ইউরোপিয়ান জাহাজের চাইতে আকারে দশগুণ বড়, সেখানে নিজস্ব বাগানও আছে যেথায় নাবিকেরা স্কার্ভি রোগে এড়াতে সবজি চাষ করে।
ইউনিকর্নটা ছিলো গণ্ডার।
আগুন নিরোধক কাপড়টা ছিলো অ্যাসবেস্টস।

মার্কো পোলোর সময়ে ইউরোপের লোকে এসবের কিছুই চিনতো না।

ডন কিহোতে
মার্কো পোলো তার বইটা লিখেছিলেন জেনোয়ার কারাগারে।

ঠিক তিনশো বছর পরে মিগুয়েল ডি সারভান্তেস অবশ্য লা মানচা গ্রামের ডন কিহোতে’কে নাইট উপাধি দিলেন সেভিলের কারাগারে, সারভান্তেস সেখানে বন্দী ছিলেন ধারের টাকা ফেরত দিতে না পারায়। গরাদের পেছনে সৃষ্টি হলো মুক্তির জন্য আরো এক সংগ্রাম।

মানুষ তাকে নিয়ে হাসবে, টিনের বর্মের আড়ালে কঙ্কালসার শরীর ঢেকে রাখা ডন কিহোতের জন্য সেটাই যেন চিরকালের নিয়তি। পাগলা এক লোক, যে বিশ্বাস করে সে নিজে কোনো বীরকাব্যের চরিত্র, আর বীরকাব্যগুলো সব ইতিহাসের বই।

কিন্তু, আমরা পাঠকেরা, তাকে নিয়ে হাসতে হাসতে তার সাথেও হাসি। বাচ্চাদের কাছেই কেবল ঝাড়ু হতে পারে ঘোড়া, কিন্তু লোকটার অভিযানের গল্প পড়তে পড়তে আমরাও আস্থা স্থাপন করি তার সেই বিশ্বাসে।

এই প্রতিনায়কটি আমাদের কাছে অ্যামন নায়কোচিত হয়ে ওঠে, যে তাকে নিয়ে আমরা কাল্পনিক গল্পও বানাই। ‘কুত্তাগুলা ঘেউ ঘেউ করছে রে সাংকো, মানে হচ্ছে আমাদের এগোতে হবে!’, স্প্যানিশ-ভাষী রাজনীতিকদের মুখে বহুল উচ্চারিত এই বাক্যটি আসলে ডন কিহোতে কখনোই বলেনি।

হোঁচট খেতে খেতে বিষণ্ণ মুখ এই নাইট হেঁটেছে সাড়ে তিনশো বছর। এমন কি চে গুয়েভারা যখন বাবা-মা’কে শেষ চিঠি লিখেছে, তখনো। বিদায়ী চিঠিতে চে কিন্তু মার্ক্সের কোনো বিপ্লবী বাণী ঝাড়েনি, সে লিখেছেঃ টের পাচ্ছি, আমার পায়ের তলায় এখন রোজিন্যান্ট। দিগ্বিজয়ে বেরোতে হলে আমার আর কোনো কিছুর দরকার নাই।

চে ঘর ছাড়লো। তবে সে জানতো, যে তার পথপ্রদর্শকের মতো সে হতে পারবে না কোনোদিন।

শ্রমিকের মজুরি
রোজিন্যান্ট- ডন কিহোতের ঘোড়াটা- নালিশ করতো না ঠিকই, অথচ নাইটের স্কোয়ার হিসেবে মজুরি নিয়ে সাংকো পাঞ্জা যথেষ্ট গাইগুঁই করতো। ক্ষুধা, চড় থাপ্পড়, বাজে আবহাওয়া আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি পেট ভরে? নগদ টাকা ছাড়া সবই মূল্যহীন।

তবে এসব বস্তুগত চাহিদা ডন কুইক্সোটের অ্যাকেবারে অসহ্য। তিনি কেবল বলেনঃ বেতনে কিচ্ছু এসে যায় না রে সাংকো, ভালো স্কোয়ারের আসল প্রাপ্তি হচ্ছে তার মনিবের সন্তুষ্টি!

