(১)
নিখুঁত লেখা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, যেমন নেই নিরেট কোনো হতাশা।
হারুকি মুরাকামির প্রথম উপন্যাস ‘হিয়ার দ্যা উইন্ড সিং’ শুরু হয়েছে অন্য কোনো লেখকের মুখে শোনা এই বাণী উদ্ধৃত করে।
(২)
ঢাকা শহরের অজস্র রাজপথ, কিংবা তা হতে উদ্ভূত ভেতরের গলি, তস্যগলির মাঝে কিছু রাস্তা আমরা নিজস্ব বলে চিহ্নিত করে রাখি। কারো জন্য সেটা হতে পারে মাসুদের দোকান, কারো জন্য সেটি চাচীর টং, কারো জন্য বরাদ্দ থাকে বারেক স্টোরের বেঞ্চি। জানেন আড্ডাপ্রেমী মানুষ মাত্রই, এ জাতীয় আড্ডাগুলো মুখর হয়ে থাকে বিবিধ প্রশ্ন, বিচারকাজ এবং আক্ষেপে।
তো, এমনই এক সন্ধ্যায়, ঢাকার বুকে তুমুল আড্ডা জমে কোথাও আর বহুমুখী গতিতে সেটার দিকও বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। কে জানে কীভাবে, তখন হঠাৎ প্রশ্ন উঠে যায় যে কথাসাহিত্যের আসল কাজ কী। হাজার না হোক, কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই জিজ্ঞাসার মুখে দাঁড়িয়ে আলোচকরা কয়েকটা পক্ষ নিয়ে ফেলে তখন। কেউ বলে গল্প বলাই কথাসাহিত্যের কাজ, কেউ বলে সেটার কাজ সৌন্দর্য্য সৃষ্টি। নিজে থেকে এই জব রেস্পন্সিবিলিটি নির্ধারণ করতে অক্ষম হওয়ায় কেউ আবার বঙ্কিমচন্দ্রকেও ডেকে আনে, বলে যে সাহিত্যের কাজ সত্য উদ্ঘাটন।
আর তার্কিকদের মুখের কোণায় ফেনার সাথে তর্ক যখন এভাবে জমে ওঠে, আড্ডারই কোনো একজন তখন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বক্তব্য দেয়, যে এসবের বাইরেও তো কথাসাহিত্যের কোনো কাজ থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে হারুকি মুরাকামির নামটাই। মুরাকামির উপন্যাসে কি নিখুঁত কোনো গল্প পড়ার স্বস্তি দ্যায় আমাদের? তার উপন্যাসের জগৎ- ভারি বিচিত্র আর বেখাপ্পা সেটা- কি পরিপূর্ণ কোনো সৌন্দর্য্যের অনুভূতি তৈরি করে মনে?
তাহলে ঠিক কীভাবে কাজ করে মুরাকামির উপন্যাস?
প্রশ্নটা ছুটে আসে আমার দিকেই, এবং উত্তর দেয়ার আগে আমি একটু ভাবি।
(৩)
সত্যি বলতে, হারুমি মুরাকামি আমায় ভাবিয়ে আসছেন অনেকদিন ধরেই।
যখন আমরা কোনো উপন্যাস পড়তে বসি, আমাদের যেন মনে হয় দৃশ্যমান শব্দগুলোর আপাত অর্থের ভেতর দিয়ে লেখক আরো কিছু বলতে চাইছেন। উপন্যাসের পাঠক, লেখকের ব্যবহৃত সমস্ত প্রতীক আর বর্ণনার কোনো গভীরতর অর্থ নির্ণয় করতে চায় তখন। পদ্মা নদীর বর্ণনা থেকে মানিক যখন ক্যামেরার লেন্সের মতো পাঠকের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সেটাকে নিবদ্ধ করেন ইলিশ মাছের ওপর, পাঠক তখন প্রস্তুত হয় এই মাছধরাকে কেন্দ্র করে ‘কিছু একটা’ ঘটতে দেখার জন্য। আবদুল মজিদের স্যান্ডেল যখন ছিঁড়ে যায়, পাঠক তখন শহীদুল জহিরকে সাথে নিয়ে প্রস্তুত হয় ছেঁড়া স্যান্ডেলের মতো অস্বস্তিকর ‘কিছু একটা’-র মুখোমুখি হবে বলে।
কিন্তু মুরাকামির উপন্যাসে পাঠক যখন চেষ্টা করে বুদ্ধি দিয়ে যুক্তি দিয়ে বিবিধ প্রতীক আর ঘটনার অর্থ বের করতে, শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ হতে হয় তাকে তখন। ক্যানো হাইদার বাবাকে রহস্যময় এক গল্প শোনায় মিদোরিকাওয়া নামের সেই পিয়ানিস্ট (কালারলেস সুকুরু তাযাকি এন্ড হিজ ইয়ার্স অফ পিলগ্রিমেজ)? ক্যানো তোরু ওকাদার গালে হঠাৎ করেই ভেসে ওঠে নীল রঙের অমোচনীয় এক দাগ (দ্যা উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল)? গল্পের নায়ককে ক্যালিফোর্নিয়া গার্লস গানটা উৎসর্গ করে কোন্ মেয়েটি ফোন করে রেডিওতে (হিয়ার দ্যা উইন্ড সিং)?
