২০২০ এর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর কয়েকটাকে নিয়ে আমার এলোমেলো পাঠানুভূতি গুছিয়ে রাখার জন্য এই সিরিজ। আজ রইলো চতুর্থ পর্ব (সিরিজের সবগুলো কিস্তি পাওয়া যাবে এইখানে)।

নভেম্বর ১৯৭৫

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের পরেই সবচেয়ে আলোচিত সময়কালটি ১৯৭৫। ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাসের যে বাঁকটায় চলে যায়, সেই রাস্তা ধরেই হেঁটে ৭৫’ এর নভেম্বর মাস জন্ম দিয়েছে অভূতপুর্ব সব নাটকের। ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত নভেম্বর ১৯৭৫ এ, নজরুল সৈয়দের গবেষক চোখ চেষ্টা করেছে সেইসব নাটকের পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে।

ব্যক্তিগত আঙিনায় নজরুল সৈয়দের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, সেই ঘনিষ্ঠতা অ্যাতোই গাঢ়, যে সেটার ফাঁক গলে অপরের রাজনীতিমনস্কতার প্রকৃতিও অনেকটা আমাদের উভয়েরই জানা। ফলে,  নভেম্বর ১৯৭৫ নিয়ে আগ্রহের আমার কমতি ছিলো না পাঠক হিসেবে।

তা, বইটা পড়া শেষে ক্যামন নিবৃত্তি হলো সেই আগ্রহের? এক কথায় বলতে গেলে, চমৎকার। লেখকের খাটনিটা টের পাওয়া যায়। নভেম্বরের সাত তারিখের পর যদি বর্ণনা আরেকটু বিশদ হতো তাতে ভালো লাগাটা খানিক বাড়তো ঠিকই, কিন্তু এটাও আমাদের জানা, যে যা লেখা হয়নি, তার জন্য লেখককে অভিযুক্ত করা যায় না কিছুতেই।

কী আছে নজরুল সৈয়দের এই সংকলনে? সোজা বাংলায় বললে, আমাদের পরিচিত অনেক ঐতিহাসিক বয়ানের মাঝের অসামঞ্জস্য বের করে আনার চেষ্টা আছে।

১৫ আগস্টের রাতে আমাদের সমরনায়কদের অনেকের নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন ভাবে বর্ণিত হয়েছে নানা জায়গায়। নজরুল চেষ্টা করেছেন বঙ্গভবনের বাগান আর ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ছড়িয়ে থাকা সেই বিচ্ছিন্ন সুতোগুলো জোড়া লাগাতে। সহায়ক গ্রন্থগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে ইতিহাসের পাতায় সমীহ জাগানো বেশ কিছু নামের দিকে অভিযোগের স্পষ্ট আঙুল তোলেন নজরুল, এবং সেই অভিযোগ মোটেও নড়বড়ে নয়। ব্যক্তিগত ভাবে বোধ হয়, বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় প্রতিটি মানুষের একে অপরের সাথে যে লতায় পাতায় আত্মীয়তা এবং তৎকালীন সেনাবাহিনিতে যে চেইন অফ কমান্ডের অভাব, এই দুই বিবেচনায় নজরুলের থিসিসটি প্রমাণ করা সম্ভব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বহু নায়কের ক্ষেত্রেই।

সংকলনটির খামতি যদি বলতে হয়, তো রকে বসা আড্ডাবাজ বড়দার মতো একটু গলা ভারি করে বলাই যায় যে পুরো আলোচনায় কোথাও খন্দকার মোশতাকের মার্কিন লবি এবং বেসামরিক শাসনতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রসঙ্গটা উঠে আসেনি। কিন্ত চায়ের টেবিলের সর্বজ্ঞ বড়দার সাথে সমস্ত মিলে যাবে তো নজরুল সৈয়দের আর আলাদা করে গবেষণা করা ক্যানো? ইতিহাসের ব্যক্তিগত অনুবাদ সমস্ত মানুষই যে নিজের ভাষায় করে, সেই সত্য মেনে না নেওয়া ঘাড়ত্যাড়ার সাথে তর্ক পাঠক তো পাঠক, পাঠকের বাপেরও করা সাজে না।

মানিব্যাগের ভেতরে সত্য না গুঁজে একটু উন্মুক্ত মনে যারা ঢুকতে চান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটু গভীরে, নজরুল সৈয়দের নভেম্বর ১৯৭৫ তাদের জন্য চমৎকার একটা সুড়ঙ্গ।

টুকে রাখা কথামালা

গদ্যকার কি কেবল গল্প লেখে? বা উপন্যাস? নাহ, প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসে গল্প উপন্যাস ছাড়াও তাকে মোকাবেলা করতে হবে বহু এলো ভাবনার। আমার মতো স্বকৃত নোমানও তেমনটাই ভাবেন, টুকে রাখা কথামালা তার সেই বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোর অক্ষরবদ্ধ প্রকাশ।

বাছাই করা ১০০টি ভাবনা নিয়ে খাড়া করা হয়েছে টুকে রাখা কথামালা সংকলনটা। তবে প্রকৌশলীর সাথে লেখকের তফাৎ এইখানে, যে অংক কষে তৈরি নয় বলে সবগুলো কলামই সিধা হয়ে ছাদ স্পর্শ করে না। টুকরো লেখার ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা আরো বাড়ে।