এবং তিনি সাংকো পাঞ্জাকে প্রতিশ্রুতি দ্যান যে রাজ্যজয়ের পরে কীভাবে তাকে গভর্নর বানানো হবে, আর উপাধি দেয়া হবে মার্কুইস বা কাউন্টের।

কিন্তু বোকা সাংকো চাইতো কেবল নিয়মিত বেতনের একটা চাকরি।

চারশো বছর পরেও আমাদের মানব সভ্যতা খুব বেশি এগোতে পারেনি।

arton1358

ছবিঃ এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানো

বেথোভেন
তার শৈশবটাই ছিলো জেলখানার মতো, স্বাধীনতার স্বাদকে তিনি তাই ধর্মের মর্যাদা দিতেন।

এ কারণেই, নিজের তৃতীয় সিম্ফোনি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নেপোলিয়ানকে, আর পরে তিনি সেই নৈবেদ্য মুছেও ফেলেন।

লোকে কী ভাববে, সেই চিন্তা নিয়ে তিনি সুর সৃষ্টি করেননি;
রাজপুত্রদের তিনি পচাতেন,
সবার সাথেই তার ছিলো চিরকালের মতবিরোধ,
তিনি ছিলেন একাকী, দরিদ্র, টাকার অভাবে বাড়ি বদলেছেন সত্তরবার,
এবং তিনি ঘৃণা করতেন সেন্সরশিপ।

তার নবম সিম্ফোনিতে ফ্রেডেরিক শিলারের কবিতা থেকে নেওয়া ‘স্বাধীনতার জন্য শোক’ শিরোনামটা কর্তৃপক্ষ পালটে করে দিয়েছিলো ‘আনন্দের জন্য শোক’।

প্রতিশোধটা বেথোভেন নিলেন ভিয়েনার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। নবম সিম্ফোনির সেই অভিষেকে তিনি অর্কেস্ট্রা আর কোরাসটাকে পরিচালিত করলেন এমন দানবীয় উদ্যামে, যে সেন্সর করা ‘শোকগাঁথা’-টাই হয়ে উঠলো স্বাধীনতার জন্য গাওয়া স্তবগান।

অনুষ্ঠান শেষ হলে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন শ্রোতাদের দিকে পেছন ফিরে, শেষে একজন এসে তাকে ঘুরিয়ে দিলো।

কাফকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঢাক যখন বাজতে শুরু করেছে, কাফকা তখন লিখলেন মেটামোরফোসিস। আর অল্প কিছুদিন পরে, যুদ্ধ যখন চলমান, তিনি লিখলেন দা ট্রায়াল

সামষ্টিক এক দুঃস্বপ্ন ছিলো এই লেখা দু’টো।

প্রথমটায় এক লোক জেগে উঠলো দানবীয় এক পোকা হয়ে, কিছুতেই সে কারণটা বুঝে উঠলো না; শেষতক ঝাড়ুর বাড়ি খেতে খেতে সে মারা যায়।

অন্যটায় এক লোক আটক হয়, তার বিরুদ্ধে আনা হয় অভিযোগ, বিচার হয় তার, সে সাজা পায়; কিন্তু কিছুতেই সে কারণটা বুঝে উঠলো না; শেষতক সে মারা যায় জল্লাদের ছুরিতে।

এই গল্পগুলো, বইগুলো- ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হতে থাকলো সংবাদপত্রে; দিনের পর দিন যেই একই সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছিলো যুদ্ধের অগ্রগতি।

জ্বলজ্বলে চোখ আর কৃশকায় শরীর নিয়ে সেই লেখক লিখে গেলেন অস্তিত্বের তীব্রতম ক্ষোভ থেকে।

তিনি প্রকাশ করলেন সামান্যই, বলতে গেলে কেউই তাকে পড়লো না।

মরণও হলো তার নিঃশব্দে, তার জীবনের মতোই। মৃত্যুশয্যায়, ব্যাথার চোটে তিনি তার চিকিৎসককে বললেনঃ আমাকে মেরে ফেলুন, নইলে আপনি খুনী হয়ে থাকবেন!

একটি ফটোগ্রাফঃ গণশত্রু
বলশোই থিয়েটার স্কোয়ার, মস্কো, মে, ১৯২০।

পোলিশ বাহিনির সাথে ইউক্রেন ফ্রন্টে যুদ্ধে যাবার আগে লেনিন ভাষণ দিলেন সোভিয়েত যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে। ছবিতে লেনিনের পাশেই ছিলেন সেদিনের আয়োজনের আরেক বক্তা লিয়ন ট্রটস্কি এবং লেভ কামানেভ।

জি পি গোল্ডস্টেইনের তোলা এই ছবিটি দুনিয়াজোড়া হয়ে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থানের একটা প্রতীক হয়ে গেলো।