উত্তর না পাওয়া এমন অনেক ব্যাখাতীত ঘটনাই, মুরাকামি রেখে যান তার উপন্যাস জুড়ে। ফলে শব্দের ভেতরে অন্য কোনো গভীরতর অর্থ আবিষ্কার করতে ব্যস্ত পাঠকের যে গোয়েন্দা মন, সেটা তখন ক্ষান্ত দেয় প্রচেষ্টায়। অথচ, সে অবাক হয়ে দ্যাখে, গল্পটা কিন্তু বেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
ফলে আগ্রহী পাঠকের তখন করার থাকে একটিমাত্র কাজ, করোটির নিচের সচল মনটাকে বিশ্রাম দিয়ে মুরাকামির গল্পে হৃদয়টাকে ছেড়ে দেওয়া। পাঠকের নিয়ন্ত্রণ এখন থেকে মুরাকামির হাতে।

হারুকি মুরাকামি (ছবিঃ গুডরিডস)
(৪)
বহু লেখকের উপন্যাসেই এক ধরনের ছকের পুনরাবৃত্তি আবিষ্কার করা যায়। প্রিয় গল্পকার হুমায়ূন আহমেদকেই ধরি উদাহরণ হিসেবে। তার অধিকাংশ উপন্যাসে বন্ধনহীন এক যুবক যাকে, থাকে রুপবতী এবং খেয়ালি কোনো তরুণী, আপাত সৎ কিন্তু জীবনে বড় আকারের অপরাধ করা কোনো চরিত্র থাকে, থাকে বিকারগ্রস্ত কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যিনি উচ্চারণ-অযোগ্য কথা বলেন অনবরত; আর থাকে চমৎকার কিছু বাক্যবন্ধ, যারা শুনতে শ্রুতিমধুর তো বটেই, আবেগ মথিতও হয়ে পড়া যায় তাদের পড়লে, অথচ সেগুলো তেমন কোনো অর্থ বহন করে না প্রায়ই। জঁরা উপন্যাসের দুনিয়া থেকে উদাহরণ হিসেবে টানা যায় ড্যান ব্রাউনকেও। শুরুতেই খুন, কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে জুড়ে যাওয়া সুন্দরী এবং বিদুষী কোনো নারী, একের পর এক সংকেতের রহস্যভেদ (কোড ব্রেকিং), চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার ইঁদুর দৌড়ে শহর কি দেশের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়ানো; ব্রাউনের উপন্যাস যতদিন পড়েছি, সেগুলো এগিয়েছে এমন চেনা ছকেই।
এসব উপন্যাসের সাথে কোনো পরিস্থিতিতেই তুলনা টানা যায় না হারুকি মুরাকামির, কিন্তু এটাও আবিষ্কার করি কৌতূহল নিয়ে, যে তার উপন্যাসেও পুনরাবৃত্তি আছে এক রকমের ছকের।
মুরাকামির উপন্যাসে মূল চরিত্রটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাকী কোনো পুরুষ। একাকী হলেও নারীবর্জিত সে নয়, বরং তার জগৎ আবর্তিত হয় একাধিক নারীকে কেন্দ্র করে, সাধারণ ভাবে দুই জন। দুজনের এক জন বাঁচতে চায় মুহুর্তকে ঘিরে; সে হয় উদ্দাম, অগোছালো, তাকে ঘিরে থাকে রহস্যময়তার মোড়ক। আর অপর নারীটি হয় গোছালো, মিষ্টি হাসির ব্যক্তিত্বময়ী, সঙ্গী হিসেবে যার হাত ধরলে জীবন অনেক সহনীয় হয়ে পড়ে পুরুষের। মোটা দাগে মুরাকামির উপন্যাসের নায়কের জীবনের দুই পর্বে উপস্থিত থাকে এই দুই বিপরীত প্রকারের নারীরা।