তবু ভালো লাগে দেশভাগের বেদনাকাতর অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, কিংবা লেখকের গুরু সেলিম আল দীনকে নিয়ে লেখাগুলো। মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরব, নাগরী সাহিত্য আর রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বিষয়ক বয়ানরাও আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় গুরুত্ব্বপূর্ণ। চর কুকরি মুকরির কালাপীর অথবা সুধীর চক্রবর্তীর গভীর নির্জন পথে নিয়ে যখন নোমান লেখেন, টের পাওয়া যায়, বিশাল বাংলার লোকায়ত বিধান বা আচার নিয়ে কথা বলতে হলে তার কীবোর্ডটি মোটেও ল্যাংচায় না। তবে উলটো পিঠে, তার সাথে বোধহয় খানিক দূরত্ব তৈরি হয় ভিনদেশি সাহিত্যের। তাইয়েব সালেহ কিংবা মারিয়া রেমার্কদের নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাই নোমানের কলমটি বারবার কাশে, দমকের চোটে কথা হয় আড়ষ্ট।

সেই আক্ষেপ আর কিছু বিষয়ে নিরঙ্কুশ সংশয়হীন থাকার ব্যাপারটি বাদ দিলে স্বকৃত নোমানের টুকরো কথা পড়তে খারাপ লাগে না। সমকালীন একজন লেখকের জার্নাল হিসাবে দুই বসাতেই পড়ে শেষ করা যায় আস্ত সংকলনটাকে।

হেমিংওয়ের সঙ্গে

আরভিং স্টোন বা নারায়ণ স্যানাল ঘরানার উপন্যাস জীবনী হাসনাত আবদুল হাই পূর্বেও লিখেছেন। সুলতান, নভেরা, একজন আরজ আলী, লড়াকু পটুয়া নামের সেই চারটি উপন্যাস-প্রচেষ্টাই পড়া হয়েছে  আমার আগে। তবে প্রথম দুটো মনে যতটা দাগ পড়েছিলো, পরের দুটোর ক্ষেত্রে তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি আমার। আয়তনের অপেক্ষাকৃত স্বল্পতাই কারণ সেটার? তলিয়ে ভাবিনি। কিন্তু প্রিয় লেখক সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে হাসনাত এক ঢাউস কলেবরের উপন্যাস লিখেছেনে জেনে একুশে বইমেলা থেকে হেমিংওয়ের সঙ্গে নামের সেই বই সংগ্রহ করতে আমার দেরি হয় না।

অথচ পড়ার পরে কিন্তু উপন্যাস জীবনী মনে হয় না আর বইটাকে। সৈয়দ হককে অনুসরণ না করে হাসনাত হেঁটেছেন হকের সহধর্মিনী আনোয়ারা সৈয়দ হকের যাপিত জীবনের ভাষ্যের কমেন্ট্রি দেওয়ায়। আনোয়ারা সৈয়দ হক নিজেও একজন লেখক, হাসনাত যেন পাঠকদের দেখাতে চাইলেন সেই স্ত্রীর চোখে লেখক সৈয়দ হকের মূর্তি। একান্ত মুহুর্তে সৈয়দ হককে হেমিংওয়ে বলেই সম্বোধন করতেন আনোয়ারা, এই উপন্যাস জীবনী যেন সেই ডাকের ওপারে যেতে চাইলো না।

অথচ সুযোগটা ছিলো লেখকের সামনে। বর্ণাঢ্য জীবন ছিলো সৈয়দ হকের। গল্পের কল থেকে কবিতার কিমিয়া, নাটকসরণির পায়ের আওয়াজ থেকে রঙিন পর্দার দম ফুরাইলেই ঠুস শব্দ পর্যন্ত সব্যসাচী মানুষটার বিস্তার। অভিজ্ঞতা বিবেচনায় উপন্যাসের আকারে সৈয়দ হকের জীবনী আনতে হলে হাসনাতের চাইতে যোগ্য লোকও খুঁজতে চশমা লাগাতে হবে চোখে। তবু ক্যানো যেন প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো না বয়ানটায়, এটা হয়ে রইলো আনোয়ারার সাথে সৈয়দ হকের পরিচয়পর্ব আর ক্যানসার আক্রান্ত সৈয়দ হকের জীবনের শেষ কিছুদিনের দিনলিপি।

রোগশয্যায়ও আশ্চর্য সচল ছিলো সৈয়দ হকের করোটি। ক্যান্সারের কেমো নিতে নিতেও কী করে তিনি নিজের মতো করে দাঁড় করাচ্ছেন শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট; সেই ঘটনা প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া নিকোলাই অস্ত্রভস্কির হাতে ইস্পাত রচিত হবার মতোই রোমাঞ্চকর হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে লেখকের শক্ত চোয়ালের সেই প্রতিজ্ঞা, লেখা ও না লেখার মাঝের সেই মানসিক যাতনা; এসবের কিছুই এলো না হেমিংওয়ের সঙ্গে এর বয়ানে। আগ্রহী পাঠকের মনে বইয়ের প্রথম থেকেই জমতে থাকা হতাশাটা, এ পর্যায়ে এসে রীতিমতো পাথর হয়ে উঠলো।

তবে, উপন্যাদের স্বাদটা পুরো মাত্রায় না পেলেও পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণের বিভিন্ন বর্ণিল চরিত্র আর সৈয়দ হকের জীবনের শেষ দিনগুলোর জার্নালকে যে এক মলাটে নিয়ে আসেন হাসনাত আবদুল হাই, সে জন্য পাঠকের একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য। আমরা আশা করবো, অনাগত দিনের কোনো লেখক হয়তো হেমিংওয়ের সঙ্গে -কে দেখেই হাত দেবেন জলেশ্বরীর যাদুকর সৈয়দ হককে নিয়ে বিস্তৃত কোনো উপন্যাস লেখার কাজে।

[২১ মে, ২০২০]