কয়েক বছর পরে অবশ্য ট্রটস্কি আর কামানেভের জায়গা হলো না ছবিতে, দুনিয়াতেও না।

তাদের মুছে দিতে ছবিতে বসানো হলো কাঠের সিঁড়ি। বাকি কাজটুকু জল্লাদই সেরে দিলো।

download

ছবিঃ সেই ফটোগ্রাফ, নিচের ছবিতে কায়দা করে মুছে ফেলা হয়েছে ট্রটস্কি কামানেভকে।

গুয়ের্নিকা
প্যারিস, ১৯৩৭।

পাবলো পিকাসো ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করতে করতে নিজের স্টুডিওতে পত্রিকা পড়লেন।

তার কফিটা ঠাণ্ডা হতে থাকলো।

গুয়ের্নিকা শহরটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে জার্মান বিমানেরা। তিন ঘণ্টা ধরে নাৎসিরা আকাশ থেকে তাড়া করে আর গুলি মেরে শেষ করেছে শহরটা থেকে পালাতে থাকা লোকজনদের।

জেনারেল ফ্রাঙ্কো অবশ্য দাবি করলো যে কম্যুনিস্ট বলে আস্তুরীয় আর বাস্ক লোকজনই বোমা আর আগুনে শহরটার ওই দশা করেছে।

দু বছর পরে, মাদ্রিদের বিজয় দিবসের প্যারেডে ফ্রাঙ্কোর পাশে জায়গা হলো স্পেনে নিয়োগকৃত জার্মান সেনাপ্রধান উইলফ্রেম ভন রিখটোভ্যানের। স্প্যানিয়ার্ডদের মেরে হিটলার আসলে হাত গরম করছিলো আসন্ন যুদ্ধের জন্য।

বহু বছর পরে, কলিন পাওয়েল নিউইয়র্কে বসে জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে ভাষণ ছাড়লেন ইরাক নামের দেশটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

তার বক্তব্যের সময় ঘরের পেছন দিকটা ঢেকে রাখা হয়েছিলো। পিকাসোর ছবি গুয়ের্নিকার একটা নকল ছিলো ওই ঘরটায়, বিশাল একটা নীল কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছিলো সেটাকেও।

জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের মনে হয়েছিলো যে নতুন করে মানুষকে জবাই করবার ঘোষণা দেয়ার সময় পেছনে ওই ছবিটা থাকলে সেটা খুব বেশি মানানসই হবে না।

ইউরোপের দান
বেলজিয়াম যখন কঙ্গোকে ছেড়ে গেলো, সরকারি পদে তখন কঙ্গোর লোক ছিলো সর্বমোট তিনজন।

গ্রেট বৃটেন যখন তানজানিয়া ত্যাগ করলো, দেশে তখন প্রকৌশলী ছিলো দুজন আর চিকিৎসক ছিলো বারো জন।

স্পেন যখন ত্যাগ করলো পশ্চিম সাহারা, সে দেশে তখন চিকিৎসক, আইনজীবী আর অর্থনীতিবিদ ছিলো একজন করে।

আর পর্তুগাল যখন ছেড়ে গেলো মোজাম্বিক, দেশটায় তখন অশিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ, নেই কোনো স্নাতক ছাত্র কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।

ঔদ্ধত্য
১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে পেরুর ফুটবল দলের কাছে হেরে গেলো হিটলারের জন্মভূমি।

ফুয়েরারের রোষ এড়াতে যা যা সম্ভব, রেফারি তার সবটাই করেছিলো। কিন্তু তিনটা গোল বাতিল করেও লাভ হয়নি, অস্ট্রিয়া ঠিকই হেরে গেলো ২-৪ গোলে।

পরেরদিন অবশ্য অলিম্পিকের ফুটবল কমিটি ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে ফেললো।

খেলাটা পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হলো। তবে ‘কৃষ্ণ দানব’ বলে পরিচিত দুর্দান্ত একটা আক্রমণ ভাগের কাছে আর্যদের হেরে যাওয়া নয়, কর্মকর্তারা কারণ হিসাবে বললেন যে পেরুর সমর্থকেরা খেলা শেষ হবার আগেই মাঠে নেমে পড়েছে।

পেরু অলিম্পিক বর্জন করলো, হিটলারের জন্মভূমি জিতলো রৌপ্য পদক।

ইতালি, মুসোলিনির ইতালি, স্বর্ণপদক জিতেছিলো।

পেলে
ইংল্যান্ডের দুটো দল শিরোপার জন্য খেলছে। শেষ বাঁশি বাজতে বেশি দেরি নেই আর, কিন্তু খেলায় এখনো সমতা। ঠিক এমন সময় মাঠে একজন খেলোয়াড় পড়ে গেলো সংঘর্ষে।