উপন্যাসের নায়ক কখনো জীবনের দ্বিতীয় পর্বে এসে অনুসন্ধান করতে চায় প্রথম পর্বে ঘটে যাওয়া কোনো রহস্যময় ঘটনা কি অদ্ভুত স্মৃতির ব্যাখ্যা (স্পুটনিক সুইটহার্ট, কালারলেস সুকুরু তাযাকি…), আবার কখনো বা নায়কের শান্ত জীবন হঠাৎ বাধ্য হয় কোনো অভিযানে নামতে আর সেই যাত্রায় তার সঙ্গী হয় একের পর এক নারী (কাফকা অন দা শোর, দ্যা উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল)। এবং কোনো একটা প্রশ্ন বা উদ্দেশ্য নিয়ে মুরাকামির নায়কের এই যে যাত্রা, সে অভিযানে সবসময়ই উপস্থিত রয় অদ্ভুত কিছু চরিত্র, যৌনতার তীব্র ছাপলাগা কিছু মুহুর্ত, কিছু আশ্চর্য বাস্তব স্বপ্ন, কিছু ব্যাখ্যাতীত ঘটনা। মুরাকামির উপন্যাস এগিয়ে যায় এসব অনুষঙ্গ সাথে করে।
তবে চেনা ছকের বাইরেও তো উপন্যাস লিখেছেন মুরাকামি। ‘আফটার ডার্ক’ উপন্যাসে যেমন ব্যাখ্যাতীত ঘটনার ঘনঘটা একটু বেশিই, তেমনই তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘নরওয়েজিয়ান উড’ তো আগাগোড়াই বাস্তবতায় ভর করে দাঁড়ানো (প্যারিস রিভিউ’তে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুরাকামি অবশ্য এ উপন্যাসকে বলছেন ‘স্ট্র্যাটেজিক চয়েস’)।
খেয়াল আরো করা যায়, মাঝবয়েসি তোরু ওকাদা হোক, কিংবা বালকবেলার তামুরা কাফকা; মুরাকামির উপন্যাসের নায়কদের ওপর কোনো পিতৃসুলভ চরিত্রের চোখ রাঙানি থাকে না। ফলে কোনো কর্তৃপক্ষের বাড়াবাড়ি ছাড়াই মুরাকামির প্রোটাগনিস্ট নিজের উত্তর খুঁজে বেড়ায়।
(৫)
উপন্যাস পড়তে বসা মাত্রই পাঠক আসলে লেখককে এক রকমের ছাড়পত্র দিয়ে দ্যায়, বিভ্রান্ত করবার ছাড়পত্র। উপন্যাস জীবনের একটা বর্ণনা ছাড়া কিছু নয় জেনেও পাঠক বিভ্রান্ত হতে চায়, শব্দের মাঝে জীবন আবিষ্কার করতে চায়। ঠিক যেভাবে পুকুরের মাছ প্রস্তুত থাকে টোপ গিলতে। কিন্তু উপন্যাসের পাতায় পাঠকের জন্য টোপ হিসাবে লেখক কী রাখেন? রাখেন স্থান বা কালের বিভিন্ন স্মারক। অর্থাৎ রাস্তা কি মনুমেন্টের নাম, চেনা কোনো মানুষ বা স্মরণীয় কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা।
তবে এমন চেনা কোনো টোপ ছাড়াই অদ্ভুত ভাবে পাঠককে উপন্যাসে টেনে নিতে পারেন হারুকি মুরাকামি । হ্যাঁ, মুরাকামির উপন্যাসেও রাজনীতি কি ইতিহাস একদম অনুপস্থিত নয়। ‘দ্যা উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল’ উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা, ষাটের দশকের টোকিও ছাত্র আন্দোলন দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে ‘নরওয়েজিয়ান উড’ এর ওপর। কিন্তু এটাই সত্যি যে মুরাকামির জগতে চলে যেতে এসব টোপ প্রয়োজন হয় না পাঠকের, বরং ওই জগতটা পাঠককে ক্রমাগত ভুলিয়েই চলে রাজনীতি কি ইতিহাসের অস্তিত্ব।
তাহলে ঠিক কীভাবে মুরাকামি ধরে রাখেন, বিভ্রান্ত করেন পাঠককে?