স্ট্রেচারে করে লোকটাকে নিয় যাওয়া হলো মাঠের বাইরে। মেডিক্যাল টিম লেগে গেলো খেলোয়াড়ের শুশ্রূষায়, কিন্তু তার জ্ঞান আর ফেরে না।

মুহুর্ত যায়, শতাব্দী যায়, কোচ মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে অপেক্ষা করে খেলোয়াড়টি ফিরবে বলে। সমস্ত বদলি সে করে ফেলেছে, মাঠে তাই তার দল এখন লড়ছে এগারো জনের বিপক্ষে দশ জন নিয়ে।

কোচ যখন বুঝতে পারছিলেন যে পরাজয়টাই তার আজকের নিয়তি, তখনই দলের ডাক্তার ফিরে এলো উত্তেজিত গলায় চিৎকার করতে করতে, ‘আসছে! আসছে! এখনই সে মাঠে নামবে!’

তারপরই লোকটা গলা নামিয়ে যোগ করে, ‘কিন্তু মাথায় আঘাত পেয়েছে, ছেলেটা এখন কিছুই মনে করতে পারছে না।’

বিড়বিড় করতে থাকা খেলোয়াড়টির দিকে এগিয়ে যায় কোচ, কানে কানে তাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘চিন্তা করো না। আরে তুমি তো পেলে!’

খেলাটা তারা জেতে ৫-০ গোলে।

বহু বছর আগে লন্ডনে আমি এই বানোয়াট গল্পটা শুনি। মিথ্যা কাহিনিটাই আমাকে সত্যটা জানিয়ে দিয়েছিলো।

ম্যারাডোনা
আগে কখনোই তারকা ফুটবলারেরা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেনি ফুটবলের বড়কর্তাদের। কিন্তু সর্বকালের সবচেয়ে বিখ্যাত আর জনপ্রিয় খেলোয়াড়টি সবসময় নিজেকে এগিয়ে দিয়ে রক্ষা করে গেছে অন্য সব খেলোয়াড়দের, যারা বিখ্যাত নয়, জনপ্রিয়ও নয়।

এই মহাতারকা পাঁচ মিনিটের ভেতরে দিয়েছিলো খেলাটার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত দুটো গোল। জ্বলজ্যান্ত শিল্পের মতো গোলটা, যেটা এসেছিলো শয়তানের মতো যাদুময় পা দিয়ে, সেটার চেয়ে বোধহয় অন্য গোলটার জন্যই ভক্তরা তাকে প্রণাম জানায় বেশি, যেটা লোকটা দিয়েছে চোরের মতো, পকেটমারের চেয়েও নিপুণ হাতসাফাইয়ে।

লোকে দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনাকে ভালোবেসেছে তার অলৌকিক কারিকুরির জন্য। এবং এজন্যেও, যে মানুষটা ছিলো পাপী, দেবতাদের মাঝে সবচেয়ে মানবিক। লোকটার মাঝে সবাই লক্ষ করেছে মর্ত্যের মানুষের সমস্ত দোষগুণের সংশ্লেষ, অন্ততঃ পুরুষের সমস্ত দুর্বলতা তার মাঝে বিদ্যমান ছিলো পুরো মাত্রায়। সে ছিলো নারীলোভী, পেটুক, মদ্যপ, জালিয়াত, মিথ্যুক, দাম্ভিক আর চূড়ান্ত রকমের দায়িত্বজ্ঞানহীন।

কিন্তু দেবতারা, যতই মানবিক হন না ক্যানো, অবসরে নেন না কখনোই।

যেখান থেকে সে উঠে এসেছে, সেই নামপরিচয়হীন মানুষের ভিড়ে লোকটা কখনো ফিরে যেতে পারেনি আর। যে খ্যাতি তাকে মুক্তি দিয়েছিলো দারিদ্র্য থেকে, সেটাই তাকে বন্দী করে ফেলেছিলো।

ম্যারাডোনার শাস্তি ছিলো এই, যে তাকে সারাজীবনই বিশ্বাস করতে হয়েছে সে ম্যারাডোনা, সব সময়ে সকল কিছুই চলবে তাকে কেন্দ্র করে।

পেশাব বা রক্ত পরীক্ষা কখনো নির্ণয় করতে পারেনি যে সাফল্যের জন্য লোকটা কী মাদক নিতো, আমরা কেবল জানি যে সেটা ছিলো কোকেনের চাইতেও ভয়ানক।

[১১ জুন, ২০২০]