বোধ হয়, তেমন দুটো উপাদান রয়েছে তার লেখায়, যার প্রথমটা সরলতম গদ্য। গল্প যতই এলোমেলো লাগুক, মুরাকামির ভাষা ভারি ঝরঝরে। প্রায় সর্বদা উত্তম পুরুষে বুনে যাওয়া সেই গদ্যে চোখের কোথাও খোঁচা না খেয়েই পাঠক এগিয়ে যেতে পারে একতালে।
আর দ্বিতীয় মশলাটি হলো পপ কালচারের উপাদান। জাপানের চেয়েও যে পাশ্চাত্যেই মুরাকামির পাঠক বেশি, কারণ তার লেখায় ব্যবহৃত সিনেমা, বেসবল এবং অবধারিত ভাবে সঙ্গীতের যা উদাহরণ টানা হয়, সবই মূলত পাশ্চাত্যের। অনুভূতির সাথে তুলনা দিতে পাতায় পাতায় বাখ, শুবার্ট, মোজার্ট, জ্যাক ক্যারুয়াক, বোলান অথবা কাফকার উল্লেখ; দুনিয়া জোড়া পাঠকের কাছে মুরাকামির উপন্যাসকে করে তোলে আকর্ষণীয়।
খেয়াল রাখা দরকার, মুরাকামি সে প্রজন্মের মানুষ, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান রাষ্ট্র হিসেবে নিজের খোল পালটে ফেলতে চেয়েছে আর আত্মীকরণ করা শুরু করেছে পাশ্চাত্যকে। মুরাকামির জাপান তাই যতটা আগস্টের হিরোশিমার, ততটাই বিটলসের।
(৬)
কিন্তু ছক আর মালমশলা নিয়ে ঠিকাদার কি রাজমিস্ত্রির মতো আলাপ করা শেষ হলে পাঠক যখন নজর দ্যায় আরো ভেতরে, অবাক না হয়ে তার উপায় থাকে না। সাদাচোখে ভীষণ আনাড়িপনায় ভরপুর মনে হওয়া উপন্যাসগুলোতে মুরাকামি কী করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন? ক্যানো তারা পাঠককে স্পর্শ করে যায়?
কারণ, অনুভব করি, মুরাকামির উপন্যাস এগিয়ে চলে মানুষের বুদ্ধিমত্তা আর যৌক্তিকতার চাকায় ভর করে নয়, সেটা এগোয় নির্বোধ হৃদয়বৃত্তি দিয়ে, যতটা নির্বোধ হলে মানুষ নিজেকে মহাবিশ্বের সাথে একাত্ম করে ফেলতে পারে।
সতর্ক কেরানির মন নিয়ে পড়তে গেলে পাঠকের মনে হতে পারে যে মুরাকামি যেন কিছুতেই গোছাতে পারছে না তার গল্পকে। কিন্তু মাথার ভেতরের ওই অ্যালার্ম ঘড়িকে থাপ্পড় দিয়ে যে চুপ করাতে পারবে, সে অনুভব করবে, মুরাকামি আসলে পাতার পর পাতায় গল্পটা আবিষ্কার করতে চাচ্ছেন পাঠকের সাথেই; ছক কেটে কেটে নয়। মুরাকামির চরিত্ররা যে কুয়োর ভেতর থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে পারে কোনো অজানা হোটেল রুমে (দ্যা উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল), কিংবা চাইলেও বেরোতে পারে না ফেরিস হুইলের কোনো শহর থেকে (স্পুটনিক সুইটহার্ট); তার কারণ প্রগাঢ় পৃথিবী আজও মুরাকামির কাছে চমৎকার সেটার সমস্ত ঐশ্বরিকতা নিয়ে । ১৯৭৮-এর আলো ঝলমল এক বেসবল ম্যাচের মাঝে ডেভ হিলটনের ব্যাটে বলের ছোঁয়া লাগা মাত্রই যে রেস্তোরাঁ মালিক মুরাকামির মনে হবে তিনি উপন্যাস লিখতে পারেন, আর তারও এক বছর পরে প্রকাশকের কাছ থেকে যখন এক দুপুরে ফোন পেয়েই তিনি যে নিশ্চিত জানবেন যে তার জীবন হতে যাচ্ছে এক সফল লেখকের; ব্যাপারগুলোকে নেহাত কাকতালীয় বলা যাবে না তখন আর।
চূড়ান্তরুপে বিকশিত পুঁজিবাদের পৃথিবীতে, সমস্ত মেট্রোপলিসের লোকে যখন নিজেকে গভীরভাবে অচল বলে মনে করে এই শতাব্দীতে; মুরাকামির উপন্যাস পড়লে সে অনুধাবন করে, নক্ষত্রের নিচে সে একা নয় শুধু, জগতটাও তারই মতো বন্ধুহীন। কফিশপের একাকী কাপ আর সমুদ্রের ঢেউ, মুরাকামির হাতে প্রাণ পেয়ে তারাও ছুঁয়ে আসে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত একাকী মানুষকে ।
(৭)
মুরাকামির কোনো লেখা তাই স্লাইড ক্যালিপার্সে মাপ দেওয়া নিখুঁত কোন সাহিত্যকর্ম নয়। কিন্তু মুরাকামির লেখায় কোনো নিরেট হতাশাও নেই। মুরাকামির গল্প এমন পৃথিবীর, যেখানে ডিস্টোপিয়ার এসিড নয় বরং আকাশ থেকে নেমে আসে সার্ডিন মাছের বৃষ্টি; মুরাকামির গল্প এমন পৃথিবীর, যেখানে রাইস পুডিং-এর মশলা ঢুকিয়ে দিলেও মাইক্রোওভেন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ম্যাকোরনি চিজ।
(৮)
যখন কোনো আড্ডায় কেউ আলোচনা করে কথাসাহিত্যের কাজ নিয়ে, আমার মনে হয়, সেটা হলো পাঠককে আনন্দ দেয়া। প্রকাণ্ড এবং অচিন ফুলে ভরপুর কোনো বৃক্ষকে যদি তুলনা দেয়া যায় কথাসাহিত্যের সাথে, দেখা যাবে, তার মূল দেহ থেকে ছড়িয়েছে অনেকগুলো ডালপালা। কোনো ডালে ফুটেছে সৌন্দর্য্যের সাধনা, কোনো ডালে এসেছে গল্প বলার ফুল, কোথাও দেখা যাচ্ছে বক্তব্য, কোথাও দেখা যায় সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্ট কোনো মৌসুমী রঙ্গন। মুরাকামির উপন্যাস, শাখাপ্রশাখায় বিচরণ না করে সেই শালপ্রাংশু বৃক্ষের মূল দেহে জড়িয়ে আছে।
যখন কেউ আমায় জিজ্ঞেস করে হারুকি মুরাকামির উপন্যাস কী করে; আমি তখন জানাই যে গল্পের যাদু দেখানো, পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্যের সাধনা আর দর্শন প্রতিষ্ঠার প্রচলিত ধারণাকে কনুই মেরে সরিয়ে দিয়ে মুরাকামির উপন্যাস পাঠককে নিশ্চিত আনন্দ দিয়ে যায়।
হারুকি মুরাকামিকে নিয়ে যখন বলতে হয়, আমি তখন এটুকুই বলি।
[ ৩০ মার্চ, ২০২০]
Leave a Reply